সুলতানা রুবীর- ফেরা
ফেরা
——— সুলতানা রুবী
অন্ধকার আকাশে তারার আলো ছাড়া আর কোন আলো নেই। নীচে অথই সাগর। মানিকের চোখও তারার আলো মতই ঝলমল করছে। প্রায় এক বছর পর সে তার মায়ের কাছে ফিরছে। বাবার মৃত্যুর পর পাশের বাড়ির লেংরা রমিচ ফকিরের সহযোগী হয়ে ছোট্র মানিক ঢাকা এসেছিল । এর মধ্যে এক বারও যোগাযোগ হয়নি মায়ের সাথে। আজই প্রথম বাড়ি ফিরছে সে। রাত যেন আর শেষ হচ্ছেনা। কখন বাড়ি যাবে ? কখন মায়ের হাতে তুলে দিবে নতুন শাড়িখানা ? নির্ঘুম রজনী কাটলো মানিকের।
লঞ্ছ ঘাটে ভিরতেই এক লাফে নামে মানিক। আ: কী সুন্দর! দুই হাত উড়িয়ে চারি দিকে ঘুরে বুক ভরে নি:শ্বাস নেয় মানিক । কত দিন পরে দেশে আইলাম। আমারে মনে অয় কেউ চিনবার পারবনা। আমি কী দেখতে আগের মতনই আছি নাকি বদলাইয়া গেছি? গেলে গেলাম মায়ে আমারে ঠিকই চিনবার পারব। ঘাটের অল্প দুূরেই মানিকদের বাড়ি। দৌড়ে হাটে মানিক। মাঝে মাঝে লাফ দিয়ে গাছের পাতা ছুঁতে যায়। রাস্তার পাশে দাড়িয়ে থাকা গাছ গুলো গায়ে হাত দিয়ে আদর জানায়। জানতে চায় আমার মায় কেমুন আছেরে?
বাড়ির আঙ্গিনায় ঢুকতেই চিৎকার করে ডাকে মা.. ..
আমাগো মানিকের গলানা ? হায় আল্লাহ হ মানিকইতো! ও মাইঝা ভাই মানিক আইছে। ফুপু হালিমা জড়িয়ে ধরে মানিককে।
ও বাজান তুই কেমনে আইলি ? কার লগে আইলি ?
আমি একলাই পলাইয়া আইছি। দাদারে কই আমারে লঞ্ছে তুইলা দেও দেয় না। খালি কয় দিমু দিমু.. ..
তুই চিনবার পারলি বাপ?
হ, আমি অহন ঢাহা শহরের বেবাক চিনি। অহন বুজব বুইড়া। আমারে খালি কয় আজকা না কালকা। মনে করছে আমি চিনুমনা। অহন কেমনে বিক্কা করে আমি দেহুম। গর্বিত আনন্দ মানিকের চোখে মুখে।
ও ফুু মায় কই ? কতদিন মায়রে দেহিনা।
হঠাৎ বিদ্যুৎ শকটের মত শকট খেল হালিমা। দু’হাতের বন্ধন থেকে যেন ছিটকে চলে গেল বহু দূর।
কিগো ফু চমকাইয়া উঠলা যে? মায় কই?
এতক্ষণ যে আনন্দের ঢেউ বইছিল তা যেন মূহুর্র্তেই থেমে গেল।
ও কাকা মায় কই? মারে দেখতাছিনা যে।
ও বাজান আমার কাছে আয। তোর আতে ওডা কি?
মায়ের লিগা শাড়ি আনছি।
টেকা পাইলি কই রমিচ চাচা দিছে?
না । ঐ বুইরা টেকা দিতে চায়না, আমি পলায়া পলায়া জড় করছি।
চুরি করস নাইতো ?
না। মায় কইছে চুরি করলে পাপ অয়। আর কইছে খারাপ কাম করলি আব্বারে নাকি দোযকে দিব । হের লিগা আমি চুরি করিনা। দাদায় খাইতে দিছে আর আমি না খাইয়া জড় কইরা মায়ের লিগা শাড়ি কিনছি। মায় কই কাকা ? মামুগো বাড়ি গেছে?
তোমার মায়তো মইরা গেছে।
এতক্ষণ কোথায় ছিল মানিকের চাচাত বো ছোট্র টিয়া ? হ ভাই তোমার মায় মইরা গেছে। আইলা আইলোনা তহন। গাছের ডাইল মাতার উপুর ভাইঙ্গা পরছিল। আর চাচী মইরা গেলো । তোমারে কত বাবা বাবা কইয়া ডাকল। ঐযে ঐহানে কব্বর দিছে। তরজনীর ইশারায় আসল জায়গাটাই দেখিয়ে দিল টিয়া।
নিজের অজান্তেই মানিক তার মায়ের কবরের পাশে গিয়ে দাড়ায় ।
ও ফু এইডা কী সত্যি মায়ের কব্বর। মায় কী সত্যি মইরা গেছে ?
ডুকরে কেঁদে উঠে হালিমা।
মায়ে বুঝলনা আব্বায় আমারে হের কাছে থুইয়া গেছে, তাইলে মায় আমারে কার কাছে দিয়া গেল ? ঐ রমিচ দাদার কাছে ?
এতক্ষণ পথরের মূর্তির মত দাড়িয়ে যে মানিক কথা গুলি বলছিল হঠাৎ সে ভেঙ্গে পরল মায়ের কবরের উপর। কবরের মাটি খামছে ধরে চিৎকার আর হাউ মাউ করে কাঁদলো বেশ কিছুটা সময়। মানিকের কান্না আর বিলাপ শুনে চোখের পানি ধরে রাখতে পারলনা অনেকেই। তারপর হঠাৎই যেন নিরব হয়ে গেল মানিক। দু’হাতে কবরের মাটি তুলে নিয়ে বুকে জড়িয় ধরল। তাপর মায়ের জন্য আনা শাড়ি খানা খুলে বিছিয়ে দিল মায়ের কবরের উপর।
মা তুমি ঘুমাও। তোমারে আর কোন দিন ডাকতে আমুনা। তুমি আমারে যার কাছে দিয়া গেছ তার কাছে চইলা যামু.. ..
উঠে দাড়ায় মানিক আর যে ভাবে দৌড়ে এসেছিল ঠিক সে ভাবেই দৌড়ে বের হয়ে যায় বাড়ি থেকে।
হালিমা পিছন থেকে ডাকে যাসনা বাজান, যাসনা ফিরা আয় বাজান ফিরা আয়..