সেলিনা জাহান প্রিয়ার গল্প- কলমি লতা
কলমি লতা
———- সেলিনা জাহান প্রিয়া
পর পর চার বার মেয়ে হল বলে তাই কলমির স্বামী তাকে আর রাখবে না। কুলের মেয়ে দিয়ে বিদায় করে দিবে আলফাজ মিয়া। আলফাজ মিয়ার ধানের জমি আর গঞ্জে ভাল ব্যবসা। কলমির শাশুড়ি বলল এই বউ রাখা যাবে না। এত জমি জমা ব্যবসা কই সব মেয়ের জামাইরা নিয়ে যাবে। বংশের কেউ থাকবে না। কলমির শরীর টা ভাল না। কলমি লতা নামটা তার বাবা সখ করে রেখেছে। কলমির বাবা আসছে কলমি কে দেখতে। কিন্তু কেউ আজ তার সাথে কথা বলছে না। কলমির শাশুড়ি বলল- আপনার মেয়ে কে নিয়ে জান এমন মেয়ে তারা রাখবে না। একটাও পোলা জন্ম জন্ম দিতে পারে না। খালি বছর বছর মেয়ে জন্ম দেয়। মেয়ে মানুষের কোন দাম আছে। মেয়ে মানুষ হল পায়ের জুতা। পায়ের জুতা কয়টা লাগে। আমার ছেলে কে আবার বিয়ে করাব। কলমির বাবা বলল দেখেন বিয়াইন সাহেব মেয়ে হল আল্লাহর রহমত। আল্লাহর রহমতের উপর রাগ করতে হয় না।
—- ভাই আমাকে কুরান হাদিস বলে কোন লাভ নাই। এটা আরব না। যে মেয়ের বাবা কে পন দিয়ে বিয়ে করবে। এটা বাংলাদেশ এখানে মেয়ে বিয়ে দিলে টাকা লাগে। আপনার ছেলেরা কয় টাকা দিবে ৪ টা মেয়ে বিয়ে দিতে। আমার ছেলে কে একটা পোলা জন্ম দিইয়ে দেখাতে পারলো না। এমন বউ আমি রাখব না।
কলমি স্বামীর সামনে গেলে সে কোন কথা বলে না। নতুন মেয়েটা একবার বাবা হিসাবে কুলে ও নেই নাই। কলমি বলল – দেখ আমি যেতে হলে চার মেয়ে নিয়ে যাব।
শুধু এক মেয়ে নিয়ে যাব না। তুমি আর একটা বিয়ে করবা কর। আমার কোন মেয়ে
তোমার মা আর তোমার বউয়ের বান্দিগিরি করার জন্য রেখে যাব না।
আলফাজ মিয়া বলে তাই যাও। আমার কোন মেয়ে লাগবে না। ফটিক ঘটক মেয়ে দেখতাছে। আমি তোমার সাথে এই বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাই না।
—- তুমি এত পাষাণ কি ভাবে হলে।
—- কি আমাকে পাষাণ বলছ। তোমার সাথে কোন কথা নাই।
—- আমি এই বাড়ি ছেড়ে কোথাও যেতে চাই না। ১০ বছরে আমার হাতে
গড়া সংসার।
—- আমি তরে তালাক দিলে তুই কি ভাবে থাকবি।
—- কলমি লতা আর কোন কথা বলে না। বুঝতে আর বাকি নাই। স্বামী তার আর নাই।
তিন দিন পরে কলমির বাবা এসে কলমি কে সাথে করে নিয়ে যায়। কলমি তার চার মেয়ে নিয়ে বাবার সাথে নৌকায় উঠে। কলমির বাবা বলে মা আল্লাহর উপর ভরসা
রাখ। যে আল্লাহ্ জীবন দিয়েছে সেই আল্লাহ্ তোমাকে রিজিক দিবে। স্বামীর বাড়ি থেকে বাপের বাড়িতে কলমি লতা আসে। ভাইয়ের বউয়েরা তাকে কলমি কে ভাল ভাবে নেয় না। তিন ভাই কলমির কিন্তু তিন ভাই বোন কে বলে চিন্তা করিস না কলমি ভাইয়েরা এক বেলা খেলে তুই ও একবেলা খাবি। সকালে তোর দুই মেয়ে নিয়ে স্কুলে যাব ভর্তি করাতে। বড় ভাবি কলমি কে বলে কলমি আমার কোন বাচ্চা নাই। তোমার এক মেয়ে আমি নিলাম। তিন নাম্বার মেয়ে নিয়ে যায় কলমির বড় ভাই।
সে আবার ঢাকা থাকে। কলমির চার মেয়ে বকুল জুই জবা আর ছোট মেয়ে নাম গোলাপি। জবা বড় ভাই নিয়ে যায়। কলমি কে তার বাবা গরু কিনে দিয়েছে। কলমি ভাইদের সংসারে নিজের জিবনে কে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে। কলমির বাবা একদিন মারা গেল। ভাইদের সংসার নিয়ে ঝামেলা। বড় ভাই ছোট ভাইদের নানা কথা শুনে কলমি কে আলাদা করে দিয়ে যায়।
কলমির স্বামী আর কলমির কোন খোঁজ রাখে না। কলমি খবর পায় আলফাজ মিয়া
আবার বিয়ে করেছে নতুন বউয়ের দুই ছেলে। আলফাজ মিয়া ভালই আছে। কুলের মেয়েটার বয়স পাচ বছর। বড় মেয়ে এবার এস এস সি দিল। কলমি তার নিজের মত করে কাজ করে। বড় ভাই খুব দেখা শুনা করে। বকুল কে তার বড় মামা নার্সিং এ ভর্তি করে দেয় পরের বছর দ্বিতীয় মেয়ে কেও নার্সিং এ ভর্তি করে দেয় বড় মামা।
ছোট মেয়ে কে নিয়ে গ্রামে থাকে কলমি। অবসারে স্বামী সংসার নিয়ে চিন্তা করে আর চোখের পানি ঝরে। কলমি বাবা কত সখ করে কত বড় বাড়িতে কলমি কে বিয়ে দিয়েছিল। এখন তার মেয়েরা কত কষ্ট করছে। কত কথা আজ মামা মামি দের শুনতে হয়। তাদের বাবার তো আর টাকার অভাব নাই। কলমি ভাবে মানুষের জিবনে আসলেই সুখ বলে কিছু নাই।
বকুল জুই এখন নার্স। সরকারি চাকুরী পেয়েছে। কলমি এখন ঢাকা শ্যামলীতে মেয়েদের সাথে থাকে। ছোট মেয়ে গোলাপি লিখা পড়ায় ভাল। ভাইয়ের কাছে যে মেয়ে জুই সে একটা ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে।
ঢাকা মেডিক্যাল হাসপাতালে আলফাজ মিয়া ভর্তি। বারান্দায় একটা সিটে পরে আছে
আলফাজ মিয়ার বউ পাশে বসা। আলফাজ মিয়া আর আগের আলফাজ নাই। ১৯ বছরে অনেক বদল হয়েছে। বড় ছেলে জেলে। ছোট ছেলে লিখা পড়া করে নাই।
আলফাজ মিয়ার কোন কথা কেউ শুনে না। আলফাজ মিয়ার মা এখন চোখে দেখে না। হাসপাতালের বারান্দায় পরে আছে আলফাজ মিয়া। আজ এই দিক দিয়ে বড় মেয়ে বকুল যাচ্ছে। একজন মহিলা বলল – সিস্টার ডাক্তার কখন আসবে। বকুল রোগীর দিকে চেয়ে বলে কি হয়েছে কাগজ দেখি। বকুল দেখে ফুসফুসে পানি জমেছে শ্বাস নিতে পারছে না। রোগীর নাম আলফাজ মিয়া। বাবার কথা ও চেহারা তার মনে আছে। দেখল চিকিৎসা ছাড়া যেই লোকটা বারান্দায় পরে আছে সে তার বাবা।
বকুল তার মা কে ফোন করে বলল – মা একজন মানুষ পেয়েছি আমি কি করব জানি না। জিবনে সব চাইতে খারাপ মানুষটা আমার সামনে।
— মা জানতে চায় কে মা।
— তুমি জুই কে নিয়ে একটু হাসপাতালে এসো।
আলফাজ মিয়া মেয়ের দিকে চেয়ে আছে। বলছে আপনি কাকে খারাপ মানুষ বলছেন।
শ্বাস নিতে পারছে না। মেয়ের দিকে চেয়ে বলছে আমি তো কোন খারাপ মানুষ না।
বকুল বলল টেস্ট গুলো কেন করান নাই। পাশে বসা ছেলে বলল- আমাদের কাছে টাকা নাই। বকুল বলল -তোমার কি হয়?
— আমার বাবা। আর উনি আমার মা।
— ঢাকা তোমাদের কেউ নাই।
— আমার মামারা আছে কিন্তু মামা অফিস শেষ করে আসছিল। ৫০০ টাকা দিয়েছে
এই টাকা দিয়ে কি হয়। বকুল ব্যাগ থেকে টাকা বের করে একজন কে বলল যা তো এই সকল ঔষধ নিয়ে এসো। আলফাজ মিয়া কে নিয়ে একটা সিটে তুলল। ছেলেটাকে বলল তোমার নাম কি। কিছু খেয়েছ।
— বকুল তার ব্যাগ থেকে খাবার বের করে খেতে দিল।
—- ছেলেটা বলে আপনি অনেক ভাল। অন্য সিস্টাররা আমাদের সাথে কথা বলে না। আমার নাম বেলা।
— খুব সুন্দর। তোমার নাম।
— জুই তার মাকে নিয়ে হাসপাতালে আসছে। কলমির চুল পেকেছে। বোরখা মুখের কাপড় সরিয়ে দেখে তার স্বামি। কলমি আবার নিজের মুখ লজ্জায় লুকায়।
বড় বড় চোখে আলফাজ মিয়া চেয়ে থাকে। বকুল জুই সাদা নার্সের পোশাকে।
জুই মাথায় হাত দিয়ে বলে আমাদের কি চিন্তে পারছেন।
— আলফাজ মিয়া বলে না। চিনতে পারছি না।
— জুই বলে আপনার চিকিৎসা নিয়ে চিন্তা করবেন না। আমরা আপনার অতি আপন
জন। যত টাকা লাগুক আমরা দিব।
— আলফাজ বলে এই ক্যাবিনের ভারা তো অনেক। আর আপনারা কেন বা আমার জন্য এত কিছু করবেন। আমার তো এত টাকা দেয়ার মত ক্ষমতা নাই।
কলমি লতা তার মুখের কাপড় সরিয়ে বলল – আমাকে কি চেনা যায়।
আলফাজ মিয়া কলমির দিকে চেয়ে বলে তুমি কলমি তো।
হা আমি কলমি এরা আপনার মেয়ে। আমি আমার মেয়েদের সুশিক্ষা দিয়েছি যেন তারা তার জন্ম দাতাকে সম্মান করতে পারে। তোমার চার মেয়ে দুই জন নার্স একজন ইঞ্জিনিয়ার। অন্য জন আসা করি ডাক্তার হবে।।
আলফাজ মিয়ার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে থাকে। জুই বাপের মাথায় হাত দিয়ে
বলে বাবা তুমি আমাদের ফেলে দিলেও আমরা তোমাকে ফেলব না। বকুল বেলা কে
কাছে টেনে নেয়। বেলা বলে জুই আপা বকুল আপার লাগানো লিচু গাছে অনেক লিচু
হয়। আব্বা ভাল হলে আমি তোমাদের নিয়ে যাব। কলমি লতা বলে শুধু বোনদের
নিবে। বেলা বলে আমি শুনেছি দাদী তোমাকে বের করে দিয়েছে। এবার বাড়িতে গেলে কানা বুড়িরে বাড়ি ছাড়া করব মা। এত সুন্দর করে মা ডাক শুনে কলমি বুকে জরিয়ে নেয় সৎ ছেল কে …
আলফাজ মিয়া আজ ভাল হয়েছে। ট্রেনে তুলে দিতে চার মেয়ে এসেছে কিন্তু কলমি আসে নাই। চার মেয়ে বলল বাবা তুমি ভাল থেক। সৎ মাকে বলল বেলা যেন স্কুলে যায়। বেলা বলল – আমি তোমাদের কাছে চলে আসব। ট্রেন ছারে আলফাজ মিয়া
দেখে তার চার মেয়ে রা পায়ের জুতা না যেন মাথার তাজ হয়েছে। চোখের পানি তার আজ বুক ভিজে যায়।
কলমি তার চার মেয়ে কে বলে আমার বাবা বলে গেছে যে খমা করতে জানে সেই বড়। আমি আমার বাবার কথা রেখেছি মাত্র……………… তোমরা ও তোমার বাবাকে খমা করে দিও, কারন যারা খমা করে তারাই মহৎ।।