খামার করে কোটি কোটি টাকা আয় করা সম্ভব
পাখিদের মূলত দু’ভাগে ভাগ করা যায়। একটি ওয়াইল্ড বার্ড (বন্য প্রাণী), অন্যটি কেসবার্ড বা খাঁচার পাখি। ওয়াইল্ড বার্ড বা বন্য পাখি পালন করা/ধরা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। অপরদিকে কেসবার্ড বা খাঁচার পাখি হচ্ছে খাঁচায় পালন করার জন্য। এসব পাখি জন্মজন্মান্ত থেকে তারা খাঁচায় বসবাস করছে। খাঁচায় এসব পাখি নিরাপদবোধ করে। স্বাচ্ছন্দ্যে বাস করে। কিন্তু বন্য পাখিকে যদি খাঁচায় বন্দি করা হয় তাহলে পাখি খাঁচায় ছটফট করবে, আর তা আইনত অপরাধ।
শখে যারা পাখি পালন করেন তারা সাধারণত কেসবার্ড বা খাঁচার পাখি পালন করেন। খাঁচার পাখিগুলো আমাদের দেশি পাখি নয় এগুলো বিদেশ থেকে আমদানি করা। আমাদের আবহাওয়ায় খাঁচার পাখি স্বাচ্ছন্দবোধ করে, তাই পাখিপ্রেমিকদের কাছে খাঁচার পাখি আজ জনপ্রিয়।
‘আমাদের দেশের অনেকের বদ্ধমূল ধারণা যে খাঁচার পাখি কেসবার্ডগুলোকে ছেড়ে দেয়া যায়। আর ওই পাখিদের খাঁচায় বদ্ধ রাখা অন্যায়। আসলে তা ঠিক নয়। কারণ কেসবার্ডগুলোকে প্রকৃতিতে ছেড়ে দিলে অন্যান্য পাখি এদের মেরে ফেলবে। আর কেসবার্ড পালন করলে এতে আইনের কোন বাধা নেই। এমনকি এই কেসবার্ড প্রকল্প নিয়ে পাখি রফতানিও করা যায়।
সরকারের সহায়তা পেলে বছরে শতকোটি টাকার পাখি রফতানি করা সম্ভব। হতে পারে হাজার হাজার বেকারের কর্মসংস্থান। আগে যেসব পাখি বিদেশ থেকে কিনে এনে বিক্রি করা হতো সেসব দুর্লভ প্রজাতির পাখি এখন এ দেশেই জন্ম নিচ্ছে। ব্যবসায়ীরা বাণিজ্যিকভাবে পুষছে নিজস্ব খামারে। রাজধানীর কাঁটাবনে প্রতিদিন কমপক্ষে দুই লাখ টাকার পাখি বিক্রি হয়। এখানে পাওয়া যায় দেশি-বিদেশী প্রায় দুইশ’ প্রজাতির পাখি। বাংলাদেশের পাখির দাম কম হওয়ায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রচুর পরিমাণে চাহিদা রয়েছে। কিন্তু পাখি রফতানির জন্য সরকারি অনুমোদন না থাকায় বৈধভাবে পাখি রপ্তানি করা যায় না।
রাজধানীর কাঁটাবনে ১৮টি দোকানে পাখি বিক্রি হয়। শখ করে বাসায় পোষার জন্য পাখি প্রেমিকরা দুর্লভ প্রজাতির পাখি কিনতে আসেন এখানে। ব্যবসায়ীদের কাছে সারা বছরই ৭০ লাখ থেকে এক কোটি টাকার পাখি থাকে। দোকানে বিক্রি ছাড়াও ঢাকার বাইরেও পাঠানো হয়।
একশ’ টাকা থেকে শুরু করে এক লাখ টাকার পাখি পাওয়া যায় এখানে। লাভ বার্ড দুই থেকে তিন হাজার, বাজুরিয়া পাঁচশ, হল্যান্ডের ঘুঘু এক হাজার, ইন্ডিয়ান ককাটেল বা কাকাতোয়া তিন হাজার থেকে এক লাখ। কয়েক প্রজাতির কবুতরের মধ্যে লক্ষাই ও শিরাজি দুই হাজার, কিং চার থেকে ১২ হাজার, ব্লু স্টেচার ৪০ হাজার, দেশি টিয়া একশ আর বিদেশি হলুদ, নীল এবং লাল টিয়ার দাম ২৫ থেকে ৩৫ হাজার টাকা। কালিম চার হাজার, তার্কি ময়ূর আট হাজার।
আবার দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ব্যবসায়ীরা পাইকারিভাবে পাখি কিনে নিয়ে যায় এখান থেকে। বৈধভাবে অনুমোদন না থাকায় বিদেশীরা এখান থেকে পাখি কিনে অবৈধভাবে পাঠায় ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কায়। সরকারি অনুমোদন পেলে কুয়েত, লিবিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে প্রচুর পরিমাণে পাখি রপ্তানি করা সম্ভব হবে।
গত জুলাই মাসের ২ তারিখে ঢাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে উড়াল দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসের (পিআইএ) একটি বিমান। এমন সময় গোপন সূত্রে বিমানবন্দরের শুল্ক কর্মকর্তারা খবর পেলেন এই বিমানে করেই বাংলাদেশ থেকে বিপুল সংখ্যক পাখি অবৈধভাবে পাচার করা হচ্ছে পাকিস্তানে।
দেখা গেল গোপন সংবাদ সঠিক। বিমানের পেছনে মালামাল রাখার জায়গায় পাওয়া গেল বিশেষ ধরনের চারটি ঝুড়ি। এই ঝুড়িগুলোতে করেই বাংলাদেশ থেকে পাচার হচ্ছিল সহগ্রাধিক পাখি।
বলাবাহুল্য, কেসবার্ড রফতানি প্রসঙ্গে সরকারকে সঙ্গতকারণেই নমনীয় হতে হবে। কেসবার্ড রফতানির অনুমোদন দিয়ে শত শত কোটি টাকার রফতানি আয়ের পথ খুলে দিতে হবে।
আদিমকাল থেকে মানুষ নিজেদের খাদ্য তালিকায় পাখির ডিম ও গোশতের সংযোজন করে আসছে। রসনা তৃপ্তির পাশাপাশি সৌন্দর্য পিয়াসী মানুষ নানা জাতের পাখিও সেই আদিকাল থেকে পালন করে থাকে। পাখি পালনের সাথে সাথে মানুষ অর্থনৈতিক দিক থেকেও উপকৃত হতে থাকে।
বর্তমানে লেয়ার, ব্রয়লার ও হাঁসের খামার সকলের নিকট পরিচিত। পোল্ট্রি বলতে অনেকেই শুধু মুরগিকে বোঝেন, আসলে কিন্তু তা ঠিক নয়। বাণিজ্যিক না হলেও পারিবারিক বা শখের বশে আমাদের দেশে কবুতর, তিতির, রাজহাঁস, মাসকোভী হাঁস ও কোয়েল পালিত হয়ে থাকে। কিন্তু ময়ূর একটি লাভজনক পেশা হওয়া সত্ত্বেও আমাদের দেশে এ পাখিটিকে চিড়িয়াখানা ছাড়া অন্য কোথাও পালন করতে দেয়া যায় না। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ময়ূর বাণিজ্যিকভাবে পালন করা লাভজনক এবং গ্রামে-গঞ্জেও পালন করা যেতে পারে। এতে কর্মসংস্থান বাড়বে, বাড়বে আয়-রোজগারের পথ এবং উন্নতি হবে দেশ ও দশের।
উদাহরণত বলা যায়, যশোরের অভয়নগর উপজেলার প্রেমবাগ গ্রামের মতিয়ার রহমান কোয়েল খামার করে এখন স্বাবলম্বী। মতিয়ারের খামারে সব মিলিয়ে কোয়েল আছে তিন হাজার। এর মধ্যে প্যারেন্টস কোয়েল আছে আড়াই হাজার। এগুলো প্রতিদিন গড়ে এক হাজার ৮০০ ডিম দেয়। কয়েক মাস আগে মতিয়ার ৫০ হাজার টাকায় একটি ডিম ফোটানোর যন্ত্র (ইনকিউবেটর) কিনেছেন। প্রতি মাসে ১৫ হাজার বাচ্চা ফোটান তিনি।
একদিনের বাচ্চা ছয় টাকা দরে এবং প্রতিটি ডিম এক টাকা ৩০ পয়সা দরে বিক্রি করেন। ১৫০ গ্রাম ওজনের একটি কোয়েল পাখি ১৯ টাকায় বিক্রি হয়। একজন কর্মচারী তার কোয়েল পাখির খামার দেখাশোনা করেন। কর্মচারীর বেতন, কোয়েলের খাবার, ওষুধ, বিদ্যুৎ বিল সব মিলিয়ে মাসে ৪০ হাজার টাকা খরচ হয়। এর পরও মাসে ৩৫-৪০ হাজার টাকা লাভ থাকে তার।
মতিয়ারের কোয়েলের খামার দেখে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন অনেক বেকার যুবক। অথচ এই মতিয়ারের নুন আনতে পানতা ফুরাতো। কাজেই বিভিন্ন প্রকার পাখির খামার এদেশে অতি লাভজনক হতে পারে।
এমনকি বাংলাদেশের আবহাওয়া ময়ূর লালন-পালনেরও উপযোগী। কিন্তু বর্তমানে তা শুধুমাত্র চিড়িয়াখানা ও বিত্তবানদের পাখি হিসেবে পরিচিতি লাভ করছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এ পাখিটি গ্রামের হত-দরিদ্র মানুষ থেকে অনেক পরিবারই স্বাচ্ছন্দ্যে লালন-পালন করতে পারেন।
রাজহাঁস পালন করেও বাড়তি আয় করা সম্ভব। নানারকম সুবিধাও আছে। যেমন- রাজহাঁসের গোশত ও ডিম দুই-ই সুস্বাদু। রাজহাঁসের পালক দিয়ে লেখা, তোষক, বালিশ, তাকিয়া, কুশন ও হেলান দেয়ার নরম জিনিসপত্র তৈরি করা যায়। ডিম ও রাজহাঁস বিক্রি করে বাড়তি আয়ও করা যাবে। রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন পাখিও এ রাজহাঁস। পোকামাকড় খেয়ে এরা জায়গাজমি ও বাড়ির আশপাশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখে।
সূত্র : আমরা সবাই কৃষক