হুমায়ুন আহমেদ এর মৃত্যু বার্ষিকী
‘যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো চলে এসো এক বরষায়/এসো ঝরঝর বৃষ্টিতে/জলভরা দৃষ্টিতে/এসো কোমল শ্যামল ছায়… যদিও তখন আকাশ থাকবে বৈরী/কদমগুচ্ছ হাতে নিয়ে আমি তৈরি/ উতলা আকাশ মেঘে মেঘে হবে কালো ঝলকে ঝলকে নাচিবে বিজলি আলো/ তুমি চলে এসো এক বরষায়।’
‘একটা ছিলো সোনার কন্যা, মেঘ বরণ কেশ/ভাটি অঞ্চলে ছিলো সেই কন্যার দেশ/দুই চোখে তার আহারে কী মায়া/নদীর জলে পড়ল কন্যার ছায়া/তাহার কথা বলি/তাহার কথা বলতে বলতে/নাও দৌড়াইয়া চলি…’
‘মাথায় পরেছি সাদা ক্যাপ/হাতে আছে অচেনা এক শহরের ম্যাপ/ব্যাগ ঝুলিয়েছি কাঁধে/নামব রাজপথে/চারদিকে ঝলমলে রোদ/কেটে যাবে আঁধারের ছায়া-অবরোধ…।’
অথবা এছাড়াও ‘চাঁদনী পসর রাইতে যেন আমার মরণ হয়’, ‘ও আমার উড়াল পঙ্খিরে যা যা তুই উড়াল দিয়ে যা’, ‘আমার ভাঙা ঘরে ভাঙা চালা’, ‘ভাঙা বেড়ার ফাঁকে’, ‘চলো বৃষ্টিতে ভিজি’, ‘এখন খেলা থেমে গেছে মুছে গেছে রং’, এ রকম হৃদয়স্পর্শী জনপ্রিয় গানের রচয়িতা হুমায়ুন আহমেদ।
উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ : দেয়াল, নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগার, জোছনা ও জননীর গল্প, বহুব্রীহি, গৌরীপুর জাংশান, দ্বিতীয় মানব, মধ্যাহ্ন এবং হিমু-সংক্রান্ত প্রায় ২৪টি সিরিজ উপন্যাস। তার মিসির আলী-সংক্রান্ত উপন্যাসও রয়েছে জনপ্রিয়তায় শীর্ষে। আত্মজীবনী : বল পয়েন্ট, কাঠপেন্সিলসহ প্রায় আটটি গ্রন্থ। উল্লেখযোগ্য টিভি নাটক- এসব দিন রাত্রি, কোথাও কেউ নেই, অয়োময়, নক্ষত্রের রাত, বহুব্রীহি, আজ রবিবার তারা তিনজন। চলচ্চিত্র – আগুনের পরশমণি, শ্রাবণ মেঘের দিন, দুই দুয়ারী, চন্দ্রকথা, শ্যামল ছায়া, ঘেটুপুত্র কমলা।
কোটি হৃদয়ের ভালোবাসায় সিক্ত হুমায়ুন আহমেদ পেয়েছেন বাংলা একাডেমী পুরস্কার একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, শিশু একাডেমী পুরস্কার, লেখক শিবির পুরস্কার, মাইকেল মধুসূদন পদক, বাচসাস পুরস্কার, হুমায়ুন কাদির স্মৃতি পুরস্কার।
জননন্দিত কথাশিল্পী হুমায়ুন আহমেদের আজ ৪র্থ মৃত্যুবার্ষিকী। দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তিনি। ২০১২ সালের আজকের দিনে ১৯ জুলাই হুমায়ূন আহমেদ আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন অন্তরালে। আজ (মঙ্গলবার) তার ৪র্থ প্রয়াণ দিবস। তার গল্প উপন্যাসের মতো তার লেখা গানও হৃদয়স্পর্শী। মৃত্যুদিনে তাকে স্মরণ করার পাশাপাশি তার সৃষ্টিকেও স্মরণ করবে অনুরাগীরা।
আজ ১৯ জুলাই বাংলা সাহিত্যের বরপুত্র হুমায়ুন আহমেদ এর মৃত্যু বার্ষিকী
——————————————————————————- মাহবুব এইচ শাহীন
হুমায়ুন আহমেদ ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১৩ই নভেম্বর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত নেত্রকোণা মহুকুমার কেন্দুয়ার কুতুবপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা শহিদ ফয়জুর রহমান আহমদ এবং মা আয়েশা ফয়েজ। তাঁর পিতা একজন পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন এবং তিনি ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তৎকালীন পিরোজপুর মহকুমার এসডিপিও (ইংরেজী:SDPO – Sub-Divisional Police Officer) হিসেবে কর্তব্যরত অবস্থায় শহীদ হন। তাঁর বাবা পত্র-পত্রিকায় লেখালিখি করতেন। বগুড়া থাকার সময় তিনি একটি গ্রন্থও প্রকাশ করেছিলেন। গ্রন্থের নাম দ্বীপ নেভা যার ঘরে। তাঁর মা’র লেখালিখির অভ্যাস না-থাকলেও একটি আত্মজীবনী গ্রন্থ রচনা করেছেন যার নাম জীবন যে রকম। তাঁর অনুজ মুহম্মদ জাফর ইকবাল দেশের একজন বিজ্ঞান শিক্ষক এবং কথাসাহিত্যিক; সর্বকনিষ্ঠ ভ্রাতা আহসান হাবীব রম্য সাহিত্যিক এবং কার্টুনিস্ট।
তাঁর রচিত উপন্যাস থেকে জানা যায় যে ছোটকালে হুমায়ুন আহমেদের নাম রাখা হয়েছিল শামসুর রহমান; ডাকনাম কাজল। তাঁর পিতা (ফয়জুর রহমান) নিজের নামের সাথে মিল রেখে ছেলের নাম রাখেন শামসুর রহমান। পরবর্তীতে আবার তিনি নিজেই ছেলের নাম পরিবর্তন করে হুমায়ুন আহমেদ রাখেন। হুমায়ুন আহমেদের ভাষায়, তাঁর পিতা ছেলে-মেয়েদের নাম পরিবর্তন করতে পছন্দ করতেন। তাঁর ছোট ভাই মুহম্মদ জাফর ইকবালের নাম আগে ছিল বাবুল এবং ছোটবোন সুফিয়ার নাম ছিল শেফালি। ১৯৬২-৬৪ সালে চট্টগ্রামে থাকাকালে হুমায়ুন আহমেদের নাম ছিল বাচ্চু।
হুমায়ুন আহমেদের প্রথমা স্ত্রীর নাম গুলতেকিন আহমেদ। তাঁদের বিয়ে হয় ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে। এই দম্পতির তিন মেয়ে এবং এক ছেলে। তিন মেয়ের নাম বিপাশা আহমেদ, নোভা আহমেদ, শীলা আহমেদ এবং ছেলের নাম নুহাশ আহমেদ। অন্য আরেকটি ছেলে অকালে মারা যায়। ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যভাগ থেকে শীলার বান্ধবী এবং তার বেশ কিছু নাটক-চলচ্চিত্রে অভিনয় করা অভিনেত্রী শাওনের সাথে হুমায়ুন আহমেদের ঘনিষ্ঠতা জন্মে। এর ফলে সৃষ্ট পারিবারিক অশান্তির অবসানকল্পে ২০০৫-এ গুলতেকিনের সঙ্গে তাঁর বিচ্ছেদ হয় এবং ঐ বছরই শাওনকে বিয়ে করেন। এ ঘরে তাদের তিন ছেলে-মেয়ে জন্মগ্রহণ করে। প্রথম ভূমিষ্ঠ কন্যাটি মারা যায়। ছেলেদের নাম নিষাদ হুমায়ুন ও নিনিত হুমায়ুন।
তাঁর বাবা চাকুরী সূত্রে দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করেছেন বিধায় হুমায়ুন আহমেদ দেশের বিভিন্ন স্কুলে লেখাপড়া করার সুযোগ পেয়েছেন। তিনি বগুড়া জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেন এবং রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। তিনি পরে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই বিজ্ঞানে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন শাস্ত্রে অধ্যয়ন করেন এবং প্রথম শ্রেণীতে বিএসসি (সম্মান) ও এমএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি মুহসীন হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন এবং ৫৬৪ নং কক্ষে তার ছাত্রজীবন অতিবাহিত করেন। পরে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে পলিমার রসায়ন বিষয়ে গবেষণা করে পিএইচডি লাভ করেন। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত থাকা অবস্থায় প্রথম বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী তোমাদের জন্য ভালোবাসা রচনা করেন। ১৯৭৪ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। শিক্ষক হিসেবে ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন এই অধ্যাপক। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক হিসাবে দীর্ঘকাল কর্মরত ছিলেন। লেখালিখি এবং চলচ্চিত্র নির্মাণের স্বার্থে তিনি অধ্যাপনা ছেড়ে দেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জীবনে একটি নাতিদীর্ঘ উপন্যাস রচনার মধ্য দিয়ে হুমায়ুন আহমেদের সাহিত্য জীবনের শুরু। এই উপন্যাসটির নাম নন্দিত নরকে। ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে উপন্যাসটি প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। ১৯৭২-এ কবি-সাহিত্যিক আহমদ ছফার উদ্যোগে উপন্যাসটি খান ব্রাদার্স কর্তৃক গ্রন্থাকারে প্রথম প্রকাশিত হয়। প্রখ্যাত বাংলা ভাষাশাস্ত্র পন্ডিত আহমদ শরীফ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে এ গ্রন্থটির ভূমিকা লিখে দিলে বাংলাদেশের সাহিত্যামোদী মহলে কৌতূহল সৃষ্টি হয়। শঙ্খনীল কারাগার তাঁর ২য় গ্রন্থ। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি দুই শতাধিক গল্পগ্রন্থ ও উপন্যাস রচনা করেছেন। তাঁর রচনার প্রধান কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের মধ্যে অন্যতম হলো ‘গল্প-সমৃদ্ধি’। এছাড়া তিনি অনায়াসে ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে অতিবাস্তব ঘটনাবলীর অবতারণা করেন যাকে একরূপ যাদু বাস্তবতা হিসেবে গণ্য করা যায়। তাঁর গল্প ও উপন্যাস সংলাপ প্রধান। তাঁর বর্ণনা পরিমিত এবং সামান্য পরিসরে কয়েকটি মাত্র বাক্যের মাধ্যমে চরিত্র চিত্রণের অদৃষ্টপূর্ব প্রতিভা তাঁর রয়েছে। যদিও সমাজসচেতনতার অভাব নেই তবু লক্ষ্যণীয় যে তাঁর রচনায় রাজনৈতিক প্রণোদনা অনুপস্থিত। সকল রচনাতেই একটি প্রগাঢ় শুভবোধ ক্রিয়াশীল থাকে; ফলে ‘নেতিবাচক’ চরিত্রও তাঁর লেখনীতে লাভ করে দরদী রূপায়ণ। এ বিষয়ে তিনি মার্কিন লেখক স্টেইনবেক দ্বারা প্রভাবিত। অনেক রচনার মধ্যে তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং উপলব্ধির প্রচ্ছাপ লক্ষ্য করা যায়। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে রচিত উপন্যাস মধ্যাহ্ন তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা হিসেবে পরিগণিত। এছাড়া জোছনা ও জননীর গল্প আরেকটি বড় মাপের রচনা, যা কি-না ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ অবলম্বন করে রচিত। তবে সাধারণত তিনি সমসাময়িক ঘটনাবলী নিয়ে লিখে থাকেন।
টেলিভিশনের জন্য একের পর এক দর্শক-নন্দিত নাটক রচনার পর হুমায়ুন আহমেদ ১৯৯০-এর গোড়ার দিকে চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করেন। তাঁর পরিচালনায় প্রথম চলচ্চিত্র আগুনের পরশমণি মুক্তি পায় ১৯৯৪ সালে। ২০০০ সালে শ্রাবণ মেঘের দিন ও ২০০১ সালে দুই দুয়ারী চলচ্চিত্র দুটি প্রথম শ্রেনীর দর্শকদের কাছে দারুন গ্রহণযোগ্যতা পায়। ২০০৩-এ নির্মান করেন চন্দ্রকথা নামে একটি চলচ্চিত্র। ১৯৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ২০০৪ সালে নির্মান করেন শ্যামল ছায়া চলচ্চিত্রটি। এটি ২০০৬ সালে “সেরা বিদেশী ভাষার চলচ্চিত্র” বিভাগে একাডেমি পুরস্কার এর জন্য বাংলাদেশ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। এছাড়াও চলচ্চিত্রটি কয়েকটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়। তাঁর সব চলচ্চিত্রে তিনি নিজে গান রচনা করেন। ২০০৮-এ আমার আছে জল চলচ্চিত্রটি তিনি পরিচালনা করেন। ২০১২ সালে তাঁর পরিচালনার সর্বশেষ ছবি ঘেটুপুত্র কমলা (চলচ্চিত্র)।
এছাড়াও হুমায়ুন আহমেদের লেখা উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র। এর মধ্যে ২০০৬ সালে মোরশেদুল ইসলাম পরিচালিত দুরত্ব, বেলাল আহমেদ পরিচালিত নন্দিত নরকে এবং আবু সাইদ পরিচালিত নিরন্তর। ২০০৭-এ শাহ আলম কিরণ পরিচালিত সাজঘর এবং তৌকির আহমেদ নির্মাণ করেন বহুল আলোচিত চলচ্চিত্র দারুচিনি দ্বীপ।
এরপর তার সব লেখাই পাঠকের মন জয় করেছে। একুশে বইমেলায় লম্বা সারিতে দাঁড়িয়ে পাঠক কিনেছে তার বই। প্রিয় লেখকের অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য অপেক্ষায় থেকেছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তার পান্ডুলিপি পাওয়ার জন্য প্রকাশকেরাও অপেক্ষায় থাকতেন। হুমায়ূনের জনপ্রিতা এতোটাই তুঙ্গে ছিল যে, একটা সময় তার লেখা ছাড়া পত্রিকার ঈদসংখ্যাসহ বিষেশ সংখ্যা খুব কমই প্রকাশিত হতো। একটি প্রকাশনার পর হুমায়ূন আহমেদ এরপর কী লিখেছেন তা পড়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন পাঠকেরা।
হুমায়ূন আহমেদ শুধু চলচ্চিত্র নির্মণেই থেমে ছিলেন না। চলচ্চিত্র ও নাটকের জন্য তিনি লিখেছেন অসাধারণ সব গান লিখেছেন। সুরও করেছেন বেশকিছু গানে। শিল্পী-সাহিত্যিক বা যেকোনো মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তার কথা শুনতেন। যে কোনো অতি সাধারণ বিষয়ও তার উপস্থানায় অসাধারণ মনে হতো। কথা বলার সময় এক ধরনের ইল্যুশন বা মোহময়ী আবেশ তৈরি করতেন তিনি। সে আবেশে শ্রোতারা পরিবভ্রমন করতেন আপাত দৃশ্যমান অথচ ভিন্ন জগতে। এ কারণে, লেখার মতো তার বলা কথাগুলোও ভক্ত, পাঠকের জন্য ছিল বিশেষ পাওনা।
কথাসাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ব্যক্তিগত আড্ডায় হুমায়ূন আহমেদের কথায় অভিভূত হয়ে বলেছিলেন, “ওর কথাগুলো রেকর্ড করে রাখা উচিত।”
২০১১-এর সেপ্টেম্বের মাসে সিঙ্গাপুরে ডাক্তারী চিকিৎসার সময় তাঁর দেহে মলাশয়ের ক্যান্সার ধরা পড়ে। তিনি নিউইয়র্কের মেমোরিয়াল শ্লোয়ান-কেটরিং ক্যান্সার সেন্টারে চিকিৎসা গ্রহণ করেন।তবে টিউমার বাইরে ছড়িয়ে না-পড়ায় সহজে তাঁর চিকিৎসা প্রাথমিকভাবে সম্ভব হলেও অল্প সময়ের মাঝেই তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। ১২ দফায় তাঁকে কেমোথেরাপি দেওয়া হয়েছিল। অস্ত্রোপচারের পর তাঁর কিছুটা শারীরিক উন্নতি হলেও, শেষ মুহূর্তে শরীরে অজ্ঞাত ভাইরাস আক্রমণ করায় তার অবস্থা দ্রুত অবনতির দিকে যায়। কৃত্রিমভাবে লাইভ সাপোর্টে রাখার পর ১৯ জুলাই ২০১২ তারিখে হুমায়ুন আহমেদ মৃত্যুবরণ করেন। মলাশয়ের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘ নয় মাস চিকিৎসাধীন থাকার পর ২০১২ সালের ১৯ জুলাই-এ স্থানীয় সময় ১১:২০ মিনিটে নিউ ইয়র্কের বেলের্যু হসপিটালে এই নন্দিত লেখক মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুতে সারা বাংলাদেশে সকল শ্রেণীর মানুষের মধ্যে অভূতপূর্ব আহাজারির সৃষ্টি হয়। তাঁর মৃত্যুর ফলে বাংলা সাহিত্য ও চলচ্চিত্র অঙ্গনে এক শূন্যতার সৃষ্টি হয়। ২৪ জুলাই তাকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয় নুহাশপল্লীর লিচুতলায়।
মৃত্যু নিয়ে হুমায়ুন আহমেদ এর বই এর কিছু লাইন –
১। মৃত্যুর সময় পাশে কেউ থাকবে না,এর চেয়ে ভয়াবহ বোধ হয় আর কিছুই নেই। শেষ বিদায় নেয়ার সময় অন্তত কোনো একজন মানুষকে বলে যাওয়া দরকার। নিঃসঙ্গ ঘর থেকে একা একা চলে যাওয়া যায় না, যাওয়া উচিত নয়। এটা হৃদয়হীন ব্যাপার।(দেবী-পৃ:৪৮)
২। মৃত্যু টের পাওয়া যায়। তার পদশব্দ ক্ষীন কিন্তু অত্যন্ত তীক্ষ্ণ।(তোমাকে-পৃ:৬৩)
৩। বেঁচে থাকার মতো আনন্দের আর কিছু নেই।(আগুনের পরশমনি-পৃ:৯৭)
৪। অসম্ভব ক্ষমতাবান লোকেরা প্রায় সময়ই নিঃসঙ্গ অবস্থায় মারা যায়।(আকাশ জোড়া মেঘ-পৃ:২৭)
৫। আমরা জানি একদিন আমরা মরে যাব এই জন্যেই পৃথিবীটাকে এত সুন্দর লাগে। যদি জানতাম আমাদের মৃত্যু নেই তাহলে পৃথিবীটা কখনোই এত সুন্দর লাগতো না।(মেঘ বলেছে যাব যাব-পৃ:১৫৮)
৬। মৃত মানুষদের জন্য আমরা অপেক্ষা করি না। আমাদের সমস্ত অপেক্ষা জীবিতদের জন্য।(অপেক্ষা-পৃ:১৪৬)
৭। যে বাড়িতে মানুষ মারা যায় সে বাড়িতে মৃত্যুর আট থেকে নয় ঘন্টা পর একটা শান্তি শান্তি ভাব চলে আসে। আত্মীয় স্বজনরা কান্নাকাটি করে চোখের পানির স্টক ফুরিয়ে ফেলে। চেষ্টা করেও তখন কান্না আসে না। তবে বাড়ির সবার মধ্যে দুঃখী দুঃখী ভাব থাকে। সবাই সচেতন ভাবেই হোক বা অচেতন ভাবেই হোক দেখানোর চেষ্টা করে মৃত্যুতে সেই সব চেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছে। মূল দুঃখের চেয়ে অভিনয়ের দুঃখই প্রধান হয়ে দড়ায়। একমাত্র ব্যাতিক্রম সন্তানের মৃত্যুতে মায়ের দুঃখ।(হিমুর রুপালী রাত্রি-পৃ:১৮)
৮। বিবাহ এবং মৃত্যু-এই দুই বিশেষ দিনে লতা পাতা আত্মীয়দের দেখা যায়। সামাজিক মেলা মেশা হয়। আন্তরিক আলাপ হয়।(একজন হিমু কয়েকটি ঝি ঝি পোকা-পৃ:৮১)
৯। আসল রহস্য পদার্থ বিদ্যা বা অংকে না-আসল রহস্য মানুষের মনে। আকাশ যেমন অন্তহীন মানুষের মনও তাই। পৃথিবীর বেশির ভাগ অংকবিদ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালোবাসতেন। আকাশের দিকে তাকালে জাগতিক সব কিছুই তুচ্ছ মনে হয়।We are so insignificant. আমাদের জন্ম মৃত্যু সবই অর্থহীন।(আমিই মিসির আলি-পৃ:৭৯)
১০) মৃত্যু হচ্ছে একটা শ্বাশত ব্যাপার। একে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। আমরা যে বেঁচে আছি এটাই একটা মিরাকল।(কবি-পৃ:১৯১)
১১। মানব জীবন অল্প দিনের। এই অল্প দিনেই যা দেখার দেখে নিতে হবে। মৃত্যুর পর দেখার কিছু নেই। দোযখে যে যাবে-সে আর দেখবে কি-তার জীবন যাবে আগুন দেখতে দেখতে। আর বেহেশতেও দেখার কিছু নাই। বেহেশতের সবই সুন্দর। যার সব সুন্দর তার সৌন্দর্য বোঝা যায় না। সুন্দর দেখতে হয় অসুন্দরের সংগে।(কালো যাদুকর-পৃ:৭৮)
১২। সব মৃত্যুই কষ্টের, সুখের মৃত্যু তো কিছু নেই।(কোথাও কেউ নেই-পৃ:৪০)
১৩। দুঃখ কষ্ট সংসারে থাকেই। দুঃখ কষ্ট নিয়েই বাঁচতে হয়। জন্ম নিলেই মৃত্যু লেখা হয়ে যায়।(কোথাও কেউ নেই-পৃ:৩৬)
১৪। শোকে দুঃখে মানুষের মাথা খারাপ হয়ে যায়। কবর দিয়ে দেয়ার পর নিকট আত্মীয় স্বজনরা সবসময় বলে-“ও মরে নাই”।(ছায়া সঙ্গী-পৃ:১৪)
১৫। ঘুম হচ্ছে দ্বিতীয় মৃত্যু।(পারাপার-পৃ:২২)
১৬। মানুষ হচ্ছে একমাত্র প্রানী, যে জানে একদিন তাকে মরতে হবে। কেননা অন্য কোন প্রানী মৃত্যুর জন্য প্রস্তুুতি নেয় না, মানুষ নেয়।(একা একা-পৃ:১০)
১৭। মৃত্যু ভয় বুদ্ধিমত্তার লক্ষন। শুধু মাত্র নির্বোধদেরই মৃত্যু ভয় থাকে না।(নি-পৃ:২৫)
১৮। মৃত্যুতে খুব বেশি দুঃখিত হবার কিছু নেই। প্রতিটি জীবিত প্রানীকেই একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর মরতে হবে। তবে এ মৃত্যু মানে পুরোপুরি ধ্বংস নয়। মানুষের শরীরে অযুত, কোটি, নিযুত ফান্ডামেন্টাল পার্টিকেলস যেমন-ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন-এদের কোন বিনাশ নেই। এরা থেকেই যাবে। ছড়িয়ে পড়বে সারা পৃথিবীতে। কাজেই মানুষের মৃত্যুতে খুব বেশি কষ্ট পাবার কিছু নেই।(নি-পৃ:১০)
১৯। অন্য ভুবনের দিকে যাত্রার আগে আগে সবাই প্রিয়জনদের দেখতে চায়।(আমার আপন আধার-পৃ:৭১)
২০। যে মানুষ মারা যাচ্ছে তার উপর কোন রাগ কোন ঘেন্না থাকা উচিত নয়।(নবনী-পৃ:১০৯)
সূত্রঃ
১। www.humayunahmed.org
২। বাংলাপিডিয়ায় হুমায়ুন আহমেদ
৩। ইন্টারনেট মুভি ডেটাবেজে হুমায়ুন আহমেদ (ইংরেজি)
৪। বাংলা মুভি ডেটাবেজে হুমায়ুন আহমেদ
৫। উইকিপিডিয়া
কাগজ২৪/প্রকাশক ও সম্পাদক/মাহবুব এইচ শাহীন