সেলিনা জাহান প্রিয়ার ধারাবাহিক গল্প-”অ-মানব” (২৩তম পর্ব)
অ-মানব (২৩তম পর্ব)
———————- সেলিনা জাহান প্রিয়া
হা মিনা এক রহস্য আপনাদের পারিবারে। শিলার বাবা বলে মিনা কি রহস্য
আমার জানতে হবে।
পাগল বলে – আপনার চাচার তিন সন্তান মারা যায়। আপনার চাচী আর মা হতে পারবে না। গোপনে আপনার চাচার সাথে মিনার একটা মনের সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। আপনার দাদি মারা যাওয়ার সময় মিনার সকল দায়িত্ব আপনার চাচার উপর দিয়ে যায়। আপনার চাচী যখন জানে যে আপনার চাচার সাথে মিনার সম্পর্ক অনেক গভীর তখন মিনা কে অনেক শাসন করে। কিন্তু ততক্ষণে মিনা ৪ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। আপনার চাচী আপনার চাচা কে বিষয়টি বলে একটা ভয় দেখায় যে সে পঞ্চায়েত ডাকবে। আপনার চাচা বলে মিনা কে সে বিয়ে করেছে। কিন্তু আপনার চাচী বিষয়টা অন্য ভাবে নেয়। আপনার চাচির ভাইয়েরা রাতেই এসে মিনাকে জোর করে তুলে নিয়ে যায়। সকালে স্ত্রীর সাথে অভিমান করে সে ফাসি নেয়। মিনা কে খুব অত্যাচার করে আপনার চাচির ভাইয়েরা। আপনার চাচা মারা যাওয়ার জন্য আপনার চাচী মিনাকে দায়ি করে ভয় দেখায় যে তাকে পুলিশে দিবে। মিনা তখন কিছু কাগজে টিপ সহি দেয়। মিনার খবর আর কেউ রাখে না।
আপনার চাচী বাকি জিবন এই বাড়িতে থেকে যায়। আর আপনার চাচার অংশ বিক্রি করে হজ করে আসে। কিন্তু মিনার একটি ছেলে হয়। আপনি কি তা কোন দিন জানেন? আপনার এই বাড়ির এবং আপনার সকল সম্পদের অর্ধেক মালিক। এখন আপনার মনে হতে পারে আমি এই গল্প বানিয়েছি। বা আমি কোন লোভে এই গল্প করছি। কিন্তু আপনি তো মিনাকে দেখলে চিনবেন।
— তুমি জা বলেছ আমি তা বিশ্বাস করি। কারন আমার মেয়েকে তুমি ঐ রাতে ফেরেশতার মত এসে রক্ত না দিলে আজ এই পরিবারের কেউ বেচে থাকা না থাকা সমান। আর শিলার মা কোন দিন দ্বিতীয় বার মা হতে পারবে না। আমিও ওকে রেখে বিয়ে করতে পারব না। কিন্তু আমি কোথায় পাব তাঁদের।
— পাগল হেসে বলে এই দুনিয়ায় একটা মজার বিষয় হল মানুষ যে লোভের আশায় সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে সেই সব জায়গায় তার পায়ের ছাপ থাকে। যারা ভাল মানুষ তাঁদের পায়ের ছাপে ফুল ফুটে আর খারাপ মানুষের পায়ের ছাপে তাঁদের পাপের লেপন থাকে।
— কিন্তু আমি তাঁদের আনতে চাই। তাঁদের হক দিতে চাই।
— পাগল হেসে বলে। আপনি সব পাপ মুছে একটা সুন্দর জিবন পেতে চান।
— হ্যা পেতে চাই। পাগল বলল একটু অপেক্ষা করুন। পাগলটা হেঁটে শিমুল গাছের কাছে যায়। গাছটায় হাত রেখে বলে বন্ধু তোমাকে বিদায়। নাদিয়া বলে ভাইয়া তুমি গাছ কে কি বলছ। ও কি মানুষের কথা বুঝে। পাগল বলে প্রতিটা প্রানির কথা প্রতিটা প্রানির বুঝতে হয়। যে বুঝে সে হয় মানব আর যে বুঝে না সে হয় মানুষ। আমি একজন মানুষ থেকে মানব হতে চাই তাই তাঁদের সাথে কথা বলি। নাদিয়া বলে তুমি আসলেই একটা পাগল। এই নাও তোমার একটা এস এম এস এসেছে নার্স দিলরুবার নাম্বার থেকে। পাগল মানুষটা এস এম এস টা ভাল করে পড়ে নেয়। শিলার বাবা বলে আমারা যেতে চাই মিনার কাছে। দিলরুবা, নাজু, নাজ ও শিলা যেতে চায়। শিলার বাবা একটা মাইক্রো নিয়ে রওনা দেয় সাগর নাল চা বাগানের দিকে। সিলেট থেকে অনেক দূর সাগর নাল চা বাগান। শিলা পাগল কে গাড়িতে বসে বলে –
— জিনিয়াস মামা তুমি অনেক কিছু জানো। যা আমরা জানি না। কি করে জান?
— জানার খুব ইচ্চা। আমি সব কিছুতেই কারন খুঁজি, যুক্তি খুঁজি।
— মামা আমি কি জানতে পারি তুমি কি ভাবে এত সব জানো?
— মা মনি মানুষ কে জানার ইচ্ছা থাকতে হবে। মানুষ কে মানুষের মত ভালবাসতে
সব মানুষ কে সত্য বলছে এমন ভাবতে হবে। জিবনে কোন কিছু না দেখে কাউকে
সন্দেহ করা যাবে না।
— নাদিয়া বলল। ভাইয়া আমি কি আপনাকে তুমি করে বলতে পারি।
— নাজ হেসে বলল ভাইয়া কে তুমি করে আমিও বলতে চাই।
–শিলা বলল মামা তুমি কিন্তু হা বল না।
— শিলার বাবা বলে নাজু তোমার ভাই তুমি কিছু বল।
— নাজু বলল তোমাকে দুলাভাই বললে কি তুমি খুসি হবে।
— শ্যালা যদি দুলাভাই না বলে তাহলে কি হয়।
— পাগল হেসে বলে সবাই মায়ায় বাঁধনে জরায়। মায়ার দুনিয়া বড় কষ্টের।
দুলাভাই মায়া আছে বলে দুনিয়া আছে। একটা অবাক করা বিষয় কি জানেন
মানুষ বেশি ভুল এই মায়ার জন্য করে। মায়া বা মমতা জার মধ্যে বেশি সেই
বেশি কষ্ট ভোগ করে। আমি মায়া থেকে অনেক দূরে।
— নাজ হেসে বলে তাই রাত জেগে তুমি আকাশ দেখ চেয়ে।
— না আমি আকাশ দেখি না আকাশের মাঝে এত তারা কেন তাদের মাঝে কি
এমন সুখ যে রাত জেগে আলো দিয়ে যায়।
— শিলা বলে মামা তুমি কি জান আমাদের মত এমন দুনিয়া তারা দেশে আছে।
— পাগল বলে তাই বুঝি মা। তাহলে তো একবার যেতে হয়।
— মামা তুমি সত্য কি তারার দেশে যেতে পার।
— পাগল হেসে বলে হা আজ একটু তারার দেশে যাব।
গাড়িটা এসে থামে সাগর নাল চা বাগানে। চার দিক তখন ও শীতের কিছু আমেজ রয়ে গেছে। পাগল গাড়ি থেকে নেমে একজন কে জিজ্ঞাসা করে এখানে মিনা নামে
কি কেউ থাকে। একজন বলে কোন মিনা, একজন কালা মিনা অন্য জন দলা মিনা।
পাগল ঐ মানুষটার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে দলা মিনার কি একটি ছেলে।
লোকটি বলে হা দলা মিনার একটি ছেলে। পাগল বলল – হা ঐ মিনা কে দরকার।
লোকটা বলল সামনে গিয়ে ডানে বাঙালি বস্তি আছে ঐ খানে যান। পাগল গাড়ি নিয়ে
বাঙালি বস্তীর কাছে আসে। আবার জিজ্ঞাসা করে একজন কে – দেখিয়ে দেয় মিনার
ঘর। শিলা, বাবা দেখেই চিনে যায় তার মিনা ফুফু কে। মিনা প্রথমে কিছুটা ভয় পায়। শিলার বাবা বলে ফুফু আমি তোমাকে নিতে এসেছি তোমার বাড়িতে। শিলার বাবার মুখটা হাতিয়ে বলে তোমার মুখে ফুফু ডাক শুনে আমি সব দুঃখ ভুলে গেছি। কিন্তু আমার ছেলের তো বাবার পরিচয় নেই। শিলার বাবা বলে আমার চাচার ছেলে আমার ভাই। ফুফু তুমি চল তোমার ঘর বাড়ি তোমার সম্পদ তুমি বুঝে নাও। আমি এই পাগল শ্যালা কে যে কথা দিয়েছি। তোমার হক আর সম্মান আল্লাহর একটা উসিলায় দিয়েছে। শিলার বাবা অবাক হয়ে দেখে তার চাচার ছেলের মুখটা একদম তার চাচার মত। মিনা সবার জন্য চা বানায়। শিলা কে কাছে ডেকে নেয়। শিলা বলে তুমি আব্বুর ফুফু তাহলে আমাদের দাদি। সবাই কথা বলায় ব্যস্ত। মিনার তার চোখের পানি মুছে। আশপাশের সকল মানুষ খুব খুশি। সবাই ভীর করে থাকে মিনার চার পাশে। সবাই গাড়িতে উঠতে থাকে মিনা ও তার ছেলেও গাড়িতে উঠে। শিলা বলে জিনিয়াস মামা কোথায়। কিন্তু সেই পাগল মানুষটা তাদের না বলে তাদের রেখে বাগানের ভিতরে চলে যায়। রাত ১০ টা পর্যন্ত দেখে পাগলটা বাগানের কোথাও নেই। নাদিয়ার মোবাইল এ আবার এস এম এস আসে। তাতে লিখা শিলা মা মনি তোমার মামা এখন তারার দেশে যাচ্ছে। ভাল থেকো নাদিয়া। যে দিন” ল” পাস করবে তোমার জন্য আমি পদ্ম ফুল নিয়ে আসব। সাগরনাল চা বাগান থেকে সবাই মিলে বাড়িতে চলে আসে। শিলার খুব মন খারাপ। নাদিয়া পুকুর পারের সেই জানালাটায় দাড়িয়ে পুকুরের দিকে চেয়ে আছে। সকালে নাদিয়া তার বাড়ির সামনে ঝাড়ু দিতে যেয়ে অবাক। তার চার পাসের বাড়ির সামনে কোন ময়লা নেই। ঘরে এসে পাগলটার জন্য কাদতে থাকে। নাজ এসে বলে আপু ভাইয়ার জন্য আমার অনেক মায়া লাগছে।
নাজু আপা এসে বলে অনেক মন দিয়ে পড়, দেখিস ও সত্যিই একদিন আসবে। আর ওকে দেখতে চাইলে তোকে দুইটা বিষয় পাস করতে হবে। একটা বিএ অন্য টা ল।
নাদিয়া কেদে বলে আমি পদ্ম ফুলের অপেক্ষায় আছি ভাইয়া।
পাগল মানুষ টা চা বাগান থেকে বের হয়ে একটা পাকা রাস্তা পায়। পাকা রাস্তা দিয়ে
উদ্দেশ্য হীন ভাবে হাঁটতে থাকে। কোথায় যাচ্ছে সে নিজেও জানে না। কিছু দূর হাটার পর দেখে একটা খালি ট্র্যাক। মনে হয় চালক গাড়ি বন্ধ করে ঘুমিয়ে আছে। কিন্তু পাগল টা চালকের কাছে যাওয়ার পর বলছে ভাই আমাকে একটু ধর। পাগল দেখল লোকটা শরীরে অনেক জ্বর। তাপে তার শরীর পুরে যাচ্ছে। পাগল তারা তারি গাড়ি থেকে একটা বালতি নিয়ে চার দিক দেখে। অনেক দূরে আলো দেখে সে বালতি নিয়ে দোর দেয়। আলোর কাছে এসে দেখে অনেক কয়টা বাসা। চাপ কল থেকে পানি নিয়ে চালকের মাথায় দিতে থাকে। পানি আনে আর দেয়। সাত বালতি পানি দেয়ার পর লোকটার হুস আসে। যে বাড়ি থেকে পানি এনেছে কল চাপের বার বার শব্দ পেয়ে পাগলের পিছনে দু জন মানুষ আসে। সবাই ধরা ধরি করে চালককে নিয়ে ঐ বাড়িতে মুছা মিয়ার ঘরে যায়। চালক কে চকিতে শুইয়ে দেয়। মুছা মিয়া কে নিয়ে পাগল গ্রামের ডাক্তারের কাছে যায়। রাতেই কিছু ঔষধ নিয়ে চালক কে খাওয়ায়। ভোর বেলায় চালকের শরীর ঘাম দিয়ে জ্বর ছেরে দেয়। পাগল মানুষটা রাতে আরও দুই বার শরীর মুছে দেয়। চালকের ঘুম থেকে জেগে উঠে পাগলের হাত জড়িয়ে বলে ভাই আপনি আজ না আসলে এই পথে আমার যে কি হত। পাগল হেসে বলে যে বাচবে তাকে বাচানে ওয়ালা যে কোন উসিলায় বাঁচাবে। হয়ত আপনার জিবনে আপনি কাউকে কোন ভাবে কোন ভাল উপকার করেছেন স্বার্থহীন ভাবে আর তাই আপনি ও উপকার পেলেন স্বার্থহীন ভাবে। এই দুনিয়ার নিয়ম তুমি ভাল করলে তা ভাল ভাবেই কোন না কোন ভাবে ফিরে আসবে। মুছা মিয়া তাদের জন্য কিছু নাস্তা নিয়ে আসে।
মুছা মিয়ার একটা বিধবা মেয়ে তাদের জন্য গরম চা বানিয়ে দেয়। মুছা মিয়া একজন দিন মুজুর মানুষ। বিধবা মেয়েটা বিয়ে হয়েছিল এক দিন মুজুরের কাছে। গাছ থেকে পড়ে লোকটা মারা যায়। কথায় কথায় মুছা মিয়া অনেক কথা পাগলের সাথে বলে। পাগল মেয়েটা কে বলে ও খুব পর্দা শীল মেয়ে। কি নাম চাচা – মুছা মিয়া বলে ও খুব দুখী আমি সখ করে ওকে বেদেনা বলে ডাকি। ছোট বেলায় ওর বেদেনা খুব পছন্দ ছিল। আমি ঢাকা সদর ঘাঁট ফলের আড়তে তখন কাজ করতাম। বেদেনা ছাড়া আমার মেয়ে অন্য কোন ফল খেত না। তার পর থেকে ওর মা আর আমি ওকে বেদেনা বলে ডাকি। ট্র্যাক চালক বলল গাড়িটা রাস্তায় রাখা কি অবস্থা। মুছা মিয়া বলল আমি দেখে এসেছি ভাল অবস্থায় আছে। চালক তার মাকে ফোন করে জাফলং।
ছেলের কথা শুনে চালকের মা তাড়াতাড়ি চালকের ঠিকানায় রওনা দেয়। পাগল চেয়ে দেখে মুছা মিয়ার মেয়ে তাদের বেড়ার ফাক দিয়ে দেখছে।।
চলমান—-