৬ জানুয়ারির অপেক্ষায় ট্রাম্প
ইলেকটোরাল কলেজের ভোটে ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী জো বাইডেনের পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্ট হওয়া নিশ্চিত হয়ে গেছে। তিনি ৩০৬টি ইলেকটোরাল ভোট পেয়েছেন, বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পেয়েছেন ২৩২টি।
এরপর মঙ্গলবার সেনেটের সংখ্যাগরিষ্ঠ রিপাবলিকানদের নেতা মিচ ম্যাককোনেল নীরবতা ভেঙে ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হওয়ার জন্য জো বাইডেনকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।
যিনি এতদিন চুপ করে ছিলেন, সেই রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও জো বাইডেনকে অভিনন্দন জানিয়েছেন ।
তবে ইলেকটোরাল কলেজের ভোটের পর এখনও চুপ করে আছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
তিনি এখনও পরাজয় স্বীকার করেননি, বরং নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ অব্যাহত রেখেছেন।
কিন্তু এই অভিযোগে করা তার মামলাগুলো সব একের পর এক বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের আদালতে খারিজ হয়ে গেছে।
তবে ট্রাম্প শিবির বলছে আইনি লড়াই চলতে থাকবে এবং তারা সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত যাবেন – যদিও সুপ্রিম কোর্টে এরকম কোনও আপিল শোনা হবে কিনা এবং তা নির্বাচনী ফল উল্টে দিতে পারবে কিনা- তার কোনও নিশ্চয়তা নেই।
তাহলে কি ট্রাম্পের রাজনীতি থেকে বিদায় নেওয়াই ভবিতব্য? নাকি তার হাতে আরও চার বছর হোয়াইট হাউসে থেকে যাবার কোনও কৌশল এখনও রয়ে গেছে?
ট্রাম্পের সবচেয়ে বিশ্বস্ত এবং অনুগতদের একটি দল এখনও মনে করছেন- একটি পথ আছে। সেই নাটক মঞ্চস্থ হবে ৬ জানুয়ারি।
কী ঘটতে যাচ্ছে ৬ জানুয়ারি?
ইলেকটোরাল কলেজের ভোটের যে ফল জানা গেছে সোমবার – সেটা এখনও ‘আনুষ্ঠানিক’ ফল নয়।
এই ভোটের ফল পাঠানো হবে ফেডারেল রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে এবং আগামী ৬ জানুয়ারি ইলেকটোরাল ভোট আনুষ্ঠানিকভাবে গণনা করা হবে কংগ্রেসের এক যৌথ অধিবেশনে।
ওই অধিবেশনে সভাপতিত্ব করবেন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স।
যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন ও আইনের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ৬ জানুয়ারির ঘটনাবলী হয়তো ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ভোটের ফল উল্টে দেবার ক্ষেত্রে ‘শেষ সুযোগ’ এনে দিতে পারে।
এরকম একটা প্রয়াস নিচ্ছেন কয়েকজন সেনেটর এবং কংগ্রেস সদস্য। তারা আরিজোনা পেনসিলভেনিয়া, নেভাডা, জর্জিয়া ও উইসকন্সিন- এই রাজ্যগুলোতে অবৈধ ভোট ও জালিয়াতির লিখিত অভিযোগ জমা দেবেন- যাতে অন্তত একজন সেনেটরের স্বাক্ষর থাকবে।
এর লক্ষ্য হবে ওই রাজ্যগুলোর ভোট ‘ডিসকোয়ালিফাই’ বা বাতিল করা।
আলাবামা রাজ্যের রিপাবলিকান সেনেটর মো ব্রুকস এদের একজন। মার্কিন দৈনিক নিউ ইয়র্ক টাইমসকে তিনি বলছেন, মার্কিন সংবিধান অনুযায়ী সেদিন সুপ্রিম কোর্টসহ যেকোনও আদালতের বিচারকের চেয়ে বড় ভুমিকা আছে কংগ্রেস সদস্যদের। “আমরা যা বলবো তাই হবে, সেটাই চূড়ান্ত” – বলেন তিনি।
এধরনের অভিযোগ উঠলে এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স ফলাফল প্রত্যয়ন করতে অস্বীকার করলে কী হবে – তা নিয়ে মার্কিন বিশ্লেষকরা নানা রকম চিত্র তুলে ধরছেন।
ব্রুকস বলছেন, “আমার এক নম্বর লক্ষ্য হল আমেরিকার ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনী ব্যবস্থা- যা ভোটার জালিয়াতি বা ভোট চুরিকে খুব সহজে মেনে নিচ্ছে- তা মেরামত করা।”
“আর এটা থেকে একটা বোনাস মিলে যেতে পারে যে ডোনাল্ড ট্রাম্প ইলেকটোরাল ভোটে আনুষ্ঠানিকভাবে জিতে গেলেন। কারণ আপনি যদি অবৈধ ভোটগুলো বাদ দেন এবং যোগ্য আমেরিকান নাগরিকদের আইনসঙ্গত ভোটগুলোই শুধু গণনা করেন- তাহলে তিনিই জিতেছেন।”
কিন্তু এরকম কোনও প্রক্রিয়া হবে জটিল এবং দীর্ঘ।
প্রতিটি অভিযোগ নিয়ে কংগ্রেসের উভয় কক্ষে দু’ ঘণ্টা করে বিতর্ক এবং ভোটাভুটি হতে হবে। কোনও একটা রাজ্যের ইলেকটোরাল ভোট বাতিল করতে হলে ডেমোক্র্যাট-নিয়ন্ত্রিত কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ এবং রিপাবলিকান-নিয়ন্ত্রিত সেনেটকে একমত হতে হবে।
উনবিংশ শতাব্দীর পর কখনও এমনটা হয়নি।
অনুমান করা যায়, ডেমোক্র্যাট-নিয়ন্ত্রিত কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদ ভোট বাতিলের চেষ্টা অনুমোদন করবে না।
তাছাড়া রিপাবলিকান কয়েকজন সেনেটরও এভাবে ভোট বাতিলের প্রয়াস জোরালোভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তারা এ চেষ্টার বিপক্ষে ভোট দিলেই জো বাইডেনের জয় নিশ্চিত হয়ে যাবে।
৬ জানুয়ারি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করবেন কংগ্রেসের সেই অধিবেশনে সভাপতি ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স।
কারণ তিনিই সাংবিধানিক দায়িত্ব অনুযায়ী ৫০টি অঙ্গরাজ্য থেকে পাঠানো ইলেকটোরাল ভোটের খামগুলো খুলবেন এবং যোগফল ঘোষণা করবেন।
১৯৬০ সালে রিচার্ড নিক্সন এবং ২০০০ সালে এ্যাল গোর-কে এভাবেই ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি মেনে তাদের নিজেদের পরাজয় এবং প্রতিদ্বন্দ্বীর বিজয়কে প্রত্যয়ন করতে হয়েছিল।
তারা এটা করতে গিয়ে তাদের নিজেদের দলের আইনপ্রণেতাদের আপত্তি অগ্রাহ্য করেছিলেন।
“মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় ভাইস প্রেসিডেন্ট যে ভুমিকা পালন করেন তার প্রতি লোকে এতদিন কোন দৃষ্টি দেয়নি, এটা নিয়ে ভাবেওনি। কিন্তু যেহেতু প্রেসিডেন্ট এখন ডোনাল্ড ট্রাম্প- তাই আপনাকে সব সম্ভাবনার কথা মাথায় রাখতে হবে”- বলছেন গ্রেগরি বি ক্রেইগ – যিনি প্রেসিডেন্ট ওবামার সময় হোয়াইট হাউসের একজন আইনজীবী ছিলেন।
পেন্সের সামনে উভয়-সংকট?
এতদিন ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে মাইক পেন্স একদিনে যেমন ট্রাম্পের বিশ্বস্ত ছিলেন, তেমনি তিনি আইন মেনেও চলেছেন।
নির্বাচনের পর থেকে পেন্স ট্রাম্পকে সাহায্য করার ব্যাপারে মিশ্র বার্তা দিয়ে চলেছেন।
প্রথম দিকে তিনি ভোট জালিয়াতির দাবিগুলো সমর্থন করার জন্য ট্রাম্প সমর্থকদের আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছেন। কিন্তু সম্প্রতি তিনি ব্যাটলগ্রাউন্ড রাজ্যগুলোর ভোট বাতিল করার জন্য টেক্সাসের এ্যাটর্নি জেনারেলের করা মামলার প্রশংসা করেছেন- যদি সে মামলা খারিজ হয়ে গেছে।
সমস্যা হল মাইক পেন্স নিজেই নাকি ২০২৪ সালে রিপাবলিকান পার্টি থেকে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হতে চান।
তার সামনে সংকট: তিনি কি এ নির্বাচনের ফলাফলকে মেনে নিয়ে বাইডেনকে বিজয়ী ঘোষণা করে তার নিজের দলের ভোটারদের বিরাগভাজন হবার ঝুঁকি নেবেন?
নাকি রিপাবলিকানদের বাধ্য করবেন ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে আমেরিকান নির্বাচনী ব্যবস্থাকে একটা সংকটের মধ্যে ফেলে দিতে?
যারা ৬ জানুয়ারির দিকে তাকিয়ে আছেন- তাদের প্রশ্ন সেটাই।
তথ্য-বিবিসি বাংলা।