৮ ফেব্রুয়ারি কী হবে, কী করবে বিএনপি
বাংলাদেশের রাজনীতি এখন ৮ ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে। যা কারও অজানা নয়। এও অজানা নয় যে, ওইদিন একটি মামলার রায় হবে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা। একটি মামলার রায়কে কেন্দ্র করে এত উত্তেজনার কারণ, বেগম খালেদা জিয়া এই মামলার আসামি। বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের দুইবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী।
তিনিই বাংলাদেশের একমাত্র নেতা যিনি সারা দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ৫টি আসনে নির্বাচন করে বিজয়ী হয়েছেন। এছাড়া এরশাদও ৫টি আসনে বিজয়ী হয়েছেন। তবে সেটা সারা দেশ থেকে নয়, শুধু রংপুর অঞ্চল থেকে। বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুটি মামলা সমান্তরালভাবে চলছে। একটি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা। অন্যটি জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায় দেয়া হবে ৮ ফেব্রুয়ারি। বিচারাধীন এই মামলা নিয়ে মন্তব্য করার সুযোগ থাকার কথা নয়, আইন অনুযায়ী।
তারপরও কথা চলছে। বিশেষ করে সরকারি দলের শীর্ষ পর্যায়, মন্ত্রী, নেতারা অনবরত কথা বলছেন। মামলার রায় কী হবে,তাও বলছেন কোনো কোনো মন্ত্রী। আজকের লেখায় বিচারাধীন মামলা নিয়ে কথা নয়। তবে রায়ের প্রেক্ষিতে দেশের রাজনীতিতে তার কী প্রভাব পড়তে পারে, সেই বিষয়ে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করব।
বিএনপির পরিণতি কী হতে পারে, আগামী নির্বাচন প্রসঙ্গ আসবে আলোচনায়।
১.
শুরুতেই বলে রাখা দরকার বাংলাদেশের বিশেষ করে রাজনীতিবিদদের মামলাগুলো সরকারের মনোভাবের উপর গতি-প্রকৃতি নির্ভর করে। এরশাদের মামলা তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা নিয়ে কয়েকটি কথা প্রচলিত আছে। বেগম খালেদা জিয়াকে সাজা দিয়ে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে চাওয়া হচ্ছে। বেগম খালেদা জিয়ার সাজা হলে, বিএনপি যাতে নির্বাচনে না আসার ঘোষণা দেয়।
হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির বিচার না করে, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুই তিন কোটি টাকার মামলার বিচার করা হচ্ছে। রাজনীতিতে এমন সব আলোচনা জমজমাট। বিএনপির পক্ষ থেকে যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা হয়েছে এই মামলার দুর্বলতার দিকগুলো। বিশেষ করে খালেদা জিয়া কোনোভাবেই এই মামলার সঙ্গে সম্পৃক্ত নন, তা প্রমাণের চেষ্টা ছিল। অপরাধ প্রমাণের পাল্টা যুক্তিও এসেছে।
২.
প্রথমেই একথা বলে রাখা দরকার যে, হাজার কোটি টাকার দৃশ্যমান দুর্নীতির অনেক অভিযোগের তদন্ত-বিচার হচ্ছে না, অভিযোগ হিসেবে অসত্য নয়। হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির মামলার বিচারের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না বলে, দু’তিন কোটি টাকার দুর্নীতির বিচার করা যাবে না, এটা যুক্তি হতে পারে না। তবে এর প্রেক্ষিতে পাবলিক পারসেপশন তৈরি হয় যে, বেগম খালেদা জিয়াকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণার জন্যে মামলা দেয়া হয়েছে।
৩.
ক্ষমতার রাজনৈতিক দল বিএনপি, বিরোধী দলের রাজনীতিতে দক্ষ নয়। একথা বলার সঙ্গে সঙ্গে বলা হবে, এরশাদবিরোধী আন্দোলনের কথা। সেই আন্দোলনে এরশাদের বিরুদ্ধে সব রাজনৈতিক দল এক ছিল। এখনকার মতো বিএনপিকে এককভাবে আন্দোলন করতে হয়নি। পুরনো আলোচনায় না গিয়ে, এখন বিএনপি কী করবে সেই আলোচনা আসি।
বেগম খালেদা জিয়ার শারীরিক-মানসিক দৃঢ়তা, শক্তি-সামর্থ্যে ভাটা পড়েছে। ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোকে হারিয়েছেন। বড় সন্তান তারেক রহমান লন্ডনে, দেশে আসতে পারছেন না। ৯০’র আন্দোলনে খালেদা জিয়াকে বুদ্ধি-পরামর্শ দেয়ার জন্যে যে মানের নেতা ছিলেন, এখন তা নেই। খালেদা জিয়া বিশ্বাস বা নির্ভর করতে পারেন, তার পাশে এমন নেতার সংখ্যা খুবই কম।
মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সব মহলের কাছে ক্লিন ইমেজের রাজনীতিবিদ। তিনি বেগম খালেদা জিয়ারও বিশ্বস্ত। কিন্তু লন্ডনে অবস্থানরত তারেক রহমানের সঙ্গে তার পুরোপুরি বিশ্বাসের সম্পর্ক আছে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। মির্জা ফখরুল গঠনমূলক রাজনীতিবিদ, মারদাঙ্গা রাজনীতিবিদ নন। তারেক জিয়া ঘরানার নেতারা তাকে খুব একটা পছন্দ করেন না। মওদুদ আহমদ বড় রকমের অবিশ্বাসী খালেদা জিয়ার কাছে, বিশেষ করে তার বাড়ির মামলার পর থেকে।
তারেক জিয়া লন্ডনে থাকলেও তিনি তার মতো করেই বিএনপি পরিচালনা করতে চান। মুখে না বললেও সিনিয়র অনেক নেতা বিশেষ করে মির্জা ফখরুলরা লন্ডনের অনেক সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হতে পারেন না, অধিকাংশ সময়। ফলে নেতৃত্বে নিষ্ক্রীয় একটা অবস্থা পরিলক্ষিত হয়।
বেগম খালেদা জিয়ার কাছে অনেক সিনিয়র নেতাও সব সময় সহজে পৌঁছতে পারেন না। বলা হয় গুলশান অফিসের কর্মচারীদের উপর প্রায় পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন খালেদা জিয়া। সিনিয়র নেতারা কর্মচারীদের গুরুত্ব দিয়ে চলতে রাজি নন। এই কর্মচারীরা বিএনপির না অন্য কারও স্বার্থ দেখেন, তা নিয়ে বিএনপির কর্মীদের মধ্যেও প্রশ্ন আছে।
খালেদা জিয়া অফিস করেন রাতের বেলা। সরকারের কঠোর মনিটরিংয়ের কারণে টেলিফোনে গুরুত্বপূর্ণ কোনো আলোচনা নেতাদের সঙ্গে বা তারেক রহমানের সঙ্গে করতে পারেন না। ফলে ভায়া পথে খালেদা জিয়া থেকে বা লন্ডন থেকে যে নির্দেশনা আসে, তা ঠিকমতো আসে না, আসলেও বাস্তবায়ন হয় না। সিনিয়র বিএনপি নেতারা অভিযোগ করেন, খালেদা জিয়ার অফিসের সব আলোচনার সংবাদ নেতাদের কাছে আসার আগে, এজেন্সির কাছে চলে যায়।
জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় হাজিরা দিয়ে আসার পথে বিএনপি কর্মীরা পুলিশের উপর বেশ বড় রকমের আক্রমণ করল। বিএনপির সিনিয়র নেতারা হিসেব মেলাতে পারছেন না, এই আক্রমণ কার নির্দেশনায় হলো। বিএনপির এমন কোনো নির্দেশনা তো ছিল না। মির্জা ফখরুল ঘরানার নেতারা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, বিএনপির কমপক্ষে একজন নেতাকে দিয়ে সরকারের কোনো সংস্থা পুলিশকে আক্রমণ করিয়েছে। বিএনপি নেতা দলীয় কর্মীদের দিয়ে পুলিশের উপর আক্রমণ ও দুইজন আসামি ছিনতাই করিয়েছেন। পুলিশ সাধারণত যতটা মারমুখী থাকে, সেদিন তার প্রায় কিছুই দেখা যায়নি। পুলিশ প্রায় কোনো প্রতিরোধ বা আক্রমণ না করে মার খেয়েছে। যে দৃশ্য সাম্প্রতিককালের ইতিহাসে বিরল।
৮ ফেব্রুয়ারি রায়ের আগে-পরে বিএনপি জমায়েত বা আন্দোলনে যেতে পারে, সরকারের অজানা থাকার কথা নয়। বিএনপির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্যে একটা পরিস্তিতি তৈরি করা জরুরি ছিল। সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী পরিস্থিতি তৈরি করা গেছে। অ্যাকশনে নেমেছে পুলিশ। ঘটনা ঘটেছে ঢাকায়, পুলিশ বিএনপি নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করছে সারা দেশে। প্রায় কোনো নেতাই বাড়িতে নেই। অনেকে গ্রেপ্তার হয়েছেন, অন্যরা পলাতক। ৮ ফেব্রুয়ারি নেতাকর্মীদের ঢাকায় আসা ঠেকানো এই গ্রেপ্তার-অ্যাকশনের অন্যতম উদ্দেশ্য।
৫.
বিএনপি ভাঙার পরিকল্পনা চলছে গত চার পাঁচ বছর ধরে। সফলতা আসেনি। রায়ে খালেদা জিয়ার যদি শাস্তি হয়, তাতেও যদি বিএনপি আগামী জাতীয় নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা না দেয়, দল ভাঙার পরিকল্পনা আরও গতি পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সফলতার সম্ভাবনা কতটা, তা নিশ্চিত নয়।
তবে বিএনপি ভাঙ্গার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।বিএনপি ভাঙ্গার প্রক্রিয়ায় মওদুদ আহমদ অন্যতম টার্গেট ছিলেন। বাড়ি হারিয়েও তিনি রাজি হন নি। যারা মওদুদকে দিয়ে বিএনপি ভাঙ্গতে চেয়েছিল, তারা শুধু মওদুদের বারবার দল পরিবর্তনের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েছিলেন। তারা এই বিবেচনা মাথায় রাখেন নি যে, মওদুদ মন্ত্রী হওয়ার সুযোগ থাকলে অন্য দলে বা সরকারে খুব সহজে যোগ দিতে হয়ত রাজি হবেন, কিন্তু বিএনপি ভেঙ্গে সেই বিএনপিকে সরকারের সহায়তায় নেতৃত্ব দিয়ে নির্বাচন করে বিরোধীদলীয় নেতা বা মন্ত্রীর হওয়ার কঠিন ঝুকি তিনি নেবেন না। মির্জা ফখরুল কথনও খালেদা জিয়াকে ছেড়ে যাবেন না। বড় অন্য কোনো নেতার দল ভাঙ্গা প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম। তবে একেবারে নিশ্চয়ই উড়িয়ে দেয়া যায় না।
৬.
রায়ে যদি খালেদা জিয়ার শাস্তি হয়, পরিস্থিতিটা কেমন হবে?
বড় কোনো আন্দোলন বিএনপি করতে পারবে, সম্ভাবনা কম। সরকার চাইবে বিএনপি ভাঙ্গচুর অরাজকতা নির্ভর আন্দোলন করুক। তাহলে দমন করা সহজ হবে।
আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির নেতা- মন্ত্রীরা বারবার বলেছেন, খালেদা জিয়াকে জেলে যেতেই হবে। রায় নিয়ে আগাম মন্তব্য করার সুফল বিএনপি পেয়েছে। রায়ের পরে মানুষের সহানুভূতি সরকারের চেয়ে খালেদা জিয়ার পক্ষে বেশি থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
খালেদা জিয়ার অবর্তমানে বিএনপির একক নেতৃত্ব যদি মির্জা ফখরুলের হাতে থাকে, তবে বিএনপি হটকারীমূলক কর্মসূচি দেবে না বলেই মনে হয়। যদি যৌথ নেতৃত্ব এবং সেই নেতৃত্ব যদি লন্ডন নির্ভর হয়, গুলশান কার্যালয়ের কর্মচারিদের নির্দেশনায় হয়, বিএনপির বড় বিপদে পড়ার সম্ভাবনা থাকবে।
২০১৪ সালের জ্বালাও- পোড়াও আন্দোলন পুরোটা যে বিএনপি নিজে করেনি, তা বিএনপি সবচেয়ে ভালো জানে।বিএনপি ছাড়া আর কারা করেছে বা করে, তাও বিএনপির অজানা নয়। কারণ ক্ষমতার মেকানিজম বিএনপির জানা আছে। এবারও নেতৃত্ব ঠিক না থাকলে, একক নেতৃত্ব না থাকলে, নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেওয়ানো হতে পারে বিএনপিকে দিয়ে। জ্বালাও- পোড়াও জাতীয় কর্মসূচিও আসতে পারে। যা পুরোপুরিভাবে বিএনপির বিরুদ্ধে যাবে। যেভাবে সাম্প্রতিক পুলিশের উপর করা আক্রমণ পুরোপুরিভাবে বিএনপির বিরুদ্ধে গেছে।
রাজনীতিবিদদের জেলে যাওয়া অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়। খালেদা জিয়ার যদি শাস্তি হয়, তিনি যদি জেলে যান, তাতে বিএনপির ক্ষতির পরিবর্তে লাভ হতে পারে। এক্ষেত্রে প্রধানতম বিবেচনার বিষয় ‘সঠিক ধির-স্থির বিচক্ষণ একক নেতৃত্ব’। তা যদি হয়, বিএনপির সত্যিকারের একটি রাজনৈতিক দলে পরিণত হওয়ার সুযোগ তৈরি হতে পারে।
গোলাম মোর্তোজা: সম্পাদক, সাপ্তাহিক।
s.mortoza@gmail. com
- প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। কাগজ২৪-এর সম্পাদকীয়নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য কাগজ২৪ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্যকোনও ধরনের কোনও দায় নেবেনা।
কাগজটুয়েন্টিফোর বিডি ডটকম এ প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।