শাহীন চৌধুরী ডলি’র গল্প –  শিকড় সন্ধানে

গল্প –  শিকড় সন্ধানে
-শাহীন চৌধুরী ডলি

নাড়ী মানেই শিকড়। মায়ের উদর থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর নাড়ী কেটে মায়ের সাথে অবিচ্ছেদ্য থাকা  শিশুকে আলাদা করা হয়। আগের সময়ে সদ্যজাত শিশুর নাড়ী পাতলা কাপড় দিয়ে প্যাঁচিয়ে বেঁধে রাখা হতো। মা বা বাড়ির বড়রা শিশুর নাড়ীর পরিচর্যা করতেন। কয়েকদিনের ব্যবধানে সেই নাড়ী আলগা হয়ে পড়ে যেতেই পরিবারের কেউ নাড়ীটি মাটির নিচে পুতে রাখতেন। যার যেখানে সেই নাড়ী পোতা আছে সেই জায়গাটা তার কাছে নিজের শিকড় বলে মনে হওয়াটা স্বাভাবিক।

ইয়াসমিনকে কয়েকদিন থেকে তার শিকড় বড্ড টানছে, সেই টান অস্বীকার করতে না পেরে ইয়াসমিন ইন্ডিয়ান হাই কমিশনে আগরতলা স্থলবন্দর দিয়ে যাওয়া আসার অনুমতি পেতে ভিসার আবেদনটা করেই ফেললো।

কয়েকদিনের বিরতিতে মোবাইলের নাম্বারে মেসেজ পেলো, আপনার ভিসা প্রস্তুত। কুপনে উল্লেখিত সময়ের পরে এসে পাসপোর্ট সংগ্রহ করতে অনুরোধ করা হচ্ছে।

যথাসময়ে হাই কমিশনে গিয়ে কুপনের বিনিময়ে পাসপোর্ট হাতে পেয়ে উল্টেপাল্টে দেখে ইয়াসমিন। হ্যাঁ আগরতলা স্থলপথ দিয়ে ভারতে প্রবেশের ভিসাটা তার তালুবন্দি। আগামী একবছর সে ছয়টি বন্দরের যেকোনটি ব্যবহার করে ভারতে প্রবেশ করতে পারবে। কিন্তু আগরতলা বন্দর ইয়াসমিনের কাছে বিশেষ অর্থ বহন করে।

শুক্রবার বন্ধের দিনে ভাতিজা অংকুরকে নিয়ে ইয়াসমিন বাসা থেকে বর্ডারের দিকে হওয়ানা হয় । সাথে তেমন কিছুই নেয় না। এক কাপড়ে যায়, কেবল প্র‍য়োজনীয় কাগজপত্র সাথের ভ্যানিটি ব্যাগে নিয়ে নেয়। সকালে গিয়ে বিকেলেই  নিজের কুঠিতে ফিরে আসবে। একটা ত্বরিত সফর তাকে ব্যাকুল হয়ে ডাকছে যা ইয়াসমিন এড়িয়ে যেতে পারছে না।

 

প্রথমে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কাউতলী বাসষ্ট্যাণ্ডের নিকটে পৌঁছুতেই অটোরিকশা চালকদের হাঁকডাক। কিয়ৎক্ষণ আগে ভোর হয়েছে। ডিমের কুসুমের মতন হলুদ সূর্যের আলোতে চারিদিক উদ্ভাসিত।

শেয়ারের অটোরিকশায় করে বর্ডারে গেলে জনপ্রতি একশ টাকা, রিজার্ভ গেলে চারশ। কেন জানি আজকের দিনটা অন্যরকমভাবে চলতে ইচ্ছে করছে। ইয়াসমিন রিজার্ভে না গিয়ে শেয়ারের অটোতেই অংকুরকে নিয়ে চেপে বসলো।

অংকুর ওপারের সব চিনে। কিছুদিন আগে গিয়ে বেড়িয়ে এসেছে। অটোরিকশা নিজের দেশের রাস্তা দিয়ে যাত্রা শুরু করেছে। ইয়াসমিন অনেকদিন এই দিকে আসেনি। অটো যখন চলতে শুরু করেছে তখন তার মনে শিকড় খুঁজে পাওয়ার আশা তাকে আরো বেশি চঞ্চল করে তোলে।

ইয়াসমিনের কাছে সারা বাংলার সব গ্রামের দৃশ্য প্রায় একইরকম লাগে। মসৃন সুন্দর পিচের রাস্তা দিয়ে তাদের অটোরিকশা যাচ্ছে। অটোতে বসে কোন ঝাঁকুনি নেই। ইয়াসমিনের মনে পিচওঠা এবড়োখেবড়ো, ভঙ্গুর রাস্তার ধারণা ছিল। ভুল ধারণাগুলো উবে যেতেই সে খুব আনন্দ নিয়ে গ্রামের পর গ্রাম দেখতে দেখতে মনে মনে গুনগুনিয়ে গেয়ে ওঠে –

“কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা, মনে মনে মেলে দিলেম গানের সুরের এই ডানা – মনে মনে।”

কাউতলী পার হতেই কুরুলিয়া খাল খুঁজতে থাকে ইয়াসমিন। অনেকবছর আগের দেখা কুরুলিয়া খাল কোথাও খুঁজে পায় না। কোথায় সেই স্রোতস্বিনী তিতাস আর কোথায় সেই কুরুলিয়া খাল! তারা মজে পচে গেছে। খননের অপারেশন করে তাদের জীবিত করার কাজটা কেউ করেনি। আমাদের মতন মানুষরাই লোভের বশে নদী-নালা,খাল-বিল মেরে ফেলছি — ইয়াসমিন ভেবে ভেবে দু:খ পায়।

ভাদুঘর পার হতেই শহর গ্রামের মিশেল দেখতে দেখতে এগিয়ে চলা। অটোরিকশা রাধিকা, সুলতানপুর পার হয়ে সিলেট-কুমিল্লা মহাসড়ক থেকে হাতের বামদিক দিয়ে বাঁক নিয়ে একটা গ্রামের ভেতরর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এখানেও কিছু বড় বড় স্থাপনা তৈরি হয়েছে। গ্রাম আর আগের মতন গ্রাম নেই, এখানে শহুরে হাওয়া লেগেছে। ইট পাথরে জরাজীর্ণ হচ্ছে শান্ত সুনিবিড় গ্রামগুলো। তবে সেই সাথে গ্রামের মানুষের শিক্ষাব্যবস্থা,কিৎসা,বসাসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা বাড়ছে।

আরো কিছুদূর যেতেই ভাতশালা রেলষ্টেশন পেরিয়ে পরিপূর্ণ একটা গ্রামে চোখ আটকে যাচ্ছে। বুক ভরে বিশুদ্ধ বাতাস ফুসফুসে টেনে নিতে নিতে ইয়াসমিন ভাবে –

আহ কি সুন্দর গ্রাম-বাংলা!কেন দেখা হয়না-

“ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া, একটি ধানের শীষের উপর একটি শিশির বিন্দু “!

সোনালি ফসলের হাসিতে উদ্ভাসিত প্রকৃতি। মাঠের পর মাঠজুড়ে পাকা ধানের মৌ মৌ গন্ধ। ফসল কাটার এখনি উপযুক্ত সময়। কোন এক অজানা কারণে ধান কেটে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছে না কৃষক।

প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টির মৌসুম চলছে, শিলাবৃষ্টি হলে তো কথাই নেই। ধানগাছ সব ক্ষেতেই শুয়ে অক্কা পাবে। তবু কৃষক পাকা ধান কেটে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছে না কেন? না বিস্ময়ের কিছু নেই,কারণটা ইয়াসমিনের জানা।

প্রথম কারণ ধান কাটার মজুর পাওয়া খুব কঠিন।একজন দিনমজুরকে প্রায় সাড়ে আটশ টাকা রোজ দিতে হয়, সাথে একবেলার খাবার। অথচ ধানের বাজারমূল্য খুব কম। চাষ করা থেকে শুরু করে ঘরে ফসল তোলা পর্যন্ত একজন কৃষকের যা খরচ তার অর্ধেক মূল্যও প্রতিমণ ধান বিক্রি করে উৎপাদন খরচ ফিরে পাওয়া যায় না, লাভ করার চিন্তা তো বাদই। তাই হতাশ কৃষক ধান না কেটে জমিতেই ফেলে রাখছে।

ইয়াসমিনের মন খুব খারাপ হয়ে যায়। সে কিছুদিন আগে পত্রিকায় ছবি দেখেছে, খবরে পড়ছে প্রতিমণ ধান চাষে কৃষকের যত খরচ প্রতিমণ ধান বিক্রি করে তার সমমানের মূল্য ওঠে আসেনা। লাভের গুড় পিঁপড়ে খায় এটাও ভাবা যায় না। খরচ যেখানে ওঠে না, সেখানে কিসের লাভ! তাই বাংলার হতাশ কৃষক প্রতিবাদস্বরূপ নিজের পাকা ধানের জমিতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। দাউ দাউ করে যখন পাকাধানে আগুন জ্বলছিল মনে হচ্ছিল যেন ধান নয়, কৃষক নিজে জ্বলে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাচ্ছিল। সে যেন নিজেকেই আত্মাহুতি দিচ্ছিল ।

এসব খরব মনকে দমিয়ে দেয়। কৃষিপ্রধান দেশ বাংলাদেশ, এদেশের কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে। এই সহজ সরল সমীকরণ বুঝতে সমর্থ না হওয়ার কথা নয়।

বুঝেছে, আর বুঝেছে বলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের দামাল ছেলেরা প্রখর সূর্যের তেজ মাথায় নিয়ে নিজেদের হাতে কাস্তে তুলে নিয়েছে। স্বেচ্ছাশ্রমে অনভিজ্ঞ ছাত্ররা পাকা ধান কেটে কৃষকের হাতে তুলে দিয়েছে। বিভিন্ন পেশা, শ্রেণীজীবীর মানুষ কৃষকের ফসলের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে দাবী দাওয়া নিয়ে রাস্তায় নেমেছে। ছাত্র, শিক্ষক, উকিল, পুলিশ সহ বিভিন্ন পেশার মানুষ কৃষকের জমির পাকা ধান কেটে দিয়েছে। কৃষকদের ধান কাটার মজুরি নিয়ে চিন্তা থেকে অব্যহতি দিয়েছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের টনক নড়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু যখন খবর শোনা যায় দেশে ধানের পর্যাপ্ত  উৎপাদন হওয়া সত্বেও সরকার বিদেশ থেকে ধান আমদানি করার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে না তখন দেশের সাধারণ মানুষ হতাশ হয়। তারা প্রতিবাদ করতে বাধ্য হয়।

ইয়াসমিন এমনি, সে কখন তার ভাবনাকে কোথায় কোন মুল্লুকে চড়িয়ে বেড়ায় নিজেও তার খেই পায় না।

ইয়াসমিন শুনতে পায় বউ কথা কও পাখি ডাকছে। আরে ওটা কি পাখি! কি সুন্দর হলুদ লেজ দুলিয়ে উড়ছে। রাস্তার পাশের প্রকাণ্ড কাঁঠাল গাছের কোটরে একটা বড় বেজি সপাং করে ডুকে গেলো। গাছটার পায়ের গোড়ালি থেকে মাথা অবধি অসংখ্য কাঁঠালে ছেয়ে আছে। গাছে গাছে ঝুলছে আম। জাম গাছের নিচে পাকা জাম পড়ে কালো হয়ে আছে। জনবসতি থেকে বেশ দূরত্বে বলেই হয়তো পাকা ফল সংগ্রহ করতে তেমন কেউ আসে না। ইয়াসমিনের খুব ইচ্ছে করে কয়েকটা জাম কুড়িয়ে নিয়ে ফরমালিন মুক্ত টাটকা জাম খেতে কিন্তু শেয়ারের স্কুটারে চড়ে অন্যদের অসুবিধা করা সঙ্গত না ভেবেই সেই সাধ অপূর্ণ রেখে বাইরে তাকিয়ে থাকে।

ধানক্ষেতের পাশ দিয়ে কি সুন্দর সমান্তরাল রেল লাইন। কিছুদূর যেতেই রেললাইন দুই দিকে ভাগ হয়ে গেছে। আখাউড়া থেকে একটা লাইন ভাগ হয়ে গেছে সিলেটের দিকে অন্যটা গেছে চট্টগ্রামের দিকে। ক্ষণিকের জন্য ইয়াসমিনের পথের পাঁচালীর দুর্গা বনে যেতে ইচ্ছে করে। রেললাইন ধরে দূর থেকে দূরে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে।

চোখের সামনে দিয়ে তীব্র হুইসেল বাজিয়ে ঝমঝমঝমঝম আওয়াজ তুলে সাঁ সাঁ করে একটা আন্তনগর মেইল ট্রেন চলে গেলো। ছোটবেলার কথা মনে পড়ে  ইয়াসমিনের। ট্রেনে করে কোথাও গেলে বাইরে মানুষ দেখলে তাদের টা টা দিত অথবা নিজে বাইরে থাকলে যদি তার সামনে দিয়ে চলন্ত ট্রেন যেতে দেখত তাহলে ট্রেনের মানুষদের উদ্দেশ্যে টা টা দিতো।তারাও তাকে টা টা দিতে দিতে দ্রুত মিলিয়ে যেতো। কোথায় হারিয়ে গেছে সেইসব দিন।এখন আর কিশোরীবেলায় ফেরা যায় না। প্রজাপতি ডানা মেলে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা হয় না।

 

আখাউড়ার এদিকে আগে তিতাসের শাখায় চিকচিক করতো পানি। তিতাস নদীর শাখাগুলো আর আগের মতন দৃশ্যমান নয় । কিছু শাখার অস্তিত্বই নেই। সেগুলোতে এখন ফসলের চাষ হয়। কিছু কিছু শীর্ণকায় হয়ে তির তির করে বয়ে যাচ্ছে। জলের ক্ষীণ ধারায় মাছ ধরার চেষ্টা করছে কেউ কেউ। মিঠা পানির দেশ থেকে মিঠা পানির মাছ হারিয়ে যাচ্ছে। এখন যা কিনতে পাওয়া যায় তার বেশিরভাগই চাষের মাছ।

 

নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদী মজে পচে যাচ্ছে। পানির স্রোত নেই,নদী ড্রেজিংয়ের ব্যবস্থা নেই। আছে নদীর পাড় দখলের উৎপাত। অবশ্য আশার কথা যে, ইদানীং দেশের সরকার বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ সহ বেশ কিছু নদীর পাড় থেকে অবৈধ দখলদারদের স্থাপনা গুড়িয়ে দিয়ে নদীর জায়গা নদীকে ফিরিয়ে দিতে তৎপর হয়েছে। এই প্রচেষ্টা এবং নদী সংরক্ষণ অব্যাহত থাকুক।

হু হু করে দুইপাশ থেকে বাতাস এসে বিক্ষিপ্ত ব্যাকুল মনকে জুড়িয়ে দিতে চেষ্টা করছে। হারানোর খেদগুলো উড়িয়ে দিতে চাইছে। মনে প্রশান্তির আবেশ অনুভব করানোর অব্যাহত চেষ্টায় ইয়াসমিন ভাবনাগুলোকে পরিবর্তন করতেই সহযাত্রীদের সাথে গল্প জুড়ে দিলো। গল্প করতে করতেই অংকুর হাতের আঙ্গুল উচিয়ে ইয়াসমিনকে বলছে-

আন্টি ওই যে বর্ডার দেখা যাচ্ছে, আমরা এসে গেছি।

ওম্মা!এতো কাছে ভারত!

মাত্র চল্লিশ মিনিটেই ইয়াসমিনদের বহনকারী অটোরিকশা আগরতলা বর্ডারের বাংলাদেশ অংশে এসে থামলো। পুরোটা রাস্তা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ছায়াময় মায়াময়। প্রথম দেখাতেই ইয়াসমিনের কণ্ঠে মুগ্ধতা ঝরে পড়ে। সে অনেকবার বাই রোডে ভারত গিয়েছে। বেশিরভাগ সময় বুড়িমারী-চ্যাংড়াবান্ধা বর্ডার ব্যবহার করেছে। সেই রোডের সাথে তুলনা করলে এ তো স্বর্গ!

বাংলাদেশ সীমান্তে প্রবেশ করে সরকারের নির্ধারিত ট্যাক্স টোকেন কেটে ইমিগ্রেশনে প্রবেশ করতেই ইমিগ্রেশন অফিসার মুর্শেদের হাসিমাখা মুখে অভ্যর্থনা পেয়ে ইয়াসমিনের খুব ভালো লাগে। মুর্শেদ অংকুরের বন্ধু, হাসিখুশি মুখে সে তার কাজ করে যাচ্ছে। অন্যান্য সবাই খুব আন্তরিক এবং কর্মঠ কর্মী।

নির্বিঘ্নে কাষ্টমস পেরিয়ে নো ম্যানস ল্যান্ড দিয়ে অংকুরের সাথে অগ্রসর হয় ইয়াসমিন। চারিদিকে গাছ আর গাছ। বাংলাদেশ ভারতের আগরতলা সীমান্তবর্তী এলাকা বড় বড় গাছের ডালপালার সবুজে ছেয়ে আছে। মধুর স্বরে পাখি ডাকছে। ছায়া সুনিবিড় পরিবেশ কি যে ভালো লাগে!

ভারতের ইমিগ্রেশন, কাষ্টমস সব একই ছাদের নিচে।ঝকঝকে তকতকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন সুদৃশ্য বিল্ডিংয়ের সুসজ্জা দেখে খুব ভালো লাগে ইয়াসমিনের। যেন কোন একটা ডোমেষ্টিক এয়ারপোর্টে চলে এসেছে। কোথাও কারো মাধ্যমে বিরক্ত হওয়া নেই। সচরাচর অন্যান্য স্থলবন্দর দিয়ে প্রবেশ করলে কমবেশি হ্যারেসমেন্টের ব্যাপার থাকে যা আগরতলা স্থলবন্দরে ইয়াসমিনের চোখে পড়েনি।

বন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষে ভারতের মাটি দিয়ে কয়েককদম এগিয়ে গিয়েই তারা একটা বাড়িতে প্রবেশ করে। আরবি হরফের কোরিওগ্রাফি দিয়ে পাথর আর টাইলসে করা কারুকাজ স্থাপন করা আছে সদর গেইটের স্তম্ভে। পাশের বাড়িটিও প্রায় একই রকমে তৈরি করা।অংকুর যে বাড়িতে প্রবেশ করলো তা তার এক বন্ধুর বাড়ি।

অংকুরের বন্ধু অতিশয় ব্যস্ত মানুষ। তিনি রাজনৈতিক দলের নেতা, তৃণমূল কংগ্রেস থেকে নির্বাচন করছেন। নির্বাচনী কাজে দলীয় লোকজন নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। বাড়ির উপরতলায় পরিবার নিয়ে তাদের নিজেদের বসতি, নীচতলা পার্টি অফিস। বড় বড় নির্বাচনী ব্যানারে ছেয়ে আছে বাড়িসহ আশেপাশের এলাকা। এত ব্যস্ততার মাঝেও তিনি সময় দিলেন। আশ্বাস দিলেন, যে কোন প্রয়োজনে তিনি নিজেকে নিবেদন করতে পারলে খুশি হবেন। কিভাবে কোথায় যেতে হবে তা তিনি বুঝিয়ে দেন, ঠিকানা বলে দেন।

 

আলাপ আলোচনা শেষে বিদায় নিয়ে ইয়াসমিনরা সেখান থেকে বের হয়ে অটোষ্ট্যান্ডে আসতেই শেয়ারের একটা অটো যাত্রী তুলতে ডাকছে। সেখানে আগে থেকেই একজন যাত্রী বসে আছে। অংকুর এবং ইয়াসমিন পাশে যেয়ে বসতেই অটো চলতে শুরু করলো। আলাপকালে জানা গেলো পাশের যুবক ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রামরাইল থেকে এসেছে। সারাদিন ত্রিপুরা শহরে বেড়িয়ে বিকেলে বর্ডার বন্ধ হওয়ার আগেই বাড়ি ফিরে যাবে। আগরতলা ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা থেকে স্বল্প দূরত্বের হওয়ায় এবং পাসপোর্টের মাধ্যমে অফিসিয়ালি পোর্টের কাজ শুরু হওয়ার পর থেকে এই স্থলবন্দর দিয়ে লোক যাতায়াত বহুগুণ বেড়েছে। দুই দেশের বিভিন্ন পণ্য আমদানি-রপ্তানির পরিবহন তো আছেই।

অটো এসে ত্রিপুরা শহরের বটতলায় এসে থামতেই বাংলাদেশী যুবক দশ রুপি ভাড়া মিটিয়ে নেমে গেলো। ইয়াসমিন চালককে জানালো তারা দুজন ইন্দ্রনগর ব্রিজের কাছে যেতে চায়। কমবয়সী অটোচালকের চাওয়ামাফিক চল্লিশ রুপি ভাড়ায় তারা ছুটলো শহরের অদূরে ইন্দ্রনগরের দিকে। যেতে যেতে অটোচালকের কাছ থেকে ত্রিপুরা শহরের দর্শনীয় স্থানগুলো সম্পর্কে জেনে নিয়ে চলতি পথে সেগুলো দেখতে দেখতে এগিয়ে যাচ্ছে। অংকুর আগেও এসেছে বিধায় সে ত্রিপুরার ঐতিহাসিক কিছু জায়গা চেনে।

ইন্দ্রনগরের প্রসঙ্গে পরে আসছি। ইয়াসমিনরা ইন্দ্রনগরে যাওয়া- আসার মাঝে কিছু দর্শনীয় স্থান দেখেছে, তবে স্বল্প সময়ে বেড়ানো সম্ভব হয়নি। ইয়াসমিনের আসল উদ্দেশ্য যে জন্মের পরে তার নাড়ি কোথায় পোঁতা আছে তার সন্ধান করা। তবে ভ্রমণ পিপাসু ইয়াসমিন কিছুদিনের মধ্যেই আগরতলার দর্শনীয় স্থানগুলো ভ্রমণের জন্য বের হবে, সাথে সঙ্গী থাকবে ইয়াসমিনের বাবা-মা। তখন তার উদ্দেশ্য হবে বাবা-মাকে নিয়ে পুরো ত্রিপুরা চষে বেড়ানো। আজকে বেড়ানোর ব্যাপারটা সে মুলতবি রেখে দিলো।

রমজান মাস চলছে। ইয়াসমিন রোজা রেখে জার্নিতে বেরিয়েছে। সূর্যের প্রচণ্ড তাপদাহে যেন তাদের মাথার মগজ গলে পড়ার অবস্থা। ঘর্মাক্ত শরীরে ক্লান্তি জাঁকিয়ে ধরছে। তাপের কারণেই হয়তো রাস্তাঘাটে মানুষের চলাচল কম। গনগনে সূর্যের তাপে উওপ্ত বালিতে অনায়াসে মুড়ি ভাজা যাবে।

অটো এসে একটা ব্রিজের কাছে থামতেই চালক বললো, আমরা এসে গেছি। এটা ইন্দ্রনগর ব্রিজ। ভাড়া মিটিয়ে নেমে অংকুর এক দোকানীকে জিজ্ঞেস করলো,

সোহান নামের কাউকে চিনে কিনা? সোহানদের বাড়ি কোনটা?

সোহান স্থানীয় রাজনীতির সাথে জড়িত। ইন্দ্রনগর এলাকায় বাড়ি। তাকে স্থানীয় লোকজন বেশ ভালোই চিনে। সমস্যা হলো এই ব্রিজের কাছাকাছি হাতেগোনা মাত্র কয়েকটি স্থায়ী দোকান আছে। ভরদুপুরের বেলা বলেই কিনা এক দুটি দোকান ছাড়া বাকীগুলো সাটার লাগিয়ে তালা ঝুলিয়ে বন্ধ করা।

পাশেই খাবারের একটা ছোট দোকান। দোকানি দুইজনের একজন পুরুষ এবং একজন মেয়ে। তাদের খুব আন্তরিক মনে হলো। তারাও সোহানকে চিনতে পারলো না। তখন ইয়াসমিনের মনে সন্দেহ হলো, তারা ঠিক জায়গায় এসেছে তো!

ইয়াসমিন দোকানের ভেতরে প্রবেশ করে চেয়ার টেনে বসে অংকুরকে পাশের চেয়ারে বসার ইঙ্গিত দিতেই অংকুর একটা চেয়ারে বসলো। অংকুর সেই সকাল থেকে না খেয়ে আছে। অংকুরের জন্য খাবারের অর্ডার দিয়ে তাকে খেতে বলে ইয়াসমিন দোকানী মেয়েটার সাথে গল্পে মেতে উঠলো।

ইয়াসমিন কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলো

— আচ্ছা দিদি, বলতো এই ব্রিজের নাম কি?

দিদি এটা তো অভয়নগর ব্রিজ। তা তোমরা কোথায় যাবে? আর ওই যে সোহান নামে একজনের খোঁজ করছিলে, তার বাড়ির ঠিকানা বলো তো দেখি।

ইয়াসমিন এবং অংকুর যেন আকাশ থেকে পড়েছে, এভাবেই চমকে উঠে একসাথে বলে উঠলো, তার মানে অটোরিকশা চালক তাদের সাথে চালাকি করেছে। ইন্দ্রনগর ব্রিজ পর্যন্ত না যেয়ে তাদের অভয়নগর ব্রিজের গোড়ায় নামিয়ে দিয়ে ভাড়া নিয়ে চলে গেছে। তারা এদিকের জায়গাগুলো চেনে না বুঝতে পেরে মূল গন্তব্যে না যেয়ে তাদের পথিমধ্যে নামিয়ে দিয়েছে। সে প্রতারণা করেছে। ইয়াসমিনরা একটা ব্রিজ দেখেই চালকের কথায় বিশ্বাস করে নেমেছে। এটা অভয়নগর ব্রিজ নাকি ইন্দ্রনগর ব্রিজ তা তাদের জানার কথা নয়। অংকুর ত্রিপুরায় এলেও এদিকটাতে আগে কখনো আসেনি।

দোকানীরাও চালকের ব্যবহারে বিরক্তি প্রকাশ করে বললো, দিদি চিন্তা করো না, তোমাদের একটা রিকশা ঠিক করে দিবো। সে একদম ইন্দ্রনগর ব্রিজে নিয়ে তোমার আত্মীয়ের ঠিকানা বের করে পৌঁছে দিয়ে আসবে।

অংকুরের খাওয়া শেষ হতেই তারা একটা রিকশা পেয়ে গেলো। দোকানী মেয়েটি রিকশাওয়ালাকে ঠিকানা বুঝিয়ে দিয়ে ভাড়া নির্ধারণ করে দিলো। মেয়েটি বিদায় দিতে দিতে বার বার ইয়াসমিনকে অনুরোধ করলো, আবার কখনো আগরতলা এলে যেন তার সাথে অবশ্যই দেখা করে যায়। মেয়েটির ব্যবহার তাদের খুব ভালো লাগলো।

রিকশায় চড়ে ইয়াসমিন রিকশাওয়ালার সাথে গল্প জুড়লো। কিছুক্ষণের মধ্যে তারা ইন্দ্রনগর ব্রিজের কাছে আসতেই রিকশা দাঁড় করিয়ে পাশের একটা দোকানে যেয়ে সোহানের নাম বলে বাড়ির ঠিকানা জিজ্ঞেস করতেই তারা পূর্ণদ্যেমে রিকশাওয়ালাকে সোহানের বাড়ির ঠিকানায় পৌঁছুতে কোন রাস্তায় যেতে হবে তা বাতলে দিলো।

সেদিন যেহেতু জুম্মাবার ছিল অনেকেই ভরদুপুরে জুম্মার নামায শেষে মসজিদ থেকে বাড়ি ফিরছে। তাদের একজনকে সোহান সম্পর্কে বলতেই তিনি সোহানদের বাড়ির দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়ে বিদায় নিলেন।

সোহান ইয়াসমিনের জ্যাঠাত বোন আনোয়ারা বেগমের ছেলে। আনোয়ারার বাবার দিকের খুব কাছের কোন আত্মীয় স্বজন বলতে গেলে সেদেশে নেই। তিনি তার নিজের রক্তের কাকাত বোনকে কাছে পায়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়লেন। ইয়াসমিন বিনা নোটিশে এসে তার বাড়িতে হাজির হবে তা আনোয়ারার কল্পনাতেও ছিল না। বোনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন। দুই বোনের দীর্ঘ বিরহের পর মিলনে খুশির কান্না যেন বাঁধ মানেনা। বাড়ি ভর্তি লোকজন আগন্তুক দেখতে জড়ো হয়ে গেলো।

একটু ধাতস্থ হতেই আনোয়ারা বোনের জন্য কি করবেন না করবেন তা নিয়ে ব্যস্তসমেস্ত হয়ে পড়লেন। তার বয়স প্রায় ষাটের কাছাকাছি। স্বামী সন্তানদের নিয়ে সুখের সংসার। এক মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন। তিন পুত্র, পুত্রবধু, নাতি, নাতনি, ভাসুর, দেবর তাদের সন্তানরা সবকিছু মিলিয়ে পরিপূর্ণ জীবন।

আনোয়ারা পুত্রবধূদের বললেন ইয়াসমিনের সাথে থাকা ভাতিজা অংকুরের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করতে। ইয়াসমিন রোজাদার, নামাযের ওয়াক্ত তাই জোহর নামাযের ইচ্ছে প্রকাশ করতেই বোন অজুর ব্যবস্থা করতে ফ্রিজ থেকে বড় ঠান্ডা পানির বোতল নামিয়ে দেন। ইয়াসমিনের মুখ রোদে পুড়ে লাল হয়ে গেছে। মনোয়ারা ঠান্ডা পানি দিয়ে নিজহাতে বোনের মুখ ধুইয়ে দেন। নামায আদায়ের জন্য জায়নামায বিছিয়ে দেন।

নামাযের পর ইয়াসমিনের বোন এবং দুলাভাই তাকে নিয়ে বসে বাংলাদেশের সবাই কে কেমন আছে খবরাখবর জানতে চান। অনেক বছর অনেকের সাথে দেখা নাই বলে আক্ষেপ করেন। বর্তমানের যুগ ইন্টারনেটের যুগ। ছেলেদের কাছ থেকে ইন্টারনেটের কল্যাণে অনেকের সাথে কথা বলা এবং দেখার সুযোগ হয় — একথা জানান। আগের চেয়ে ভারত-বাংলাদেশের আসা যাওয়ার পদ্ধতি অনেক সহজ হয়েছে এতে স্বস্তি বোধ করেন। মনোয়ারা তার বাবার বাড়ির স্বজনদের সাথে আবার পুনঃযোগাযোগ, দেখা সাক্ষাতের সম্ভাবনা জেনে পুলকিত হন।

ইয়াসমিন তার ত্রিপুরা আসার কারণ বোনকে জানায়। ১৯৭১ সালের যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ইয়াসমিন ত্রিপুরার ইচামোয়া (কাশিপুর) নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেছিল। পরবর্তীতে বাবা-মায়ের সাথে কয়েক মাসের শিশুকে বাংলাদেশে ফিরতে হয়েছিল। ইয়াসমিন নিজেদের যে বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেছিল এবং তার নাড়িটা যেখানে পোঁতা হয়েছে সেই জায়গায় শশরীরে যেয়ে স্বচক্ষে দেখার বাসনা জানায়। সে এও জানায় আজকে বিকেলেই বর্ডারের কার্যক্রম বন্ধ হওয়ার আগেই বাংলাদেশে ফিরে যাবে।

আনোয়ারা বেগম বোনকে কিছুতেই ছাড়তে রাজি নন। ইয়াসমিনের দুলাভাই সহ ভাগিনারা এবং তাদের বউরা সকলেই থেকে যেতে আবদার করতে লাগলো। সোহানের আট বছরের ছেলে ইয়াসমিনকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলো — দিদি তুমি থেকে যাও প্লিজ। দিদি তুমি যেয়ো না প্লিজ। ইয়াসমিনের চোখ দুটো নাতির স্পর্শে ও আবদারে আদ্র হয়ে ওঠে।

ইয়াসমিনের জন্মের সময় আনোয়ারা বেগম ছিলেন কিশোরী। আনোয়ারা তার স্মৃতির ঝাঁপি খুলে দিলেন। তিনি বলছেন আর ইয়াসমিন শুনছে –

বইন তুই কি জানস আমাদের নিজেদের দেশ ভারত। আমাদের দাদা-দাদী, নানা-নানি, চৌদ্দগুষ্টির জন্মস্থান ভারতের ত্রিপুরা। আমাদের গ্রামের নাম ইচামোয়া (কাশিপুর)। হ্যাঁ, কাশিপুরের কথা ইয়াসমিন তার বাবার কাছে বহুবার শুনেছে।

আনোয়ারা বেগম বলতে থাকেন-

ইচামোয়ায় আমরা হিন্দু মুসলিম সবাই মিলেমিশে বসবাস করতাম। একের বিপদে অন্যে এগিয়ে আসতো। কিন্তু ভারতের বৃটিশ শাসনের শেষ মাসগুলোতে গৃহযুদ্ধ লেগে যায়। বৃটিশরা ভারতে তাদের নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেয়ায় ভয়ানক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। এইসময় ভারতীয়রা আইন নিজের হাতে তুলে নিয়েছিল।

১৯৪৬ সালের আগষ্টের ১৬ তারিখ কলকাতায় ভয়ানক গণহত্যা শুরু হয়। এই দিবসটি ছিল ডাইরেক্ট আ্যাকশন দিবস। সেদিন মুসলমানরা যখন বিরাট সমাবেশে তাদের মহান নেতাদের ব্যাখ্যা শুনছিলেন তখনই এই গণহত্যা শুরু হয়েছিল। হিন্দু ও মুসলিমরা তাদের ধারালো অস্ত্র নিয়ে একে অন্যের মুখোমুখি দাঁড়ালো। ক্ষমতা চলে গেলো কলকাতার অপরাধ জগতের লোকদের হাতে। বাজারগুলো মরা মানুষে ভরে গেলো। চারিদিকে শুধু লাশ আর লাশ। যারা আহত হয়ে পড়েছিল তারা গ্যাংগ্রিনে আক্রান্ত হয়েছে, অনেকে চোখের সামনে এত নৃশংসতা সহ্য করতে না পেরে পাগল হয়ে গেছে। কলকাতার এই ঘটনায় চার হাজার হিন্দু ও মুসলিম নিহত হয়েছিল।

তখনকার সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী প্রায় ৫০,০০০ লোক হতাহত হয়েছিল। কলকাতায় মুসলিমদের হত্যার খবর তৎকালীন পূর্ব বাংলার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৪৬ সালের আগষ্ট মাসে নোয়াখালি ও ত্রিপুরা জেলায় মুসলমানদের মধ্যে তীব্র উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। এতে ভয় পেয়ে পূর্ব বাংলার হিন্দুরা ঘরবাড়ি ছাড়তে থাকে। কলকাতার হিন্দু সংবাদপত্রগুলো রিপোর্টারদের অতিরঞ্জিত খবর ছাপতে থাকে। এদিকে বিহারে নোয়াখালি গোলযোগের ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়। কংগ্রেস মন্ত্রীসভার উদ্যোগে বিহারে ‘নোয়াখালি দিবস’ পালিত হয়। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ৩০ অক্টোবর থেকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত মুসলমানদের হত্যা করা হয়।

যে হিন্দু মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে পুরুষানুক্রমে হৃদ্যতা ছিল, পরস্পর বিশ্বস্ততার সাথে বিহারে বসবাস করে আসছিল, অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে হঠাৎ করে হিন্দুদের এক বিরাট উচ্ছৃংখল জনতা মুসলমানদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই নৃশংস হত্যাযজ্ঞে প্রায় সাত থেকে আট হাজার মুসলিম নারী, পুরুষ ও শিশু নিহত হয়। মহিলাদের উপর সীমাহীন ধর্ষণের ঘটনা ঘটে।

আনোয়ারা বেগম বলতে থাকেন, ইতিহাসের সেই কালো অধ্যায় সম্পর্কে তৎকালীন অনেক লেখক লিখে রেখে গেছেন। তোরা আজকের প্রজন্ম, নিজের শেকড় সম্পর্কে বিশদ জানতে হলে তখনকার সত্য কাহিনী জানতে হলে ইতিহাসসমৃদ্ধ বইপত্র পড়তে হবে।

তখনও আমাদের পূর্বপুরুষ ভারত ছাড়েনি। যতগুলো ভারত -পাকিস্তান যুদ্ধ হয়েছে , সেগুলো হিন্দু -মুসলমান যুদ্ধ ছাড়া আর কিছু নয়। বৃটিশরা ভারতবর্ষ ছাড়ার আগে চক্রান্ত করেই দেশটিকে আরো তছনছ করে দিয়েছে। নেতারা সহায়তা না করে শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছেন। এই কারণে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা আরো বিস্তৃত হয়েছে। ভারতে এই দাঙ্গা ক্ষণে ক্ষণে মহামারীর রূপ নেয়। অসাম্প্রদায়িক যারা তারা চোখ বন্ধ করে ভাবেন এই সংকট কেটে যাবে। কিন্তু তা হয়নি।

কবি কাজী নজরুল ইসলাম দাঙ্গা নিয়ে কালজয়ী কবিতা রচনা করে গেছেন। এই কবিতায় তিনি লিখেছেন-

“উদিবে অরুণ ঘুচিবে ধন্দ

ফুটিবে দৃষ্টি টুটিবে বন্ধ

হেরিবে মেরেছে আপনার ভয় বন্ধ করিয়া দ্বার!

ভারত ভাগ্য করেছে আহত ত্রিশাল ও তরবার।”

গায়ক আব্বাসউদ্দীন মৃণালকান্তি ঘোষের সঙ্গে একত্রে গান গেয়েছেন –

“ও ভাই হিন্দু মুসলমান,

হিংসায় গড়া তলোয়ারগুলি ভেঙে করো খান খান।

তোমরা যে ভাই বাংলার আশা

দু’জনার দোহে দাও ভালোবাসা

অবিশ্বাসের প্রাচীর গড়িয়া কর নাকো অপমান।”

জাতিগত দাঙ্গা থামেনি। এরপর গেলো ১৯৫০ সালের দাঙ্গা। তারপর আবার ১৯৬৪ সালের হিন্দু মুসলমান রায়ট। সেই রায়টের আঁচ দাউ দাউ করে বাড়তে থাকে। হিন্দু মুসলিমের মাঝের তীব্র দাঙ্গায় ভারতে অবস্থানরত মুসলিমরা এবং পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত হিন্দুরা প্রাণভয়ে ভীত হয়ে সহায় সম্পত্তি ফেলে, চোখের পানিতে ভাসতে ভাসতে দেশত্যাগ করতে থাকে। ভারত থেকে মুসলিমরা দলে দলে পূর্ব বাংলায় প্রবেশ করে এবং পূর্ব বাংলার হিন্দুরা দলে দলে ভারতে প্রবেশ করে। নিজের দেশ ছেড়ে পরদেশে তারা রিফুজি হয়ে যায়।

আনোয়ারা বেগম জোরে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন, তারপর বলতে থাকেন। ছোটকাকা মানে তোর বাবা ১৯৬৫ সালে সিদ্ধান্ত নেয় ভারতে আর নয়। এখানে প্রতি পদে পদে মৃত্যু যেন ওত পেতে আছে। তিনি সব আত্মীয়স্বজনকে বুঝাতে থাকেন। কাকার তখন মাত্র ১৮ বছর বয়স। লম্বা ফর্সা ছিপছিপে দীর্ঘ গড়ন। অতি অল্প বয়সেই কাকার বিশেষ ব্যক্তিত্ব তৈরি হয়েছিল। তারুণ্যের শক্তিতে তিনি নতুন দেশে যেয়ে সকলকে নিয়ে নতুনভাবে বাঁচার এবং প্রতিষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। আমাদের দাদা ছোটকাকার কথায় রাজি হন।

ভারতে চৌদ্দ গুষ্টির ভিটেমাটি, জমিজমা সব ফেলে রেখে পূর্ব বাংলায় চলে যেতে হবে – একথা তোর বড় জ্যাঠা মানে আমার বাবা কিছুতেই মানতে পারছিলেন না। তখন আমার বয়স ২/৩ বছর হবে। আর কোন ভাইবোন নেই। সারাবাড়ি টুকটুক করে হাঁটি। আমার

নানাবাড়িও আগরতলায়। আমার মা তাদের একমাত্র সন্তান। তারা কিছুতেই নিজেদের মেয়েকে অন্যদেশে রিফুজি হতে দিতে রাজি হলেন না। বাবাও সিদ্ধান্ত নিলেন, মরি বাঁচি নিজের দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও যাবো না।

এরপর আসে সেইক্ষণ, ১৯৬৫ সালের ১৮ ডিসেম্বর। ১৮ বছরের তরুণ ছোটকাকা দাদা-দাদী সহ আরো অনেক অনেক আত্মীয়স্বজন মিলে ভারত থেকে সসড়কপথে পূর্ব বাংলায় চলে গেলেন। রয়ে গেলাম শুধু বাবা-মা আর আমি। দাদা দাদী ফুফু কাকাদের কান্নায় আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠলো। কাকা আমাকে কোলে নিয়ে কপালে চুমু দিয়ে মায়ের কোলে দিয়ে দিলেন এবং হনহন করে হাঁটতে লাগলেন। শত কান্নার রোলেও তিনি আর পিছু ফিরে তাকাননি। তার নেতৃত্বে তার পেছন পেছন সারিবদ্ধভাবে এগিয়ে যেতে থাকলো পূর্ব বাংলায় নতুন করে জীবন সাজানোর স্বপ্নদ্রষ্টারা।

— আমি বড় হওয়ার পর মা আমাকে এই কথাগুলো অনেকবার বলেছে।

আনোয়ারা বলতে থাকেন, পূর্ব বাংলায় গিয়ে বাংলাদেশের স্রোতে নিজেদের মিশিয়ে নিলো আমাদের পরিবার। রায়ট গেলো,দাঙ্গা গেলো, হিন্দু মুসলমান আবারো মিলেমিশে থাকা শুরু হলো। কিন্তু বিধিবাম, ১৯৭১ সালে পূর্ব বাংলায় শুরু হলো গণহত্যা। ১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের পাক বাহিনীর দ্বারা আক্রান্ত হয়ে পূর্ব বাংলার বাঙ্গালী চুপ করে বসে থাকেনি। মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের আহবানে সাড়া দিয়ে দেশমাতাকে রক্ষায় মহান মুক্তির যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে বীরবাঙালী।

যার যা আছে তাই নিয়ে ছাত্র শিক্ষক তরুণ যুবা কৃষকসহ সব পেশার মানুষ, সব ধর্মের মানুষ দেশরক্ষায় নিজেদের সর্বাত্মকভাবে আত্মনিয়োগ করে। এই গণহত্যা শুরু হয় ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ। পাকিস্তানি বর্বরদের হামলায় লক্ষ লক্ষ শহীদের রক্তে রঞ্জিত হয় পূর্ববঙ্গের মাটি। পাকসেনাদের দ্বারা বহু মা-বোন ধর্ষণ এবং নির্যাতনের শিকার হয়। দলে দলে মানুষ আশ্রয়ের আশায় বাঁচার তাগিদে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আশ্রয় নেয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের তৎকালীন সরকার বাংলাদেশের সাথে সংযুক্ত থাকা সকল সীমান্ত খুলে দেয়। তারা সৈন্য, গোলাবারুদ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করে।

ছোটকাকা তখন ২৪ বছরের টগবগে যুবক। এর দুই বছর আগে বিয়ে করেছেন। কাকী তখন সদ্য গর্ভবতী। ঢাকার শুক্রাবাদ থেকে কাকা কাকীকে সাথে নিয়ে গ্রামের বাড়ি আখাউড়ায় আসেন। তিনি স্ত্রীকে বাড়িতে রেখে মুক্তিযুদ্ধে যাবেন, এমন সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। বৃদ্ধ বাবা-মা (দাদা-দাদী)কিছুতেই সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে এই অবস্থায় রেখে ছেলেকে যুদ্ধে যেতে দিতে রাজি নন। ছোটকাকী তখন মাত্র ১৪ বছরের কিশোরী।

 

কাকা সিদ্ধান্ত নিলেন স্ত্রী এবং বৃদ্ধ বাবা- মা কে নিয়ে আগরতলা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে পূর্ববঙ্গ থেকে পালিয়ে ভারতে প্রবেশ করবেন। তখন এপ্রিল মাস,তিনি সকলকে নিয়ে আগরতলা চলে আসলেন। ত্রিপুরার পশ্চিম নোয়াবাদী এলাকায় শরনার্থীদের সহায়তায়  রিফুজি ক্যাম্প খোলা হয়েছে। ভারতের ত্রান-পূনর্বাসন অধিদপ্তর এবং রেডক্রসের যৌথ উদ্যোগে খোলা রিফুজি ক্যাম্পে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যোগ দিলেন ছোটকাকা। তিনি অসহায় রিফুজিদের সাহায্যার্থে নিজেকে সর্বাত্মকভাবে নিয়োগ করলেন।

 

আনোয়ারা বলতে থাকেন আর ইয়াসমিন গভীর আগ্রহ নিয়ে নিজেকে একনিষ্ঠ শ্রোতা করে শুনে যায় –

১৯৭১ সালের সেই সময় আবার দাদা-দাদী, কাকী, ফুফুরা সবাই মিলে তখন আমরা কাশিপুরে আমাদের নিজেদের বাড়িতে থাকি। অনেকদিন পরে মা-বাবা, ভাই-বোনদের পেয়ে আমার বাবা খুব খুশি। আমার মা তো আনন্দে কাকীকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে থাকে। তখন তুই কাকীর পেটে। কাকার সাথে কাশিপুরের যোগাযোগ বলতে মাঝে মাঝে আসে। সবাইকে দেখে যায়। বাড়ি থেকে ধান- চাল নিয়ে শরনার্থী আশ্রয়কেন্দ্রের মানুষদের সহায়তা করে। বাড়ি বাড়ি, দোকানে দোকানে গিয়ে চাঁদা তুলে। সেই টাকায় খাবার, কাপড়, ঔষধ কিনে। বিত্তবানদের কাছে থেকে পুরানো কাপড় চেয়ে আনে। সেগুলো দিয়ে শরনার্থীদের সাহায্য করে।

যুদ্ধ প্রায় শেষের দিকে। আমিও তখন বড় হয়ে উঠছি।স্কুলে যাই, অনেক কিছু বুঝি। আকাশবাণীতে যুদ্ধের খবরাখবর শুনি। নভেম্বর মাসের প্রথমদিকের কথা, কাকীর প্রচন্ড প্রসব বেদনা উঠলো। আমি বড়দের নির্দেশে দৌড়াতে দৌড়াতে দাইয়ের বাড়ি ছুটলাম। দাইয়ের হাতে একটা ফুটফুটে পুতুলের মতন মেয়েশিশুর জন্ম দিলেন কাকী । সেটাই তুই ইয়াসমিন।

ইয়াসমিন আবেগে কাঁপতে লাগলো। জীবনের গল্প শুনতে শুনতে বিকেল প্রায় গড়িয়ে যাচ্ছে। ইয়াসমিন আজকে কিছুতেই ত্রিপুরা থাকতে পারবে না। শেষ কথাগুলো সে দ্রুত শুনে নিল।

তার বড়দিদি বলছে, তোর জন্মের এক সপ্তাহ পর নাড়ী খসে পড়লো । সেটাকে দাদী যত্ন করে নিয়ে আমাদের বাড়ির উঠোনের আমগাছ তলায় পুতে দিয়েছিল।

দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ই ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হলো।এর দিন দশেক পরেই ২৬ শে ডিসেম্বর তোকে নিয়ে কাকা- কাকী, দাদা-দাদী স্বাধীন বাংলাদেশে চলে গেলেন। তারপর আর তোকে দেখিনি বোন। বলেই তিনি ইয়াসমিনের মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরে বিদায় দিতে দিতে কাঁদতে লাগলেন।

 

ইয়াসমিন তার বড়দিদিকে কথা দিয়ে এসেছে, কয়েকমাস পরেই সে বাবা-মা কে সঙ্গী করে ত্রিপুরা ফিরে আসবে। তাদের কাশিপুরের বাড়িতে যাবে। যেখানে তার নাড়ি পোঁতা হয়েছিল সেই আমগাছটি হয়তো আর বেঁচে নেই কিন্তু ওই স্থানের কিছুটা মাটি সে সাথে করে বাংলাদেশে নিয়ে আসবে এবং আমৃত্যু পরম যত্নে তার শিকড়ের মাটির পোটলা নিজের কাছে রেখে দিবে।

ইয়াসমিন তার শিকড়ের সন্ধান পেয়েছে। এবার কেবল প্রতীক্ষা শিকড়ের মাটি ছুঁয়ে দেখার। বুক ভরে শিকড়ের মাটির ঘ্রাণ নেয়ার।

লেখাকাল,
২৮ মে ২০১৯ ইং, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!