প্রেমিকের কলিজা মাপতে খুন

 

 

অনলাইন ডেস্ক । কাগজটোয়েন্টিফোরবিডিডটকম

তালা ভাঙ্গার চেষ্টা করছে পুলিশ। তাদের ঘিরে উৎসুক মানুষের ভীড়। এক পর্যায়ে তালাটি ভেঙ্গে যায়। দরজাটি ধাক্কা দিতেই ভেতর থেকে তীব্র গন্ধের ঝাপটা আসে বাইরে। পচা গন্ধে নাড়ি ভুড়ি উল্টে যাবার জোগাড় পুলিশের। রুমালে নাক চেপে ভেতরে প্রবেশ করে পুলিশ কর্মকর্তা। গন্ধ তীব্র থেকে তীব্র হচ্ছে। একটু ভিতরে ঢুকতেই পুলিশ কর্মকর্তার চোখ পড়ে খাটের ওপর। সঙ্গে সঙ্গেই চোখ ঘুরিয়ে নেন তিনি।

বীভৎস! এটা কি মানুষের কাজ! এভাবে কেউ কাউকে মারতে পারে? তাকানোই যাচ্ছে না। বিড় বিড় করছেন পুলিশের এই কর্মকর্তা। তার পেছনে আরো কয়েকজন পুলিশ। তারা কিছুদূর এসে থেমে গেছে। গন্ধ আর বিভৎসতায় কাছাকাছি আসছেন না তারা। পুলিশ কর্মকর্তা মাস্ক পড়ে লাশের সামনে যান। লাশ যতই বীভৎস হোক না কেনো, সুরতহাল রিপোর্ট তাকেই করতে হবে। পচা বা গলা-যাইহোক না কেনো উল্টে পাল্টে দেখতে হবে মৃতদেহ। তাদের তো এভাবেই গড়ে তোলা হয়েছে।

ভাবছিলেন পুলিশের ওই কর্মকর্তা। মৃতদেহ ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করেন তিনি। যুবকটিকে জবাই করা হয়েছে। বুকের বাম পাশ বড় ধরণের কাটার দাগ। মৃতদেহের পাশে পড়ে আছে কলিজা। সেটিও দু’ভাগ করা! শুকিয়ে আছে রক্ত। চটচট করছে বিছানা।

পুলিশ কর্মকর্তাকে সহায়তা করতে রুমের ভেতরে ঢুকেছে এক কনস্টেবল। আমার চাকরি জীবনে এমন মৃতদেহ দেখিনি। খুনের পর কেউ কলিজা বের করে আনে, আমার জানা ছিলো না। আর এমন বিভ্যৎস লাশও আগে চোখে পড়েনি। কর্মকর্তাটি বলছিলেন কনস্টেবলকে। পুলিশের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরী করতে সকাল থেকে দুপুর লাগলো পুলিশের। এরপর রুমের চারপাশ দেখে নিলেন। খুনের যোগসূত্র খুঁজতে থাকেন পুলিশের এই কর্মকর্তা। কোমল পানীয়র একটি খালি বোতল, আর রক্ত মাখা একটি চাপাতি খুঁজে পায় পুলিশ। কিন্তু খুনি সনাক্তে তেমন কোনো সূত্র তার চোখে পড়ে না।

এ ঘটনাটি খুলনার। নগরীর জোড়াগেট আবাসিক এলাকার এসডি কলোনীর একটি ভবনের নিচ তলা থেকে পচে যাওয়া লাশটি উদ্ধার করে পুলিশ। তার নাম ইমদাদুল হক শিপন। খানজাহান আলী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মহাবিদ্যালয়ের মেডিকেল ইনস্টিটিউটের প্যাথলজি বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র ছিলেন শিপন। ২০১৪ সালের ৯ মার্চ লাশটি উদ্ধার করে পুলিশ। ওই বাসাটি ছিলো শিপনের মামা গণপূর্ত বিভাগের কর্মকর্তা আবু বক্করের। শিপন সেখানেই থাকতো। আবু বক্কর পরিবার নিয়ে গ্রামের বাড়িতে যান ৬ মার্চ। শিপনের লাশ উদ্ধার হয় ৯ মার্চ। এ ঘটনায় শিপনের ভাই বাদি হয়ে সোনাডাঙ্গা থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলা নং ৭। তাতে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামী করা হয়।

শিপন হত্যা মামলার তদন্ত শুরু করে পুলিশ। পুলিশের এসআই শওকত হোসেন খুনের এই ঘটনাটি তদন্ত করতে যেয়ে কোনো কুল কিনারা খুঁজে পাননা। তবে তিনি এটা নিশ্চিত যে, খুনটি কোনো সাধারণ মাপের খুনির কাজ নয়। পেশাদার খুনির কাজ। কিন্তু কলিজা বের করে আনার বিষয়টি নিয়েই পুলিশ ভাবছে বেশি। পেশাদার খুনির ধারণাটি সেখানে পাল্টে যাচ্ছে। কারণ পেশাদার খুনিদের কাজ খুন করা। কলিজা কেনো বের করা হবে! এমন নানা প্রশ্ন ঘুরপাক পুলিশের মধ্যে।

পুলিশ কর্মকর্তা তদন্ত করতে যেয়ে জানতে পারে ওই ভবনে এক তরুনির প্রবেশ করেছিলো। যা স্থানীয় ২/১জন দেখেছেন। পুলিশ সেই লোকজনদের জিজ্ঞাসাবাদ করে মেয়েটির নাম পরিচয় জানতে পারে। তাকে ধরতে প্রথমে পুলিশ গ্রেফতার করে অনিত নামে এক যুবককে। অনিকের মাধ্যমেই ধরা পরে সোনালী নামের এক তরুনি। পুলিশের জেরার মুখে পড়ে সোনালী। এক পর্যায়ে পুলিশের সেই সোনালী সব ফাঁস করে। স্বীকার করে নেয়, খুনের দায়। পুলিশ জানতে পারে, পেশাদার খুনি নয়, খুন করেছে শিপনের প্রেমিকা।

তদন্ত সূত্র জানায়, সোনাডাঙ্গা থানার গণপূর্ত বিভাগের আবাসিক কলোনিতে মামা আবু বক্করের বাসায় থেকে নগরীর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মহাবিদ্যালয়ের মেডিকেল ইন্সটিটিউ বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র হিসেবে লেখাপড়া করতেন শিপন। পাশাপাশি সে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে লিফট অপারেটরের দায়িত্ব পালন করতেন। ২০১৩ সালে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সোনালীর সঙ্গে শিপনের পরিচয় এবং প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয়।

সোনালী পুলিশকে বলে, শিপনকে ভালোবাসতাম অনেক। এক সময় জানতে পারি এবং শিপনের ল্যাপটপে দেখতে পাই তার সাথে আরো ৪/৫ জন মেয়ের দৈহিক সম্পর্ক। এ ঘটনায় আমি দারুণভাবে ক্ষুব্ধ হই এবং শিপনকে হত্যার পরিকল্পনা আঁটি। ওর কলিজা কত বড় হয়েছে, তা দেখতে চাই।

সোনালী বলে যায়, শিপনের মামা মাগুরায় গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যান। ওই সুযোগে আমি ৮ মার্চ শিপনের বাসায় যাই। যাওয়ার সময় ২০টি ঘুমের বড়ি গুঁড়ো করে কোমল পানীয়র সাথে মেশাই। সেটা হাতে করে নিয়ে যাই। রাতেই শিপনকে খাইয়ে দেই। শিপন অচেতন হয়ে পড়ে। তার হাত-পা বেঁধে ফেলি। প্রথমে গলা কাটি। হত্যার পর শিপনের বুক কেটে কলিজা বের করি দেখি। কিন্তু তেমন কোনো বড় নয় বলে, ওটাও দুভাগ করি। তা লাশের পাশে ফেলে রেখে ল্যাপটপ ও মোবাইল নিয়ে পালিয়ে যাই। এসব পুরো ঘটনা আদালতে স্বীকারোক্তিতেও বলেছে সোনালী।

বিচারিক আদালত সাক্ষ্য বিশ্লেষণ করে আদালত সোনালীকে রশিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের নির্দেশ দিয়েছেন। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় মেহেদী হাসান অনিককে বেকসুর খালাস প্রদান করা হয়। গত বছর ২৮ মার্চ এ রায় ঘোষণা করা হয়েছে।

সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!