হিজরি নববর্ষ ১৪৩৯ সন
আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেন- ‘আকাশ এবং পৃথিবী সৃষ্টির প্রথম দিন থেকেই বছর গণনার মাস বারটি’। কুরআন সে শাশ্বত ঘোষণার আলোকেই পৃথিবীর দেশে দেশে সন এবং বছর গণনার নানা পন্থা আবিষ্কৃত হয়েছে। আর পৃথিবীতে যত দেশে যত সন আছে সবগুলোরই ১২ মাসের বছর। অবশ্য সৌরমাস ভিত্তিক এবং চন্দ্রমাস ভিত্তিক গণনার ভিন্নতায় এসব সনের পরিধিগত বেশ কমও রয়েছে। সন গণনার সে বিশ্বজনীন সংস্কৃতির পথ ধরেই আমাদের বাংলাদেশেও নানা যুগে নানা সন প্রবর্তিত হয়েছে। প্রাচীন শক সনের পথ ধরে এখানে প্রবর্তিত হয়েছে সম্বৎ, মঘী সন, নেপাল সম্বৎ, ত্রিপুরাব্দ, লক্ষণ সম্বৎ, পরগণাতি সন, শাহুর সন, হিজরী সন, ঈসায়ী বা খৃষ্টিয় সন, বাংলা সন, জালালী সন ইত্যাদি। এর কোন কোনটা সৌরবর্ষে আবার কোন কোনটা চন্দ্রবর্ষে গণনা করা হয়ে থাকে।
বাংলাদেশে তিনটি বর্ষের প্রচলন রয়েছে। ইংরেজি , বাংলা ও হিজরি। আজকে আমরা আলোচনা করবো হিজরি নববর্ষ ১৪৩৮ সনের ১ম মাস মহররম মাসের ফজিলত নিয়ে। ধর্মীয় আচার–অনুষ্ঠান, আনন্দ-উৎসবসহ সব ক্ষেত্রেই মুসলিম উম্মাহ হিজরি সনের ওপর নির্ভরশীল। বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর কৃষ্টি-সংস্কৃতি ও মুসলিম জীবনে হিজরি সনের গুরুত্ব অপরিসীম।
মহররম শব্দের অর্থ সম্মানিত। ইসলামের ইতিহাসে এই মাস এমন কতগুলো উল্লেখযোগ্য স্মৃতিবিজড়িত, যে স্মৃতিসমূহের সম্মানার্থেই এই মাসকে মহররম বা সম্মানিত বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এ সম্পর্কে কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর বিধান ও গণনায় মাসের সংখ্যা ১২। যেদিন থেকে তিনি সব আসমান ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। তন্মধ্যে চারটি হলো সম্মানিত মাস। এটাই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। সুতরাং তোমরা এ মাসগুলোর সম্মান বিনষ্ট করে নিজেদের প্রতি অত্যাচার করো না।’ (সুরা তাওবা : ৩৬) এ চার মাসের এক মাস মহররম। যারা বিশেষভাবে এ মাসগুলোতে ইবাদত-বন্দেগি করবে, আল্লাহ তাআলা তাদের বাকি আট মাস ইবাদত করার তৌফিক দান করবেন এবং যারা এ চার মাস নিজেকে গুনাহ থেকে বাঁচিয়ে রাখবেন, তাদের জন্য বাকি আট মাস যাবতীয় পাপ কাজ থেকে বেঁচে থাকা সহজ হবে। হাদিস শরিফে চান্দ্রবর্ষের বারো মাসের মধ্যে মহররমকে ‘শাহরুল্লাহ’ বা ‘আল্লাহর মাস’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আর পবিত্র কোরআনে উল্লিখিত সুরা তাওবার ৩৬ নম্বর আয়াতে ‘অতি সম্মানিত ও মর্যাদাপূর্ণ চার মাস’ বলতে জিলকদ, জিলহজ, মহররম, রজব—এই চার মাসকেই বোঝানো হয়েছে। (তাফসিরে মাজহারি)।
এ মাসগুলো সম্মানিত হওয়ার অর্থ এই নয় যে, এগুলো ছাড়া আর কোনো মাসের কোনো সম্মান নেই। কারণ রমজান মাস হচ্ছে বছরের সবচেয়ে সম্মানিত মাস। তবে এ মাসগুলোর এক ভিন্ন বৈশিষ্ট্য রয়েছে, আর তা হচ্ছে এ মাসগুলো ইসলামপূর্ব সময়েও মক্কার মুশরিকদের কাছে সম্মানিত ছিল এবং আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এগুলোর সম্মানকে অবশিষ্ট রেখেছেন।
নিম্নলিখিত আয়াত ও হাদিসগুলো দিয়ে এ মাসে বিশেষভাবে আশুরার দিনে যা করণীয় ও যা বর্জনীয় সাব্যস্ত হয়, সেগুলো উল্লেখ করা হল।
তবে এ রোজা অনেক ফজিলতপূর্ণ ও এর মহাসাওয়াবের কথা নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদিস শরিফে ব্যক্ত করেছেন।
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘রমজানের পর সর্বোত্তম রোজা হচ্ছে মহররম মাসের রোজা।’ (মুসলিম শরিফ)।
হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন ‘আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আশুরার দিন এবং রমজান মাসে যেভাবে তার সঙ্গে রোজা রাখতে দেখেছি, অন্য কোনো সময় দেখিনি’। (বুখারি, মুসলিম)।
হজরত আবু কাতাদাহ আল-আনসারী (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আশুরার রোজা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি ইরশাদ করেন, এ রোজার মাধ্যমে বিগত এক বছরের গুনাহ মাফ হয়। (ইবনে মাজাহ, মুসলিম শরিফ)।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদিনায় তাশরিফ আনলেন এবং ইহুদিদের দেখলেন আশুরার দিনে রোজা রাখতে, তখন জিজ্ঞেস করলেন তোমরা কেন এ দিন রোজা রাখ? তারা বলল, এটা সেই মহান দিন, যে দিনে আল্লাহতায়ালা বনি ইসরাঈলকে শত্র“র কবল থেকে মুক্তি দিয়ে ছিলেন। ফলে হজরত মুসা (আ.) এ দিনে রোজা রাখতেন। তিনি ইরশাদ করেন, আমি তোমাদের চেয়ে মুসা (আ.) এর যে কোনো বিষয়ে বেশি হকদার। ফলে তিনি নিজে রোজা রাখলেন এবং অন্যদেরও রোজা রাখতে আদেশ করলেন। (বুখারি ৩৩৯০)।
হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘তোমরা আশুরার রোজা রাখ এবং ইহুদিদের সাদৃশ্যতা পরিহার কর। আশুরার আগে বা পরে আরও একদিন রোজা রাখ।’ (মুসনাদে আহমাদ ১/২৪১)।
অন্য রেওয়ায়েতে এসেছে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন আশুরার রোজা রাখলেন এবং এ রোজা রাখতে আদেশ করলেন, তখন সাহাবায়ে কিরাম (রা.) আরজ করলেন ইয়া রাসূলাল্লাহ! এই দিনকে তো ইহুদি ও নাসারারা সম্মান করে। ফলে তিনি ইরশাদ করলেন, আমি যদি আগামী বছর হায়াতে থাকি তাহলে অবশ্যই ৯ তারিখেও রোজা রাখব। (মুসলিম শরিফ ১/৩৫৯)।
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘রমজানের পর যদি তুমি রোজা রাখতে চাও, তবে মহররম মাসে রোজা রাখ। কারণ এটি আল্লাহর মাস। এ মাসে এমন একটি দিন আছে, যে দিনে আল্লাহতায়ালা একটি জাতির তাওবা কবুল করেছেন এবং ভবিষ্যতেও অন্যান্য জাতির তাওবা কবুল করবেন।’ (জামে তিরমিজি ১/১৫৭)।
এখানে একটা কথা মাথায় রাখতে হবে, তা হচ্ছে কোরআন হাদিসে যত জায়গায় এরকম বিভিন্ন আমলের মাধ্যমে গুনাহ মাফ হওয়ার কথা বলা হয়েছে, এগুলো সগিরা গুনাহ বা ছোট ছোট গুনাহ। কারণ কবিরা গুনাহর ক্ষেত্রে শরিয়তের বিধান হচ্ছে এর জন্য খাঁটি দিলে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দরবারে তওবা করতে হবে। তওবা ছাড়া কবিরা গুনাহ মাফ হয় না।
এ দিনে আল্লাহতায়ালা পূর্ববর্তী উম্মতের তাওবা কবুল করেছেন এবং এ উম্মতকেও ক্ষমা করার প্রতিশ্র“তি হাদিস শরিফে এসেছে। তাই এ দিনে আল্লাহর দরবারে বেশি বেশি ইস্তিগফার করা এবং খালেস দিলে তাওবা করা উত্তম।
মহররমর ফজিলত ও আশুরার রোজার বিধান
আশুরা আরবি শব্দ। এর অর্থ হলো দশম তারিখ। ইসলামি পরিভাষায় মহররমের দশম তারিখকে আশুরা বলে। সৃষ্টির শুরু থেকে মহররমের ১০ তারিখে তথা আশুরার দিনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। যার ফলে আশুরার মর্যাদা ও মাহাত্ম্য উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। সর্বশেষ ৬২ হিজরি সনে কুফার ফোরাত নদীর তীরে কারবালার প্রান্তরে নবীদৌহিত্র হজরত হোসেইন (রা.)-এর শাহাদত এই দিনকে বিশ্ববাসীর কাছে স্মরণীয় ও বরণীয় করে রেখেছে।
আশুরার রোজা সব নবীর আমলেই ছিল। নবী করিম (সা.) মক্কায় থাকতেও আশুরার রোজা পালন করতেন। হিজরতের পর মদিনায় এসে রাসুলুল্লাহ (সা.) দেখতে পেলেন, ইহুদিরাও এই দিনে রোজা রাখছে। প্রিয় নবী (সা.) তাদের রোজার কারণ জানতে চাইলেন, তারপর জানতে পারলেন, এ দিনে মুসা (আ.) সিনাই পাহাড়ে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাওরাত লাভ করেন। এ দিনেই তিনি বনি ইসরাইলকে ফেরাউনের কয়েদখানা থেকে উদ্ধার করেন এবং এ দিনেই তিনি বনি ইসরাইলদের নিয়ে লোহিত সাগর অতিক্রম করেন। আর ফেরাউন সেই সাগরে ডুবে মারা যায়। তাই কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য ইহুদিরা এই দিন রোজা রাখে।
মহানবী (সা.) বললেন, মুসা (আ.)-এর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক তোমাদের চেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠ ও অগ্রাধিকারমূলক। অতঃপর তিনি ১০ মহররমের সঙ্গে ৯ মহররম মিলিয়ে দুটি রোজা রাখতে বললেন। কারণ, ইহুদিদের সঙ্গে মুসলমানদের যেন সাদৃশ্য না হয়। দ্বিতীয় হিজরিতে রমজান মাসের রোজা ফরজ হলে আশুরার রোজা নফল হয়ে যায়। তবে রমজানের রোজার পর আশুরার রোজা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও ফজিলতপূর্ণ। এ মাসের নফল রোজা ও অন্যান্য ইবাদত রমজান মাস ছাড়া অন্য যেকোনো মাস অপেক্ষা অধিক উত্তম। (মুসলিম ও আবু দাউদ)। (বিশেষ প্রয়োজনে একটিও রাখা যাবে; তবে দুটি রাখাই উত্তম)।
হজরত কাতাদা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুলে পাক (সা.) বলেন, আশুরার রোজার ব্যাপারে আমি আশাবাদী, আল্লাহ তাআলা এর অছিলায় অতীতের এক বছরের গুনাহ মাফ করে দেবেন। (তিরমিজি ও মুসানাদে আহমাদ)। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলে পাক (সা.) বলেন, রমজানের রোজার পরে মহররমের রোজা হলো সর্বশ্রেষ্ঠ, যেমন ফরজ নামাজের পরে শেষ রাতের তাহাজ্জুদ নামাজ সবচেয়ে বেশি মর্যাদাসম্পন্ন।
করনীয় কাজগুলো
আগেই উল্লেখ হয়েছে, রমজান মাসের পর সবচেয়ে ফজিলতপূর্ণ রোজা হচ্ছে মহররম মাসের রোজা, তাই সাধ্য অনুযায়ী পুরো মহররম মাসজুড়ে বেশি বেশি রোজা রাখতে সচেষ্ট হতে হবে। বিশেষভাবে আশুরা দিবসের রোজা রাখা। এর অনেক ফজিলত ও গুরুত্ব এসেছে হাদিস শরিফে। এর দ্বারা বিগত এক বছরের গুনাহ মাফ হয়ে যায়।
বর্জনীয় কাজগুলো
যে আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেছেন যে, চারটি মাস সম্মানিত, সে আয়াতেরই শেষ অংশে নির্দেশ দিয়েছেন, ‘অতএব তোমরা এই মাসগুলোতে নিজেদের ওপর জুলুম কোরো না’ (সূরা তাওবা : ৩৬)।
বাহ্যিক অর্থ হচ্ছে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যে জান আমাদের দান করেছেন এটার হিফাজত করা। একে কষ্ট না দেয়া, অকারণে একে বিপদে না ফেলা। সব ক্ষতিকারক জিনিস থেকে এর হিফাজত করা। তাই এই মাসে অনেকে হজরত হুসাইন রা:-এর শাহাদতের ওপর শোকের বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ যে বুক চাপড়ায়, নিজের শরীরকে জখম করে, রক্তাক্ত করে, কুরআন মজিদ এই কাজকে কঠিনভাবে নিষেধ করছে।
নিজের জানকে কষ্টে ফেলে শোক প্রকাশ করার ওপর হাদিস শরীফেও কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে, ‘ওই ব্যক্তি আমাদের (মুসলমানদের) দলভুক্ত নয় যে তার গাল চাপড়ায়, জামাকাপড় ছিঁড়ে ফেলে এবং জামানায় জাহিলিয়াতের মতো ক্রন্দন করে (শোক প্রকাশ করে)’ (সহিহ বুখারি, কিতাবুল জানায়েজ)।
আজকাল আশুরা উপলক্ষে যে মাতম করা হয়, ইসলাম তার অনুমতি দেয় না, এবং যার শাহাদতে শোক প্রকাশ করা হয়ে থাকে, তিনি নিজেও এরূপ করতে পরিষ্কারভাকে বারণ করে গেছেন।
মহররম মাস সম্পর্কে কিছু প্রচলিত ভুল ধারণা
মহররম মাসের যেমন শ্রেষ্ঠত্ব ও ফজিলত রয়েছে, তেমনি এ মাস সম্পর্কে সাধারণে্য কিছু ভুল ধারণা রয়েছে। যেমন এই মাসে বিয়ে-শাদি না করা, নতুন ঘরবাড়ি নির্মাণ না করা, কোনো শুভ কাজ বা ভালো কাজের সূচনা না করা, গোশত না খাওয়া ও নিরামিষ আহার করা, পান না খাওয়া, নতুন কাপড় ও সুন্দর পোশাক পরিধান না করা, সাদা কাপড় বা কালো কাপড় তথা শোকের পোশাক পরা, সকল প্রকার আনন্দ-উৎসব পরিহার করা ইত্যাদি। এসবই কুসংস্কার। কোরআন ও হাদিসে এ রকম কিছু লেখা নেই।
আল্লাহ্ আমাদের সকলকে সর্ব প্রকার বিদ’আত থেকে বেঁচে থাকার তাওফিক দান করুন। আমীন!
সম্পাদনায়-মাহবুব এইচ শাহীন/প্রকাশক ও সম্পাদক/কাগজটোয়েন্টিফোরবিডি.কম