সেলিনা জাহান প্রিয়ার ঈদের গল্প ।। রাখে আল্লাহ মারে কে!
রাখে আল্লাহ মারে কে !
————————–সেলিনা জাহান প্রিয়া
ইমুর গরু কেনা শেষ। সন্ধ্যা থেকে বৃষ্টি। ছোট বাসা রাস্তা ছাড়া কোরবানি দেয়ার কোন যায়গা নেই। নীচ তলা বাসার জানালার গ্রিলে গরু বেধে রেখেছে। পাশের বাড়িতে একটা গরীব পরিবার থাকে সেই পরিবারের কর্তার নাম ইমান আলি। রাত ১১ টা বাজে। সেই পরিবারের মহিলা হাসপাতালে। টাকার জন্য অপারেশন করাতে পারছে না। মহিলার অবস্থা খুবই খারাপ। অনেক টাকা লাগবে। হাসপাতাল থেকে ফোন আসছে আজ রাতেই অপারেশন করাতে হবে। ইমান আলি আশপাশের সবার কাছে টাকা চাইছে রাতের বেলা কেউ ১০ টাকা ২০ টাকা করে মাত্র দুই হাজার টাকা হয়েছে। এত রাতে আরও ৪০ হাজার টাকা লাগবে। তার পক্ষে এই টাকা যোগার করা সম্ভব না। টাকা ছাড়া স্ত্রী কে বাঁচানো যাবে না।
ইমান আলির ৭ বছরের মেয়ে কান্না করছে। ইমুর ছেলের সাথে মাঝে মাঝে মেয়েটা খেলতে আসে। ইমুর বাসায় ইমুর বউকে ছোট ছোট কাজে সাহায্য করে। বাপের হাত ধরে কাদতে কাদতে মানুষের কাছে টাকা চাচ্ছে। ইমু মেয়েটার কান্না দেখছে বৃষ্টি তার চোখের পানি মুছে নিলেও চোখ থেকে তার কষ্ট মুছে নিতে পারছে না। ইমু ইমান আলি কে বলে টাকা তো যোগার করতে পারলে না কি করবে? বাপ আর মেয়ে কাঁদছে এক সাথে। ইমান আলি বলে সাব এই মহল্লার সব বাসায় চার টা পাঁচটা করে কত গরু বাঁধা কোরবানির জন্য। সবাই এত কুরবানি দিবে আল্লাহর নামে। তারা যদি আমাকে পাঁচশত করে টাকা দিত তাহলেই হইত। আসলে স্যার গরিবের জন্য কেউ কিছু করে না। আমি সব বাড়ি ওয়ালাদের কত কাজ করে দিয়েছি।
কত মানুষের বাড়ি করার সময় তাদের ইটা বালু রড পাহারা দিয়েছি। সবাই বলে ঈদের পড়ে আসো দেখি কিছু করা যায় কিনা। দুঃখ করে এই কথা বলছে আর কাঁদছে। ইমু বলল দেখ আমিও তো ভাড়া থাকি একটা ছোট ফ্ল্যাটে। আমার কাছে হাজার পাঁচেক টাকা আছে গরু কিনার পড়। কিন্তু তোর তো পাচ হাজারে সমস্যা সমাধান হবে না। আমি গরু কিনে ফিলেছি ৭০ হাজার টাকা দিয়ে। তোর জন্য কাউকে যে বলব তাও হচ্ছে না বৃষ্টির জন্য। আচ্ছা ইমান আলি তুই একটু দাড়া আমি আসছি উপর থেকে আর মেয়েটা মাথায় একটা গামছা দে। পড়ে তো মেয়েটাকেও অসুক বানিয়ে ফেলবি। সিঁড়ীর কাছে দাড়া আমি আসছি। ইমু দু তলায় তার ফ্ল্যাটে যায়। ইমুর বউ কে বলে মনি আমাদের বাসায় যে ছোট মেয়েটা আসে তার বাবা কে তো চিন ইমান আলি।
ইমুর বউ বলে খুব ভাল মানুষ মাঝে মাঝে আমার চালের বস্থা বাজার বাসা পর্যন্ত তুলে দেয়। বউটা ও আমার অনেক কাজ করে দেয়। তো কি হয়েছে আমি তো লিস্টে অর নাম রেখেছি। ইমু বলে বউটা হাঁসপাতালে পেটে টিউমার। আজ রাতেই অপারেশান করাতে হবে। রাত পোহালে ঈদ। তারে যা সাহায্য করেছে তা দিয়ে এক প্যাকেট স্যালাইন কিনা যাবে। এত বড় অপারেশন কি ভাবে করবে। মেয়েটা কে নিয়ে এই বৃষ্টির মধ্যে সাহায্য চাচ্ছে। সবাই বলে ঈদের পড়ে দেখবে। আমার কাছে এত টাকা নেই।নাহ! আমি কোরবানি দিব না। গরু টা বেচে ইমান আলি কে টাকা দিয়ে দেই। আমি একটা ছাগল কিনে না হয় দিব। ইমুর বউ বলে মানুষ কি বলবে? ইমু বলে রাখ মানুষের কথা। আমি কি মানুষের জন্য কোরবানি দিচ্ছি না কি? আল্লার জন্য কোরবানি দিচ্ছি।
সেই টাকা তো আল্লাহর মানুষের জন্য বিপদে দান করে দিব। এতে কোন পাপ হলে হউক। ইমুর বউ কোন কথা বলে না। কারন ইমু যা বলে তাই করে। প্যান্ট সার্ট পড়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে দেখে ইমান আলি দাড়িয়ে আছে। ইমু বলে ইমান আলি চল গরুটা বিক্রি করে তোমাকে টাকা দিচ্ছি। কোরবানি জিবনে বেচে থাকলে আরও দিতে পারব। মেয়ে কে বলল মা তুমি বাসায় যাও। চিন্তা কর না। আল্লায় তোমার আম্মু কে ভাল করে দিবে। পাশের বাসার দুই জন বলছে নিয়ত করে কিনে বিক্রি করলে পাপ হবে। ইমু বলল হলে হউক মানুষ আগে। ইমান আলি চল বালুর মাঠে নিয়ে যাই গরু। গরুটা নিয়ে ইমান আলি আর ইমু সাহেব গরুর হাটের কাছে আসতেই শুনে হাটে গরু খুবোই কম। হাটে যাবার একটু আগেই বলল একজন ভাই গরু কি করবেন। ইমান আলি বলল ভাই বিক্রি করব। লোকটা বলল কত দাম বলেন। ইমু বলল ইমান আলি তুই দাম কর। আমার ৭০ হাজারে কিনা।
ইমান আলি বলল ভাই গরু নিতে চাইলে এক দাম দেড় লাখ। আরও দুই তিন জন চলে আসছে। একজন বলল এক লাখ দেই। ইমান আলি বলল না ভাই দেড় লাখ। আরেক জন বলল এক লাখ বিশ হাজার দেই। আরেক লোক গাড়ি থেকে নেমে বলে ভাই দাম কত। ইমান আলি বলল এক দাম দেড় লাখ। লোকটা গাড়ি থেকে তিনটা ৫০০ টাকার ভানডেল দিয়ে বলল নাও ভাই। গরু দাও। টাকা গুলো নিয়ে ইমান আলি ইমু সাহেবের হাতে দিল। গরু দিয়ে দিল গাড়ি ওয়ালা সাহেব কে। ইমু বলল রাত মাত্র দুই টা বাজে। আগে তোর হাসপাতালে যাই। ইমান আলি কে নিয়ে মালিবাগ হাসপাতালে গেল। ইমান আলি কে ৫০ হাজার টাকা দিয়ে বলল জমা দেও। ডাক্তার বলল তোমার শুধু মেডিসিনের টাকা জমা দাও। তোমার বউয়ের কাছ থেকে শুনেছি। তুমি গরীব মানুষ। হাসপাতালের বিল মাপ। ইমু বলল ইমান আলি আল্লার রহমত। মাত্র ১৭ হাজার টাকা লাগলো।
রাত তিনটায় অপারেশন হল। ইমান আলি কাদতে কাদতে বলল স্যার এই জিবনে আপনার মতো মানুষ আমি দেখি নাই। আপনার মতো মানুষ আছে বলেই আল্লার এই সুন্দর দুনিয়া টিকে আছে। হাসপাতালের রিসিপসনে বসে টেলিভিশন দেখছে ইমু সাহেব আর ইমান আলি। টেলিভিশনের খবরে দেখাচ্ছে শত শত গরুর ট্রাক রাজধানীতে। কিন্তু ক্রেতা নাই বললেই চলে। কোন কোন চ্যানেল বলছে ছাগলের দামে গরু। ইমু বলল চল ইমান আলি আরাম বাগ হাটে। ৫০ হাজারের বাকি টাকা তুই রাখ। আমার সাথে চল। মতিঝিল আরাম বাগ গরুর হাটে এসে দেখে হাজার হাজার গরু কিন্তু মানুষ খুবোই কম। বৃষ্টি পড়ছে টিপ টিপ। ভোর পাঁচটা বাজে তখন। বৃষ্টি আসতে আসতে বাড়ছে। ইমান আলি বলে স্যার এই দুটা ৮০ হাজার বলেছি।
ইমু বলে দুইটা ৮০ হাজার দিবে। গরু বিক্রেতা বলল স্যার ৯০ হলে নিয়ে যান। ইমু বলল নিয়ে নে ইমান আলি আল্লাহ দিছে। একটা গাড়িতে তুলে দুই গরু নিয়ে মহল্লায়। ইমান আলি সেই জানালায় গরু বাঁধল। ইমু ঘরে প্রবেশ করে দেখে বউয়ের মন খারাপ। ইমু একটা হাসি দিয়ে বলে আমার সাথে নিচে আসো। দুইটা গরু কিনেছি। বউকে রাতের সব কথা বলে। বউ বলে আমি গরু দেখছি তুমি আর ইমান আলি গিয়ে গোসল করে নামজের জন্য রেডি হও। ইমুর বউ বলে গরু গুলো তো মাসআল্লাহ অনেক বড়। তুমি কিন্তু নিজের হাতে জবাই দিবা। রাতে ইমুর বউ কোরবানির গরুর কলিজা ভুনা করে ইমান আলির বউকে দেখতে যায়। ইমান আলির মা শাশুড়ি মেয়ে সবাই ইমুর বউকে ধরে খুশিতে কাদতে থাকে। ইমুর বউ বলে আজ আমি বুঝতে পেরেছি মানবতার চেয়ে বড় কোন ধর্ম নেই। ইসলামই হল একমাত্র সেই মানবতার ধর্ম। আমি আজ বুঝতে পেরেছি বলে মনিও চোখের পানি মুছে।।