একদিনের সংবাদপত্রের শিরোনামঃ মানুষের কথা
একদিনের সংবাদপত্রের শিরোনামঃ মানুষের কথা
রণেশ মৈত্র
সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ
দিনটি ছিলো ১৯ জুলাই। সকালে ঘুম থেকে উঠে হাত মুখ ধুয়ে চায়ের পেয়ালা হাতে প্রতিদিনের অভ্যাসমত একাত্তর টিভি. চ্যানেলটি খুলতেই চোখে পড়লো নানা সংবাদপত্রের শিরোনাম। এক এক করে কয়েকটি শিরোনাম পাঠক-পাঠিকাদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য তুলে ধরছি।
এক. এক মাসেই আক্রান্ত বেড়েছে এক লাখ
দুই. কম পরীক্ষা আক্রমণের ঝুঁকি বাড়ায়
তিন. ঈদের পরে উল্লম্ফন
চার. নিম্ন মানের মাস্ক-পিপিই সরকারকে সরবরাহ দিতেন সাহেদ
পাঁচ. বেশী দামে কিট কিনছে সরকার
ছয়. টেষ্ট-হাসপাতালে আস্থা নেই জনগণের
সাত. হেভিওয়েট অনেকের নাম সাহেদের মুখে
আট. সব জানতেন স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা-জেরায় সাবরিনা
আমাদের দেশে দৈনিক পত্রিকার সংখ্যা অনেক। প্রায় সকল পত্রিকারই শিরোনাম একই ধরণের। তাই মাত্র আটটি প্রতিনিধিত্বমূলক শিরোনাম তুলে ধরলাম-এতেই এই দিনটির প্রধান প্রধান খবর পাঠকদের সামনে উঠে আসে। তাই খবরের বিস্তরিত উল্লেখ করা থেকে বিরত রইলাম।
দৈনিক সমকাল করোনা পরিস্থিতির আপ-ডেট প্রকাশ করে যথেষ্ট উপকৃত করেছে তথ্যাদি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নেওয়ার ক্ষেত্রে। করোনা পরিস্থিতিকে আমার আর পৃথক করে ‘স্বাভাবিক’, ‘আশাব্যঞ্জক’ বা ‘মারাত্মক’-এমন কোন অভিধায়ই অভিহিত করার প্রয়োজন নেই। শুধুমাত্র ‘সমকালে’ প্রকাশিত ঐ ছকটি তুলে ধরছি। ওটি যেহেতু সরকার স্বীকৃত তাই সম্ভবত: বিতর্কের ঊর্ধেও।
ছক
আক্রান্ত মৃত্যু
প্রথম ৬৯ দিন ২০,০৬৫ ২৯৮
৮২ দিন ৪০,৩২১ ৫৫৯
৯০ দিন ৬০,৩৯১ ৮১১
৯৭ দিন ৮১,৫২৩ ১,০৯৫
১০৩ দিন ১,০২,২৯২ ১,৩৪৩
১০৯ দিন ১,২২,৬৬০ ১,৫৮২
১১৪ দিন ১,৪১,৮০১ ১,৭৮৩
১২০ দিন ১,৬২,৪১৭ ২,০৫২
১৩৩ দিন ২,০২,০৬৬ ২,৫৮১
এতে গত ১৮ জুলাই পর্য্যন্ত আক্রান্ত ও মৃত ব্যক্তিদের সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে।
ডা. এ.বি.এম আবদুল্লাহ, করোনা সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন, একই পত্রিকায় একই দিনে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন যা ১৯ জুলাই পত্রিকাটির প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিক্রিয়া সংক্ষিপ্ত তাই তার পূর্ণ বয়ান উদ্বৃত করছিঃ
দেশে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা দুই লাখ ছাড়িয়েছে। মৃত্যুও আড়াই হাজার ছাড়িয়েছে। গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি সনাক্ত হয়েছিলেন। এবং ১০ দিনের মাথায় ১৮ মার্চ একজন মৃত্যু বরণ করেন। প্রথম শনাক্ত হওয়ার দিন থেকে হিসেব করলে ১৮ জুলাই শনিবার ছিল ১৩৩ তম দিন। এ সময়ে আক্রান্ত, মৃত্যু, সুস্থতার হার পর্য্যালোচনা করলে দেখা যায়, নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার ১৯ শতাংশের কিছু বেশী, মৃত্যু হার ১.২৭ শতাংশের মতো। এর বিপরীতে সুস্থতার হার ৫৪ শতাংশের বেশী। অর্থাৎ আক্রান্তদের মধ্যে বেশীর ভাগ মানুষই সুস্থ হয়ে উঠছেন। এটি আশাব্যঞ্জক খবর।
মৃত্যুহার কম মানে এই নয় যে, কারও মৃত্যু কাম্য। যে কোন রোগে একজনেরও মৃত্যু কাম্য হতে পারে না।
কয়েকদিন ধরে দেখা যাচ্ছে, আক্রান্তের সংখ্যা কিছুটা কমতে শুরু করেছে। নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার কিছুটা বেড়েছে। তবে সেটি ২৪ থেকে ২৫ শতাংশের মধ্যে স্থির থাকছে। এছাড়া করোনার লক্ষণ উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুর সংখ্যা গত কয়েক দিনে হ্রাস পেয়েছে।
সব মিলিয়ে বলা যায়, আমরা পরিস্থিতির উন্নতির দিকে যাচ্ছি। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগষ্টের প্রথম বা দ্বিতীয় সপ্তাহের দিকে সংক্রমণ হয়তো কমে আসেত পারে। সেজন্য যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। অন্যথায় পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে। লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হলেও এখনও অনেকেই তা মানছেন না। মনে রাখতে হবে, যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব মেনে না চললে আমরা কোনদিনই এই রোগটি থেকে মুক্তি পাব না। আমাদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদ-উল-আজহা সমাগত। এই ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে অনেকেই হয়তো বাড়ী যাওয়ার কথা ভাবছেন। তাদের প্রতি আহ্বান থাকবে, অতি প্রয়োজন ছাড়া এ সময় ঘর থেকে বের হবেন না। ঘরে বসে ঈদের আনন্দ উপভোগ করুন। এছাড়া ঈদুল আজহা সামনে রেখে রাজধানী সহ সারা দেশে পশুর হাট বসবে। সুতরাং এই হাটে যারা পশু কেনাবেচার জন্য যাবেন, তাদের প্রতি আহ্বান থাকবে, সবাই যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি অবশ্যই পালন করবেন। সবশেষে বলবো, করোনা ভাইরাস নিয়ে কেউ আতংকিত হবেন না, বরং সতর্ক থাকবেন যাতে সংক্রমিত না হন।
এটি হলো ডা. এবি. এম আবদুল্লাহর বিশেষ লেখা। তিনি মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও উপদেষ্টা, করোনা প্রতিরোধ সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি।
ডা. আবদুল্লাহকে করোনা সংক্রান্ত বিষয়ে শুধু বিশেষজ্ঞ বলেই মনে করা যাবে না-তিনি এই রোগটির নিরাময় সংক্রান্ত নীতির প্রধান প্রণেতাও।
একেবারেই সাধারণ মানুষ হিসেবে বিনীতভাবেই বলতে চাই, দেশবাসীর মধ্যে কত ভাগ মানুষের করোনা টেষ্ট করা হলো আজতক? যদি তা মাত্র ১০-১২ লাখ হয়ে থাকে তবে তাঁর উল্লেখিত সংক্রমণের ও মৃত্যুর হারকে কি সঠিক বলা যাবে?
আরও জানতে ইচ্ছে করে করোনা টেষ্টের সংখ্যা বাড়ছে-নাকি কমছে? আসলে তো দেখা যায়, সর্বোচ্চ যে সংখ্যায় টেষ্ট কয়েক সপ্তাহ আগে করা হয়েছিল-তার বিপরীতে ইদানীং টেষ্ট অর্ধেকই কমানো হয়েছে। কারণটা জানা অত্যন্ত জরুরী। জানা জরুরী যে টেষ্ট না বাড়ালে বা বর্তমান হারে কমাতে থাকলে সংক্রমণ ও মৃত্যুর প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাবে কি না।
সরকার করোনা টেষ্ট করার জন্য ফি নির্ধারণ করেছেন-যা এতকাল ছিল না। এর ফলেও কি টেষ্টের সংখ্যা ক্রমশ কমে আসছে না এবং করোনা নিয়ন্ত্রণ-নিরাময়ের ক্ষেত্রে কি তা বিরুপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে না?
করোনা সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা বলে আসছেন, করোনা সংক্রমণ কোন লক্ষণ উপসর্গ ছাড়াও হতে পারে। তা হলে ৬৪ টি জেলার সবগুলিতে করোনা পরীক্ষার কিটস বা ব্যবস্থা না থাকা এবং পি সি আর ল্যাব সর্বত্র স্থাপন না করায় বস্তুত: আমরা করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যুর সঠিক সংখ্যা আদৌ জানতে পারছি না। তাই এ নিয়ে বিন্দুমাত্র আত্মতৃপ্তিতে না ভুগে বেশী বেশী মানুষের টেষ্ট করার ব্যবস্থা সর্বত্র প্রসারিত করা এবং দ্রুত সর্বত্র পি সি আর ল্যাব স্থাপন করা অত্যন্ত জরুরী।
এ ব্যাপারে তাবৎ দুর্নীতিরও মূল্যোৎপাটন এখনই করতে হবে-নইলে করোনা টেষ্টের ভূয়া রিপোর্ট আসতেই থাকবে এবং মানুষের অহেতুক মৃত্যুও বাড়তে থাকবে। আর এর জন্য সরকাকেই দায়ী থাকতে হবে।
সরকারিভাবে জনগণকে পরিপূর্ণভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে বলা হচ্ছে কিন্তু এ ব্যাপারেও নিম্নোক্ত প্রশ্নগুলি সঙ্গতভাবেই উল্লেখ করা যায়ঃ
এক. বিগত সাড়ে চার মাসেও কি সারাদেশের হাট-বাজারগুলিতে স্বাস্থ্যবিধি বেশীর ভাগ দোকানদার ও ক্রেতাকে মানতে দেখা গেছে? হাট-বাজারগুলিতে সে রকম কোন ব্যবস্থা কি রাখা হয়েছে? সিটি কর্পোরেশন, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদগুলি কি এ ব্যাপারে ন্যূনতম তৎপরতা আজতক কার্যকরভাবে দেখাতে পেরেছে?
দুই. যদি তা সম্ভব না হয়ে থাকে তবে ঈদ উপলক্ষ্যে সারা দেশে যে অসংখ্য পশুহাট বসবে সেগুলিতে ক্রেতা-বিক্রেতাদেরকে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে কি সংশ্লিষ্টরা আদৌ তৎপর থাকবেন? সরকার কি এ ব্যাপারে নিশ্চিত?
তিন. ঈদ মস্ত বড় একটি উৎসব-যাকে কেন্দ্র করে অসংখ্য মানুষ টাকা এবং অন্যান্য কর্মস্থল ছেড়ে ঐতিহ্যগতভাবেই নিজ নিজ এলাকায় যান এবং পশু কোরবানী দিয়ে থাকেন। ফলে সর্বত্র লোক সমাগম এমন হয় যেখানে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা কি আদৌ সম্ভব? এই বিবেচনায় এবং ঈদ পরবর্তী করোনা উল্লম্ফনের আশংকা এড়াতে এ বছর মানুষ বাঁচানো স্বার্থে কি কোরবানী বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া যেত না? সৌদি আরব যেখানে এবার প্রবিত্র হজ্জ্ব ব্রত পালন নিষিদ্ধ করেছে পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ ধর্ম প্রাণ মুসলিমদের জন্য সেখানে এবার কোরবানী বন্ধ করলে কি পবিত্র ধর্মের প্রতি অবমাননা করা হতো? অন্তত: পশুহাট কোথাও বসানো যাবে না বলে আদেশ দিলে?
চার. দেশের কোটি কোটি গরীব মুসলমানরা তো কোনবারই কোরবানী দিতে পারেন না-তবে কি তাঁরা খাঁটি মুসলমান বলে বিবেচিত হবেন না?
পাঁচ. লক্ষ লক্ষ বস্তিবাসী কি স্বাস্থ্যবিধি মানার ও কোরবানীর আর্থিক ক্ষমতা রাখেন? তাঁরা কি বস্তিতে সামাজিক দূরত্ব মানতে পারছেন?
এবারে আসাযাক স্বাস্থ্য অধিদফতর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি প্রসঙ্গেঃ
শুরুতেই স্বাস্থ্যমন্ত্রী, স্বাস্থ্য সচিব ও মন্ত্রণালয় এবং অধিদফতরের প্রধান কর্মকর্তাদেরকে ধন্যবাদ জানাতে হয় এ কারণে যে বাংলাদেশের করোনা টেষ্ট ও তার সার্টিফিকেট আজ তাঁদের কল্যাণে আন্তর্জাতিক শিরোনামে উত্তরণ ঘটিয়েছে। আরও ধন্যবাদ জানাতে হয় তাঁদেরকে তাঁদের খুঁটির জোর দেখে। যে খুঁটির জোরে তাঁরা এতদিনেও পদচ্যুত হন নি। অনেকে দাবী করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রীসহ তাঁদের সকলের পদত্যাগের। আমি চাই পদচ্যুতি-পদত্যাগ নয় কারণ বহুদিন যাবত তাঁরা মারাত্মক দুর্নীতি চালিয়ে আসছেন-কিংবা চালিয়ে আসতে সহায়তা করছেন। তারপরও তাঁরা দিব্যি নিজ নিজ গদীতে বসে আনে।
যারা সরাসরি দুর্নীতি করছে-তাদের চাইতে যিনি বা যাঁরা তাদেরকে দুর্নীতিবাজ হিসেবে গড়ে তুলছেন বা গড়ে উঠতে সহায়তা করছেন তাঁরা কি করে আজও শাস্তির বাইরে দিব্যি রয়ে যাচ্ছেন? দুর্নীতি বহু দেশেই হয়। করোনা নিয়ন্ত্রণে কোন কোন দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এ নিয়ে সে সব দেশের সংবাদ মাধ্যমগুলিতে তাঁদের সমালোচনা প্রকাশ হওয়ার সাথে সাথে তাঁরা পদত্যাগ করেছেন? আর আমাদের দেশে? পদত্যাগ তো দূরের কথা-পত্রিকায় রিপোর্ট করার দায়ে সাংবাদিক ও সংবাদপত্রকেই উপর মহল থেকে কখনও কখনও নানা ভাষায় আক্রমণ করা হয়ে থাকে এমন কি সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে জেলে পাঠিয়ে যধৎধংং ও করা হয় অনেক ক্ষেত্রে।
কিন্তু সত্যকে এড়ানো যাবে কিভাবে? ঐ যে বাজারে জাল মাস্ক, পিপিই প্রভৃতি যারা সরবরাহ করছে-সরবরাহ করছে বেশী দামে হাসপাতালগুলিতে সেগুলি যাঁরা ‘অলরাইট’ লেবাস লাগিয়ে কিনে নিচ্ছেন বা কিনতে সহায়তা করছেন-কীভাবে তাঁরা নিরাপদ থেকে যাচ্ছেন?
জানি, এমন প্রশ্ন উত্থাপন করে হয়তো কোন লাভ হবে না কারণ দুর্নীতির শিকড় আমাদের দেশে অনেক গভীরে। আর আছে আমলাদের রক্ষাকবচ (ইমিউনিটি) আইন।
তাই জনগণ অসহায়। সকল কিছুর অসহায় শিকার এ দেশের জনগণই।
কিন্তু জনগণ যেদিন রুখে উঠবেন? যেদিন শ্লোগানে শ্লোগানে রাজপথগুলি মুখরিত করে তুলবেন-সেদিন দুর্নীতিবাজরা মুখ লুকোবেন কোথায়? অতীতেও তাঁরা সফল হন নি-বর্তমানেও সফল হবেন না-ভবিষ্যতেও না।
সাহেদ-সাবরিনাদের শাস্তি চাই-শাস্তি চাই সকল রাঘব বোয়ালদেরও।
জিজ্ঞাসাবাদে তারা এযাবত যাদের নাম প্রকাশ করেছে-সেগুলিও প্রকাশ করা হোক। জনগণকে সুযোগ দেওয়া হোক তাদেরকে চিনতে।