তাবলিগের প্রতিষ্ঠাতা কে ছিলেন?
সাল ১৮৮৫। এক শিশিরছোঁয়া সকালে পৃথিবী আলোয় উদ্ভাসিত হলেন তিনি। কান্দালার এক ছোট্ট কুঁড়েঘর ঝলমলিয়ে উঠল। পাতায় পাতায় বয়ে গেল আলোর নাচন। আলোকময় এই শিশুর নাম মুহাম্মদ ইলিয়াস। মেওয়াত-এর নানা বাড়িতেই কাটল তার মধুর ছেলেবেলা। হেসে খেলে একটু যখন বড় হলেন, তখনই চলে গেলেন নিজামুদ্দিনে বাবার কাছে। বাবা তার মাওলানা মুহাম্মদ ইসমাঈল। তিনি দুই বিয়ে করেছিলেন। প্রথম পক্ষের ছিলেন মাওলানা ইলিয়াস। আর মাওলানা ইয়াহিয়া।
প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুতে দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন মাওলানা মুহাম্মদ ইসমাঈল। মাওলানা ইলিয়াসের নানির নাম ছিল আমাতুস সালাম। আম্মিবি নামে তিনি ছিলেন সুপরিচিত। তার ধ্যানময় সালাত পড়ার দৃশ্য আর সুললিত কণ্ঠের তেলাওয়াত ছিল এই পরিবারের ঐতিহ্য। একই ঐতিহ্যের ছোঁয়া পেয়েছিলেন মাওলানা ইলিয়াস সাহেবের গর্বিনি মা শাফিয়া বিবি। তিনিও পুরো কালামে পাক রোজ একবার করে তেলাওয়াত করতেন। নানিজান আম্মিবির সবচেয়ে প্রিয় নাতি ইলিয়াসের পড়লেখার হাতেখড়ি হয় মক্তবে। শৈশবেই পাক্কা হাফেজে কুরআন হয়ে যান তিনি। পরহেজগার নানিজানের চোখে প্রিয় নবীজির প্রিয় সাহাবাদের আদল ভাসত ইলিয়াসের অবয়বে।
প্রিয় নাতির জন্য তিনি মোনাজাত করতেন, তিনি যেন তার সাহাবাদের মতো ইসলাম প্রচারের এক সৈনিক হতে পারেন। রিয়াজুল ইসলাম কান্দালভী ছিলেন মাওলানা সহপাঠী। ছেলেবেলার স্মৃতি চারণায় তিনি বলেন, মাওলানা আমাকে একদিন বললেন, চল তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করি যারা সালাত কায়েম করে না। ১৮০০ শতকে গাঙ্গোহ ছিল সুফি সাধক আর জ্ঞান পুরুষদের এক প্রসিদ্ধ শহর। শতকের শেষের দিকে এ শহরেই জ্ঞান আহরণের জন্য স্থায়ীভাবে চলে এলেন তিনি। ভূবনখ্যাত জ্ঞানীদের সোহবতে খেদমতে থেকে বিশটি বছর কাটিয়ে দিলেন মাওলানা ইলিয়াস রহ.।
এই শহরের প্রসিদ্ধ আলেম মাওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গোহীর পরশে খাঁটি এক সৈনিক বনে গেলেন ইলিয়াস। বিশ বছরের টগবগে তরুণ স্বপ্ন বুনতে লাগলেন কাজের। যে কাজ নবীরা করতেন এমন কাজ করতে হবে তাকে। প্রিয় শিক্ষক মাওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গোহীর কাছে ছাত্র অবস্থায় বয়াতও গ্রহণ করেছিলেন তিনি। একই সঙ্গে পীরের কালব খোলার কুদরতি আর মান শিক্ষার জৌলুস লাভ করেছিলেন বলেই পরবর্তী সময় মানবসেবায় তাবলিগের মতো এতোবড় মেহনতের রূপরেখা তৈরি করতে পেরেছিলেন। মাওলানা ইলিয়াস রহ. এর পীর তার কালবে খোদার জ্যোতির ছোঁয়া আর শিক্ষা দিয়েছিলেন মানবসেবার। তাঁর জীবনের দুই শিক্ষায় তিনি তাবলিগ জামাতের শেকড় গড়েছেন। আজকের বিশ্বব্যাপী প্রচারিত তাবলিগের মূল- মানুষের ভাল’র চেষ্টা করা।
মানুষের ভালো তো সেটাই যা মানুষকে খোদার সঙ্গে মিলিয়ে দেয়। তাবলিগিরা খোদার দিকে মানুষকে ডেকে আনার প্রয়াস নিয়ে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। ১৯০৫ সালে রশীদ আহমদ গাঙ্গোহী রহ. এর ইন্তেকালের পর দেওবন্দ চলে যান তিনি। এখানে মাওলানা মাহমুদুল হাসান রহ এর কাছে তিরমিজি আর বুখারি শরিফের পাঠ গ্রহণ করেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ইসলামি আন্দোলনের বীজ রোপন করেন অন্তরে। আর এই আন্দোলনের বায়াত গ্রহণ করেন মাওলানা মাহমুদুল হাসান রহ. এর কাছে।
মাওলানা ইলিয়াসের আধ্যাত্মিক গুরুগণ হচ্ছেন, মাওলানা আবদুর রহীম রায়পুরী ও মাওলানা আশরাফ আলী থানবী রহ.। ১৯১০ সালে মাজাহিরুল উলুম মাদরাসায় তিনি শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৯১২ সালের ১৭ অক্টোবর আপন মামাত বোনকে বিয়ে করেন। ১৯১৪ সালে হজের উদ্দেশে যাত্রা করে ১৯১৫ এর ফেব্রুয়ারিতে পবিত্র হজ উদযাপন শেষে দেশে ফেরেন মাওলানা ইলিয়াস। আরব সারা নামের তোরণের কাছে হজরত নিজাম উদ্দিন আউলিয়ার মাজারে প্রায়ই তিনি ধ্যানে বসতেন। এভাবে খোদার ধ্যানই তাকে ইবাদতের ধনী ব্যক্তিতে রূপান্তরিত করেছিল। ১৯৪৪ সালের ১২ জুলাই। শিশিরভেজা সকালের সেই সূর্যটি টুপ করে মিশে গেল পশ্চিমে। পশ্চিমে কাবা। পশ্চিমেই মদিনা মুনাওয়ারা।