অ-মানব ও এক বিন্দু রহস্য

অ-মানব ও এক বিন্দু রহস্য ( দ্বিতীয় পর্ব )
– সেলিনা জাহান প্রিয়া

মসজিদ থেকে আযান ভেসে আসছে । আযানের আগে মোরগ গুলো বেশ সুন্দর করে ডেকে উঠে । ফাঁড়ীতে ফিরে দারগা সাবের মন খারাপ । ফাঁড়ী থেকে কিছু দুরেই তার বাসা । বছর দুকেক হল এই ফাঁড়ীতে বদলী হয়ে এসেছে । শেষ রাতে শীত খুব বেশী পরে । পোশাক বদল করে যখন দারগা সাব ঘুমাতে যাবে ঠিক এমন সময় আলম পুলিশ এসে বলল
স্যার আমার খুব ভয় ভয় লাগছে । কোন দোয়া পড়লে ভয় যাবে একটু যদি বলতেন, তাহলে সেই দোয়া পড়ে ঘুমাতে যেতাম । দারগা একটু রাগ করে বলল যান তো আলম মিয়া আমাকে বিরক্ত করবেন না। আলম মিয়া বলল- সাব আপনি যে বাজী ধরে হেসে গেছেন সেই বিষয় নিয়ে চিন্তায় আছেন মনে হয় । স্যার একটা কথা বলি আমি কিন্তু সেই বিষয়ে ভয়ে নাই কারন বাজী আমি ধরি নাই । আমি ভয়ে আছি আপনাকে নিয়ে ।
-দারগা বলল আমাকে নিয়ে ভয় কেন ?
আলম পুলিশ বলল স্যার আপনি তো মাঝে মাঝে কথা দিয়ে কথা রাখেন না । তাই যদি কোন দোয়া শিখিয়ে দিতেন তাহলে সেই দোয়া পড়ে কথা না রাখার ভয়টা যেন না হয় – সেই দোয়া করতাম । আলম মিয়া আপনি এখন এই খান থেকে যান । আমার কাছে ঘ্যান ঘ্যান করবেন না ।
আপনার সাথে যেই দিন কোন কাজে যাই কোন না কোন ভেজালে পরি ।
আলম মিয়া একটা হাসি দিয়ে বলল স্যার ঠিক বলেছেন । তাই তো এই জীবনে কিছুই করতে পারলাম না। পুলিশের চাকুরী করে মানুষ কত জমি জামা কিনে আর আমি আমার ভাঙা সাইকেল টা বদলাতে পারলাম না। তবে স্যার আমি নিতিবান মানুষ তাই লোক জন সম্মান করে । তাই লোকে বলে আলম পুলিশ মানুষ না ফেরেশতা । দারগা এবার বলল আপনি যদি ফেরেস্তাই হবেন তাহলে জীন ভুত তো চেনার কথা । আলম বলল স্যার আপনি সিগারেটের আগুন না চাইলে কিন্তু কোন সমস্যা ছিল না। আগুন চাইয়া একটা ঝামেলায় পড়ছেন । আর লোকটা কিন্তু স্যার খুবেই চমৎকার । কুকুর গুলো তার চার পাশে কি শান্ত ভাবে বসা । আমাদের পুলিশ কে স্যার এক মাত্র রাস্তার কুকুর আর পাগল ভয় কম পায় । তাই মনে হয় লোকটা পাগল । পাগলের কোন কথা রাখতে হবে না। আপনি স্যার নাকে তেল দিয়ে ঘুমান । এমন সময় ফাঁড়ীর মধ্যে থাকা কুকুর ঘেউ ঘেউ করে উঠল । আলম বলল স্যার আমার খুব রহস্য লাগছে । জসুদল রেল স্টেশনে কুকুর কি আবার ফাঁড়ীর সামনে চলে আসলো । আবার কুকুর ঘেউ ঘেউ করে উঠল । দারগা বলল আলম আপনি এখন যান আপনার বিছানায় । দয়া করে একটু ঘুমান গিয়ে । আমার আবার ১১ টায় একটা মামলার তদন্তে যেতে হবে । আলম সাব গাঁয়ের চাদর ঠিক করে নিজ কামরার দিকে চুপ করে একটা রহস্য ময় হাদি দিয়ে চলে যায় । সাথের দুই পুলিশ
একজন সোহাগ । তিনি আবার কোন এক পীরের মুরিদ । সোহাগ আলম সাহেবর ঘুমানোর চোকি পাশাপাশি ।
সোহাগ বলল আলম ভাই একটা কথা বলি । আলম বলল সোহাগ ভাই রাতের পাগলের কথা বললে আমি কিন্তু ভয় পাবো । সোহাগ বলল আরে ভাই ভয়ের মতো তো কারন বটে । লোকটা কি ভাবে দারগা সাব কে কথা জালে আটকে দিল । আর আমি তাজ্জব হয়ে গেলাম এই শীতের মধ্য কুকুর কি করে পানিতে নেমে গেল । আমার মনে হয় সে কোন অলি হবে । আমাদের মতো সাধারন মানুষের কথা কুকুরের শুনার কথা না। তাছাড়া কুকুর কে মেরেও পানিতে নামানো সম্ভব না। লোকটা বলল আর নেমে গেল । মনে হয় সে কোন অলি ।
দারগা সাবের কোন একটা সমস্যা ছলছিল কিন্তু । গত মাসে তিনি গন গন বাড়িতে গেছে । কি সমস্যা কাউকে বলে নাই । রাতের অলি বাবা সেই অ-মানবের জন্য পানির মতো পরিষ্কার হয়ে গেছি । আলম সাব বলল ভাই যদি কথা না রাখে কোন সমস্যা হবে কি ? সোহাগ হেসে বলল রাতের বিষয়টা চিন্তা করলে এটার কোন সাধারন বিষয় পাই না । কি তাজ্জব ব্যাপার আমাদের পুলিশের হাতে আগুন ধরিয়ে কি সুন্দর সে শীত নিবারন করলো ।
আলম সাব একটু ঘুমান শীতের রাত আবার কখন কোন ওয়্যারলেস ম্যাসেজ আসে তার চেয়ে একটু ঘুমিয়ে নেন – আর আমিও একটু ঘুমাই । এই দেশে পুলিশ হল একমাত্র ২৪ ঘণ্টার লাইসেস প্রাপ্ত কাজের কাজের লোক । সবাই আট ঘণ্টা পড়ে কাজ শেষ করে কিন্তু পুলিশ ২৪ কাজ করতে হয় । আলম সাব বলল সোহাগ ভাই কোন দোয়া জানেন যদি- তাহলে আমাকে পড়ে একটা ফু দেন আমি কিন্তু খুব ভয় পেয়েছি । সেই অ-মানবের চেহারাটা আমার সামনে ভাসছে । সোহাগ বলল আল্লার নামে ঘুমিয়ে যান লেপ মুরা দিয়ে ।।

দারগার সাবের নাম নিজাম খুবেই কঠিন মনের মানুষ ।তার একমাত্র মেয়ে বিন্দু । তার পর আর কোন ছেলে মেয়ে হয় নাই । স্ত্রীর নাম রেখা । তবে রেখা তার আসল নাম না । দারগা সাব এক সময় ভারতীয় নায়িকা রেখার খুব ভক্ত ছিল । রেখার ছবি দেখার জন্য সে তখন একটা ভি সি পি সেট কিনেছিল । যত মেয়ে বিয়ের জন্য দেখতে যেত , মনে মনে রেখার মতো মেয়ে খুঁজে বেড়াত । নরসিংদী বদলী হলে সে রেখার মতো একটা মেয়ে পেয়ে যায় । তার পর একটা মামলা তদন্ত করতে যেয়ে তার পরিবার কে বিয়ের প্রস্তাব দেয় । নিজাম সাব জানতে পারে মেয়ের নাম নাছিমা খাতুন ।
বিয়ের পড়ে সখ করে সেই নাছিমা খাতুন কে রেখা বলে ডাকে । ধীরে ধীরে সেই নাছিমা খাতুন থেকে সবার কাছে রেখা ভাবী হয়ে গেছে । দারগা সাব আর যাই করুক রেখা কে মনের মতো ভাল বাসে ।
একমাত্র মেয়ে বিন্দু এখন মামার বাড়িতে । এস এস সি পাশ করার পর জানলো যে মেয়ে একটা ছেলের সাথে মাঝে মাধ্যে কথা বলে । পুলিশের চোখ তাই বাপ আগেই মেয়ে কে নিরাপদ ভেবে মামার দেশে কলেজে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে । দারগা সাব ঘুম থেকে উঠে দেখে বেলা বারটা । ফাঁড়ীর কি কি কাজ সব ঠিক করে দিয়ে বলল আজ রাতে যেন কেউ রেল স্টেশনে না যায় । মনে মনে ভাবল আজ দারগা সাব একা যাবে । লোকটা মনে হয় কোন কারনে তাকে কোন যাদু করেছে । যেই ছেলে তার মেয়ের সাথে প্রেম করার জন্য ধুলাই দিয়েছিল তার কিছু হতে পারে । আর কুকুর টা মনে হয় ঐ অ-মানবের পূষা কুকুর । অন্য সব কুকুর কিন্তু চুপ করে ছিল । কোন ভাবে ঐ মানুষটা কে ভয় পেলে চলবে না। আর রাস্তার একটা পাগলের কথা শুনে তো যার তার সাথে মেয়ে বিয়ে দেয়া যায় না। আজ থানা থেকে অন্য চার জন পুলিশ নিয়ে আসব আর তাঁদের নিয়ে যাব । মনে মনে মহা পরিকল্পনা করে মটর সাইকেল নিয়ে বাসার উদ্দেস্য বের হয়ে গেল । আলম আর সোহাগ তখন ঘুমাচ্ছে । দারগা সাব কোন কাজে বাসায় গেলে সব সময় পোশাক পড়ে যায় । যাতে মানুষ জন দেখে বুঝে এই খানে একজন পুলিশ থাকে । কোন এলাকায় পুলিশ ভাড়া থাকা মানেই সেই এলাকায় সবাই তাকে চিনে । দুই বছর যাবত যে বাড়িতে ভাড়া আছে আজ কাল সবাই এই বাড়িকে দারগা বাড়ি বলে চিনে । দারগার স্ত্রী রেখা বেগম কে এলাকায় সবাই ভাই বলে জানে । রেখা বেগম আবার দিলিপ জর্দা দিয়ে পান খায় । এলাকায় একটা দোকানে মাত্র দিলিপ জর্দা পাওয়া যায় । বাসায় পানের সাথে জর্দা শেষ হয়েছে গত কাল । রেখা আসার সময় স্বামীকে বলেছিল যেন জর্দা নিয়ে আসে । পান দোকানে মটর সাইকেল নিয়ে দাড়াতেই দোকান দার রতন মিয়া বলল স্যার কি নাইট ডিউটি করেছেন ।
—– হ্যা রতন । কি করে বুঝলা !
—– সাব আপনার চোখ দেখে । মনে হয় ঘুম কম হয়েছে ।
—– হ্যা একদম ঘুম হয় নাই , জর্দা হতে নিতেই রতন বলল
—— সাব একটা লোক আপনার বাসা খুঁজতে আসছিল । লোকটা কেমন জানি অদ্ভুত ধরনের , সাথে তিনটা কুকুর । খুব দামি জামা কাপড় , মুখে দাড়ি , চুল গুলো লম্বা গাঁয়ের রঙ ফর্সা ,
——- বল কি কখন আসছিল ?
——- রতন মিয়া হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল – তা সকাল নয়টা দিকে ।
——– তা আমার বাসা দেখিয়ে দিয়েছে কে ?
——– স্যার না দেখিয়ে কি উপায় আছে । আপনে হলেন আমাদের এলার দারগা সাব । আপনার সম্মানে আমি নিজেই নিয়ে গেছি আপনার বাড়ি পর্যন্ত । স্যার লোকটা আমাকে একটা দারুন জিনিস
শিখাইছে।
——– কি শিখাইছে ?
——– আজকে দেখেন স্যার সব পান খুবেই তাজা ।
——– আমাকে বলল একটু চিনি পানিতে মিশিয়ে নিলে পান গুলো খুব সুন্দর থাকবে । আর সহজে পচবে না। আমি আজ পানির সাথে প্রথম চিনি মিশিয়ে পানে দিচ্ছি । পান গুলো খুবেই তাজা দেখাচ্ছে ।
দারগা বলল তুমিও ঐ পাগলের কথা বিশ্বাস করেছ রতন ।
———– স্যার বিশ্বাস না করে কি উপায় আছে । আমাকে বলল ভালবাসা আর ক্ষমার নাম প্রেম ।
যে ভালবাসতে জানে সেই ক্ষমাশীল । আমার বউয়ের সাথে একটা বিষয় নিয়ে আমি খুব রেগে ছিলাম ঐ লোকটার কথা শুনে বউকে বাসায় গিয়ে বললাম দেখ আমি তোমাকে ভালবাসি তাই আজ ক্ষমা করে দিলাম । আমার বউ তো আমাকে জরিয়ে ধরে কেঁদে দিল । আর বলল আল্লাহ আমার স্বামী এত ভাল মানুষ আমি যেন জীবনে আর এমন কাজ না করি ?
————– তা তোমার বউ কি করেছিল ?
————— আর বইলেন দারগা সাব । আমি যে হাঁট থেকে পান কিনে আনি- সেই পান থেকে সে চুরি করে পান রেখে দেয় । পড়ে সে সেই পান বিক্রি করে তার নেশা করা ভাই কে টাকা দেয় । আমি বলে দিয়েছি টাকা না দিয়ে ভাই কে ভালবাসা দাও । ঐ লোকটার সাথে দেখা হলে শ্যালা কে কি করে নেশা থেকে ভাল করা যায় তার সাথে একটা পরামর্শ করব । কিন্তু দারগা সাব সে আপনার কি হয় ?
——- দারগা সে যখন আসছে তখন জানতে পারবা । বলে মটর সাইকেল নিয়ে খুব দ্রত বাসায় যায় । স্ত্রীর হাতে জর্দা দিয়ে বলে- পান দোকানদার রতনের সাথে কুকুর সহ একটা লোক আসছে সে কোথায় ?
——- স্ত্রী রেখা বেগম একটা হাসি দিয়ে বলে আরে সে তো চলে গেছে । তোমার মানি ব্যাগ কই ?
———কেন আমার প্যান্টের পকেটে ।
——– ভাল করে দেখ তো ?
——— দারগা পকেটে হাঁট দিয়ে দেখে মানি ব্যাগ নাই । রেখা বেগম দারগা সাবের হাতে ব্যাগটা দিয়ে বলল- লোকটা ব্যাগ দিতে আসছিল । ফাঁড়ীতে গিয়েছিল । একজন বলল তুমি ঘুমে । তাই সে বাসায় চলে আসছে মানি ব্যাগটা দিতে । লোকটা বলল সারা রাত জেগে ডিউটি করেছে তাই ডাকলাম না। স্যার কে এই ব্যাগটা দিয়ে বলবেন সব ঠিক থাকলে তো ভাল । আর কোন কিছু কম থাকলে তাকে মাপ করে দিতে বলেছে । আর তোমার মানি ব্যাগ থেকে এই বাসায় আসাযাওয়া বাবদ ৫০ টাকা খরচ করেছে । এর মধ্যে এক কাপ চা আর একটা বন রুটিও ঐ ৫০ টাকার মধ্য থেকে খরচ করেছে । বাসায় একটা কুকুর রেখে গেছে । বলল পড়ে এসে নিয়ে যাবে । আমি যেন গরম ভাতের মার দেই কুকুর কে খেতে । তোমার মানি ব্যাগে তো অনেক টাকা ছিল । লোকটা নাম কিন্তু খুবেই সুন্দর । অ-মানব । আমি তাকে বললাম এটা কোন নাম হল । সে হেসে বলল – কত ভাল নামের মানুষ খ্রাপ কাজ করে । আর কুকুর টা নাকি খুবেই ভাল । দারগা তো একেবারে অবাক । স্ত্রী কে বলল তোমাকে আর কিছু বলে নাই ঐ লোকটা । আমি তো অবাক মানি ব্যাগ সে নিলটোমাক?
——– আরে তুমি পুলিশ মানুষ তাই সবারে চোর মনে কর । লোকটা চোর হলে কি বাসায় ব্যাগ দিয়ে যেত । টাকার হিসাব দিত । পুলিশের চাকুরী করতে করতে তোমার সভাব টা সন্দেহের হেয়ে গেছে ।
———— আমি বলছি লোকটা আর কিছু বলেছে কি না ?
———— হ্যা বলেছে । কি বাজী ধরেছ তা যেন পালন কর । নয়লে নাকি সে আমার বাড়িতে এসে কি জানি অনশন শুরু করবে ? দারগা কুকুরের দিকে তাকাতেই । কুকুর টা দারগার দিকে এমন করে তাকাল যেন দারগা একটা চোর আর কুকুরেই দারগা ।।
———————————————————————————– চলমান ।।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!