সেলিনা জাহান প্রিয়ার গল্প: ‘অ-মানব’-(৪৯ তম পর্ব)

 

অ-মানব-৪৯-তম-পর্ব

———————— সেলিনা জাহান প্রিয়া

 

কেনু মিয়া শহর থেকে জাম গাছ দেখাতে মানুষ নিয়ে আসছে। তাদের গাছ খুব পছন্দ। এত বড় জাম গাছ এই এলাকাই নাই। মহাজন বলল ভাই আমি গাছ পছন্দ করেছি কিন্তু আমার গাছে কুড়াল দিয়ে কুব দিতে খুভ ভয় লাগে। এত বড় গাছ। অ-মানব বলল আরে ভাই আপনি যদি না নেন তাহলে বলেন অন্য মহাজন নিয়া আসি।

——– ভাই গাছ নিতে কোন আপত্তি না। তবে ভয় করে। মানুষ জন নানা কথা বলে।
——– অ-মানব বলল আপনে কোন জাতের মানুষ? ধর্ম কি? যে সুন্দর করে পান খান ! বাহ ! দারুন লাগছে।
——— ভাই আমি পাক্কা মুসলিম!
——— আমার মনে হয় না। কি বল কেনু। মুসলমান হলে তো আল্লাহ্‌ ছাড়া কাউকে ভয় পাওয়ার কথা না।
——— ভাই আমি শুনছি এই গাছে আছর আছে।
——— হ বুঝতে পারছি দাম কমানোর ধান্ধা। আমার গাছ আমি কেটে দিব। দাম বলো ?
——— ভাই আপনে কি এত বড় গাছ কাটতে পারবেন।

——— ভাই কি বলেন মানুষ এখন হিমালায় কেটে রাস্তা বানায়। আমি একটা গাছ কাটাতে পারব না।
——– আপনে যদি কেটে দেন তাহলে লাখ টাকা।
——– আচ্ছা তুমি গাছে দড়ি লাগাও। গাছের গুঁড়ির মাটি কেটে দাও। দেখ আমি কেমনে গাছ কেটে দেই।
দুই জন গাছে উঠল আর দুই জন গাছের গুরার মাটি কাটতে লাগলো। অ-মানব গাছের মাহাজন কে বলল তোমারা যাকে ভয় পাওয়ার দরকার তাঁকে ভয় পাওনা। আর যাকে ভয় পাওয়ার কথা না। তাঁর ভয়ে কাপড় নষ্ট করে দাও। তাই তোমাদের মাথায় মানুষ যুগে যুগে লবন রেখে বরই খেয়ে যাচ্ছে।
গাছের মহাজন বলল এই যে তুমি আজ পুরাতন আছ দেখলেই বল ভাই কিনা যাবে না। গাছে আছর আছে, জীন আছে। গাছ কাটলে মুখে রক্ত আসবে। এই গুলো বল। মানুষ ভয় পায়। আর তোমারা সেই ভয় কে কাজে লাগাও। তাই না?
——— মহাজন বলল ভাই এটা যার যার ব্যবসার একটা গোপন কথা। তবে আপনি একটা আজব মানুষ আমি এটা শুনেছি। আপনার সাথে কোন চালাকি করে পারব না। তাই গাছ কিনতে রাজি হয়েছি।

——— তাহলে কি মহাজন আপনে চান আমি গাছে কুব দেই। আমি গাছে কুব দিলে গাছের দাম বিশ হাজার টাকা বারবো। আর আমি কুব না দিলে আপনার দামেই ঠিক থাকব। এখন কোনটা করবো।
———- মহাজন বলল ভাই লজ্জা দিয়েন না। আমি ভাবছি আপনি যদি গাছে কুব না দেন তাহলে আমি পঞ্চাশ হাজার টাকা দাম কমাব। কিন্তু পারলাম না। আপনার কথাই ঠিক রইল। আমার গাছ আমি কাটব। আপনার কোন কষ্ট করতে হবে না। আকিজ বিড়ি টান দিয়ে গাছ কাটতে লাগলো। কেনু মিয়া বলল অ-মানব মামা আপনি একটা জিনিস। কেনু আমার কথা বাদ দাও এই নাও তোমার টাকা। এটা হল তোমার জন্য একটা নতুন রাস্তা ভাল পথে চলার জন্য। দেখ কেনু তোমার জ্ঞান আছে এটা তুমি ভাল কাজে লাগাতে পাড় আবার খারাপ কাজেও লাগাতে পাড়। ভাল কাজের ভাল ফল খারাপ কাজের খারাপ ফল।
অ-মানব মামা আপনি কি মাদ্রসায় পড়েছেন। আপনার সব কথা খুবোই মুল্যবান। আমাদের গ্রামে ওয়াজ করতে যারা আসে তারা ঠিক এমন সুন্দর করে কথা বলে।
কেনু আমি তাদের মতো না। কারন তারা টাকা ছাড়া ওয়াজ করে না। তারা যা বলে তারা তা বিশ্বাস করে না। তাদের ওয়াজ শুনলে রাতেই ভাল লাগে কিন্তু দিনের বেলা যেই সেই হয়ে যায়। আমাদের কথা না বলে কাজ করা দরকার। কি বল? কেনু আকাশ দেখ কেমন লাগেছে।
মামা আজ তো আকাশ ফকফকা। তাই মনে হয় তোমার কেনু। আচ্ছা তারা গাছ কাটুক চল বাজারে যাই।
চেয়ারম্যানের বউ আর ফুলজান বসে রান্না করছে। ফুলজান আজ কাল তাঁর মামী কে কিছু বলার আগেই পেয়ে যায়। মানুষ এত বদলাতে পাড়ে ফুলজান তাবিশ্বাস করে না। কিছু দিন আগেও ফুলজান কে সে দেখতে পারতো না। ফুলজান চুলায় জ্বাল দিতে দিতে বলে মামী একটা কথা বলি।
———- হ্যা ফুলজান বল !
———- মামী আপনার কোন অসুক করেছে?
———- না! ফুলজান আমি ভাল আছি। এই কথা কেন বলছ।
———– না মানে মামী। আগে আপনে আমার সাথে এত কথা বলতেন না। আজ কাল আমার খুব খেয়াল রাখেন।
———- ফুলজান দেখ আমার বিয়ে হয়েছে কত বছর। আল্লাহ্‌ একটা সন্তান দেয় নাই। ধর আর সন্তান না হইল। তখন কি তুই আমাকে মায়ের মতো দেখবি না। পেটে নাই তাতে কি? তুই আমার মেয়ে। ফুলজান মামীর দিকে চেয়ে ঝড় ঝড় করে কেঁদে দিল। মামী তাঁকে জরিয়ে ধরে বলল আরে পাগল কান্না করিস কেন? ফুলজান বলল মামী আজ থেকে আমি তোমাকে মা বলেই ডাকব। আমি সারা জীবন মায়ের আদর পাই নাই। নানি বাড়ি, চাচার বাড়ি, ফুফুর বাড়ি, আমি তো আমার ঠিকানা জানতাম না। আজ আমি আমার ঠিকানা পেয়ে গেছি। আমাকে আর কোন দিন পড় করে দিও না।মা পরম মমতায় ফুলজান কে বুকে টেনে নেয়। চেয়ারম্যানের মা অনেক দিন পড় বলে বউমা তুমি আজ আমার সব দুঃখ দূর করে দিলে আমি মরে গেলেও শান্তি পাব। এই বলে যে আমি এক মেয়ে হারিয়ে আর একটা মেয়ে পেলাম। আমার সব চিন্তা ছিল আমার নাতনী ফুলজান কে নিয়ে আজ আমার চিন্তা দূর হল। চেয়ারম্যানের বউ ফুলজান আর শাশুড়ি তিন জন মিলে কাদতে লাগলো।
অ-মানব বাজারে ডাক্তারের দোকানে বসে একটা নিউজ পেপার পরছিল। ডাক্তার একটা কথা বলি –
———- কি কথা বল?
———- আচ্ছা বাজারে আসলে মানুষ আমাকে এত ভীর করে কেন?
———- সবাই দেখতে আসে। আর তুমি আসলে আমার রুগী ও বারে।
———-কেনু যাও আমার জন্য চাও নিয়ে আসো। বাহ কেনু আমার জন্য দারুন চা বানিয়ে এনেছ। অ-মানব মামা একটা কথা বলি আপনি আসলে মানুষ না।
———— আমি তাহলে কি?
————-আমি একটা বিষয় জেনেছি?
————-কি বিষয়?
———— গেদু মহাজনের মা বলেছে। আপনি নাকি ছোট বেলায় হারিয়ে গিয়েছিলেন আর বাড়ি খুজে পান নাই।
———– দেখ মানুষ চাইলে সব পাড়ে।
———– আচ্ছা অ-মানব মামা আমার মনে এখন চায় আপনে বলতে পারবেন।
———–হ্যা বলতে পাড়ি তবে একটা কথা। আজ থেকে তুমি গাছের ব্যবসা করবা। এক টা গাছ কিনে কাটলে তুমি একটা চুক্তি করবা। যে তিনটা গাছ লাগাবা। জমির মালিক কে বলবা দুটা গাছ আপনার একটা আমার। ১০ বছর পড় সেই গাছ নিতে যাব। তবে যাই করবা লিখিত।
————- অ-মানব মামা জান আমার মনের কথা টা বলেন?
————- ডাক্তার একটা হেসে বলে কি কথা?
————– অ-মানব বলল কেনু তুমি যা চাও। তা কিছুইতেই সম্ভব না।
————- কেন অ-মানব মামা।
————- কারন চেয়ারম্যান তোমার কাছে কোন দিন তাঁর ভাগ্নি বিয়ে দিবে না। চেয়ারম্যান জানে তুমি একটা মিথ্যাবাদী প্রতারক আর ঠকবাজ।
————- আমি ফুলজানের জন্য ভাল হয়ে যাব?
————- কিছু জিনিস আছে মানুষ হারিয়ে খুজে। আর সততা অর্জন করা খুব কঠিন। তবে আজ থেকে ভাল কাজ শুরু কর। হয়ত ভাল কাজের জন্য অনেক সময় মানুষ পুরুস্কার পায়। গাছ লাগাও আর মানুষের সাথে এক নতুন কেনু হয়ে জন্ম নাও। সবাই যেন ভাবে কেনু মানে এমন এক জন যে সত্য মানুষ। আর মানুষের বিপদে পাশে পায় তোমাকে। কেনু তুমি তারাতারি চেয়ারম্যান এর বাড়িতে যাও। অ-মানব কেনু কে চেয়ারম্যানের বাড়িতে পাঠিয়ে ডাক্তার কে বলল।
————–ভাইজান আমাকে ১০০ টাকা দেন অফেরত যোগ্য।
ডাক্তার তাঁকে টাকা দিল। অ-মানব ডাক্তারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে। হাটতে হাটতে চলে আসলো গেদু মিয়ার বাড়িতে। গেদু মিয়ার মা বলল আরে বাজান তুমি।
————- হ্যা খালা মনি বিদায় নিতে এলাম।
————- কোথায় যাবে বাবা?
————- সেই ছোট বেলায় জানতাম না কোথায় যাব আজো ও জানি না।
————- বাবা যে খানেই থাক ভাল থেকে। আমি জানি তুমি আবার চলে যাব। গেদুর মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হাটতে হাটতে অ-মানব চলে যায় আবার রেল স্টেশনের দিকে। একটা ট্রেন আসে অ-মানব উঠে পড়ে সেই ট্রেনে। ট্রেন ছাড়ে।
কেনু বাজারে দৌড়ে আসে ডাক্তার মামা চলেন। চেয়ারম্যান মামার মা মনে হয় নাই। অ-আনব মামা কোথায়?
———- আমি জানি না। মনে হয় আছে কোথাও চেয়ারম্যান চিৎকার করে কাঁদছে। আমার মা নাই। ও ডাক্তার আমার মা নাই।
অ-মানব বলেছিল আজ নিলে হয় না। আমি বললাম কাল। ও ডাক্তার কেন আজ নিলাম না। চেয়ারম্যানের বাড়িতে মানুষ আর মানুষ । সব মানুষের ভিড়ে অ-মানব নাই। কেনু থেকে ডাক্তার কেউ জানে না। আজগর আলি এসে বলে অ-মানবের কাজ শেষ তাই সে চলে গেছে। কিছু মানুষ আসে তারা মানুষকে ভাল কাজের কথা বলে চলে যায়। লাশ মাটি দিয়ে যে যার বাড়িতে চলে গেছে। ফুলজান তাঁর মামিকে বলে নানু আমাকে মা দিয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেল। সন্ধ্যায় বৃষ্টি আর বৃষ্টি। সারা রাত বৃষ্টি। ফজরে মসজিদ থেকে আজান আসছে। চেয়ারম্যানের বউ খুব সকালে বমি করতে লাগলো। চেয়ারম্যান কেনু কে বলল ছাতা নিয়া তারাতারি ডাক্তার কে নিয়ে আয় তোর মামী সে ভোর বেলা থেকে বমি করছে। কেনু ঘুম চোখে বৃষ্টির মাঝেই ডাক্তার কে নিয়ে আসে। ডাক্তার চেয়ারম্যানের বউ চোখ আর পালস দেখে বলে চেয়ারম্যান খুবোই ভাল নিউজ আশা করছি এবার তুমি বাবা হবে।
চেয়ার‍্যানের বউ লজ্জায় অন্য ঘরে চলে যায়। কেনু বলে মামা এখন অ-মানব মামা থাকলে আনন্দে বৃষ্টির মধ্যে নেমে যেত। আমি নেমে যাই। খুশির সংবাদ কেনু বৃষ্টিতে নেমে বলে চিৎকার করে বলে হে আল্লাহ্‌ তুমি আমার মামার মনের আশা পুন্য করেছ তাই আমি আজ থেকে ভাল হয়ে গেলাম। চেয়ারম্যান অবাক হয়ে দেখে কেনু তাঁকে এত সম্মান করে। মনে মনে বলে আজ থেকে তরে আমি ছেলের মতো দেখব। আমার জন্য সে ভাল হবে তাহলে আমি তাঁকে কেন ভালবাসব না।

চলমান ———

অ-মানব-প্রথম পর্ব    অ-মানব-দ্বিতীয় পর্ব    অ-মানব-তৃতীয় পর্ব    অ-মানব-চতুর্থ পর্ব

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!