সেলিনা জাহান প্রিয়ার গল্প: ‘অ-মানব’- (১৬তম পর্ব)
অ-মানব-১৬তম-পর্ব
——————–সেলিনা জাহান প্রিয়া
নাদিয়া খুব অবাক হয়ে দেখছে সেই ভোর বেলায় পুকুরে পানি সেচের মেশিন লাগিয়েছে । এই শীতের মধ্য ভোর বেলায় পাগল মানুষটা পুকুরের ভাসমান ময়লা পরিষ্কার করছে। আশপাশের সবাই বলছে খুব ভাল হবে । গত ৪০ বছরে এই পুকুর পরিষ্কার করা হয় না। চার দিক ময়লা আর নোংরা পানি ।
শিলার বাবা আর শিলা দাড়িয়ে হাসছে । নাদিয়া ঘুম থেকে উঠে বলে- মিঃ জিনিয়াস আর কোন কাজ নেই । ভালই তো । আপনি কি জানেন এই পুকুরে জীন আছে । ৪০ বছর আগে এক ই পরিবারের তিনভাই বোন পানিতে পড়ে মারা যায় । জিনিয়াস পাগলটা হেসে বলে পুকুরে পড়ে মারা যায় না মেরে ফেলে তা কিন্তু আজ পর্যন্ত অমীমাংসিত । নাদিয়া বলে এটা কেমন কথা।
নাদিয়ার দিকে তাকিয়ে পাগলটা বলে গাছ গুলো কিন্তু এখনো পুকুর পারে দাড়িয়ে । নারিকেল আর লিছু গাছ গুলো । যে দিন গাছ কথা বলবে সেই দিন হয়ত এর সমাধান হবে । এই শীতে ভেজা শরীর নিয়ে এই মানুষটার কোন খেয়াল নেই । তার সাথে আরও ৪ জন লেবার নেমেছে । রইস মিয়া বলল নাদিয়া যেই কাজ আমরা চল্লিশ বছরে পারি নাই সেই কাজ দুই দিনে শুরু করেছে । শিলা পুকুর পারে দাড়িয়ে বলছে মামা তুমি উঠে এসো । লেবার তারা এই কাজ করবে ।। বাসার আশ পাশের সবাই দেখছে পুরো পুকুর সাতার কেটে যাচ্ছে । নাজু বলল – ভাই তুমি উঠে এসো । শিলা তার বাবা কে বলল এবার কিন্তু আব্বু আমাদের পুকুরে একটা পাকা ঘাট বেধে দিবা । পাগল বলল তোমার আব্বুর টাকা লাগবে না । পুকুরের মাছ বেঁচে হয়ে যাবে । শিলার বাবা বলে হাসতে হাসতে মাছ পাবে কিন্তু যেই টাকার মাছ পাবে সেই ডিজেল লাগবে সেই খরচ তো উঠবে না।নাজু তার স্বামী কে বলে আমার ভাই এই শীতের মধ্য পানিতে নেমে তোমাদের না পারা কাজ করছে আর তুমি টাকার হিসাব করছ। পাগল বলে আপা করতে দাও মাছ বেচা টাকা সব কিন্তু আমার । পাগল কে শিলা বলে আচ্ছা নিও । এখন উঠে এসে কিছু খাবার খাও। তোমার প্রিয় চা নিয়ে এসেছে নাজ। পাগল নাজ কে বলে— নাজ দুধ চা তাই না ।
—- হ্যা ভাইয়া সকাল বেলা তো ?
—- নাজ আমার দুধ চায়ে একটু আদা দাও ।
—– কি বলেন ভাইয়া । দুধ চায়ে আদা ।
—– হা দুধ চায়ে আ্দা তবে আদা দিয়ে লিকার টা একটু ফোঁটাতে হবে ।
—– ঠিক আছে দেখি ভাইয়া ।
নাজ চা আবার বানাতে চলে গেল । নাদিয়া দুধ চায়ে আদার কথা শুনে বলে ভাইয়া তোমাকে মানুষ শুধু শুধু পাগল বলে না।
— নাদিয়া শুনো যারা আমাকে পাগল বলে তারা হল সব এক ধরনের মূর্খ মানুষ ।
এই সব মূর্খ মানুষের জন্য এই দুনিয়ায় , এই সমাজে , ও পরিবার যত সব কষ্ট আর অশান্তিতে পরে থাকে। নাদিয়া তোমাকে যদি বলা হয় তুমি তোমার বাবার সম্পদের কোন অংশ পাবে না। তাহলে কি তুমি ঐ লোকটাকে পাগল বলবে না।
—- হ্যা পাগল বলব ।
—- দেখ তুমি যদি বাংলাদেশের গ্রাম গুলোতে যাও দেখবে বেশীর ভাগ তাদের বোনদের সম্পত্তি দেয় না। বোন রা কত কষ্ট করে ভাইয়েরা তা দেখে দেখে না। আমাদের সমাজে কিছু ভণ্ড লেবাস ধারী ধর্ম গুরু বলে ওয়ারিশ নিলে অমঙ্গল হবে। তারা তাদের ধর্মের কিতাব কে তাদের সামনে আনে না। সমাজ শুধু নামে ধর্ম পালন করে । কেউ যদি কারো হক মেরে দেয় সেই কি ধার্মিক ?
—- নাদিয়া আর কোন কথা বলে না। চুপ করে যায় । কারন নাদিয়ার মামা রইস মিয়াই তাদের মায়ের সম্পদ দিচ্ছে না। বলে বাপের সম্পদ নিলে পাপ হবে। বোন ভাগ্নি আসবে বেড়াবে । নাদিয়া একটু নিজে নিজে হেসে দিল ।। পাগল পানি থেকে উঠে এসে নাজের কাছ থেকে চা নিয়ে বলল বাহ! দারুন চা। নাজ বলে ভাইয়া অনেক মজা আমি এখন থেকে দুধ চায়ে আদা দিয়েই খাব । নাদিয়া নাজের কাছ থেকে একটু চায়ে চুমুক দিয়ে বলে দারুন তো ! পুকুরের পানি কমছে সেচ পাম্পের শব্দ বেশ হচ্ছে। শিলার বাবা আরও দুটা সেচ পাম্প এনে দিল । পাগল হেসে বলল- আমার দুলা ভাই গরীবের দুঃখ বুঝে ।।
রেজিয়া কে সিলেটের গাড়িতে তুলে দেয় তার দেবর । রেজিয়া তার সকল টাকা তুলে তার নিজ ব্যাংকে রাখে । রেজিয়ার স্বামী সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে দেখে রেজিয়া নাই । তার ফোন বন্ধ । রাতে তাদের মধ্য ঝগড়া হয় । কিন্তু রেজিয়া এভাবে চলে গেল ।
তার ভাই কে ডেকে বলে তুই কিছু জানিস । ভাই বলল আমি কিছুই জানি না। আজ রাতে আমি চলে যাব । ভাবীর এ সময়ে এভাবে চলে যাওয়ার কোন মানে হয় না। রেজিয়ার দেবর রাতের ১১ টায় সিলেটের গাড়িতে উঠে । তার ভাই তাকে বিদায় দেয় । এ দিকে বউ রাগ করে চলে গেছে এখনো তার সাথে যোগাযোগ করে নাই ।
রেজিয়া সিলেট মাজারের কাছে একটা হোটেলে উঠেছে রাতে সিলেট মাজারে ভিতরে পুকুরের মাছ দেখছে । পিছন থেকে কেউ একজন বলল – আপু সিলেট কখন আসলেন ? রেজিয়া পিছন ফিরে দেখে ঐ পাগল মানুষটা মিলির বাসার ছাদে যাকে দেখে ছিল । রেজিয়া একটু ভয় পায় । প্রথমে না চেনার ভান করে । পাগল বলল আপু জিবনে ভুল করছেন । ফিরে যান । আপনার স্বামীর বিশ্বাস কে নষ্ট করার কোন অধিকার আপনার নাই । প্রতিটা মানুষ কিছু বিশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকে । সহজ সরল মানুষের বিশ্বাস নিয়ে খেলতে হয় না। রেজিয়া বলে দেখুন জীবন আমার । আর আমার জিবনের ভাল মন্দ আমি ভাল করে বুঝি ।
— পাগল হেসে বলল আপু জীবন আপনার এ কথা সত্য । কিন্তু আপনার জিবনের সাথে পরিবারের সমাজের অনেক মানুষের জীবন জড়িত । আচ্ছা রেজিয়া আপু আপনি শুধু একটা কাজ করুন । আপনার দেবর কে ফোন করে বলুন যে আপনি
টাকা আনতে পারেন নাই । আর যে টাকা এনেছেন তা ভিসা আপনি হুন্ডি করে কারো নামে পাঠাবেন না। আগে আপনি মালয়েশিয়া যাবেন তার পর সিন্দান্ত নিবেন ।
— রেজিয়া পাগলের কথা মত তার দেবর কে ফোন দিল ।
— দেবর ফোন তুলে বলল জান পাখি আমি বাসে উঠেছি ।
— ঠিক আছে কিন্ত আমার পাসপোর্ট কোথায় ।
— ভিসার জন্য জমা । কাল ভিসা হবে আমার বন্ধু পাঠিয়ে দিবে কুরিয়ারে ।
— এক দিন থেকে তুমি কেন নিয়ে আসছো না ?
— দেখ সিলেটে তো অনেক কাজ । তোমাকে নিয়ে তো শেষ করতে হবে ।
— কি এমন কাজ যে ভিসা না নিয়েই চলে আসতে হবে ।
— শুনো তুমি শুধু শুধু রাগ করছ । আমি সিলেট এসে সব বলি ।
— এখন বললে সমস্যা কি?
—- না কোন সমস্যা না । মালয়েশিয়ায় কালকের মধ্য ৩০ লাখ টাকা পাঠাতে হবে
তাই ।
—- আমার কোন টাকা আমি কাউকে দিব না। টাকা দিয়ে কারো সাথে প্রেম করব না। মালয়েশিয়া যেতে দু জনের মাত্র চার লাখ হলেই চলবে । আমি আমার টাকা অন্য কারো নামে পাঠাতে পারব না ।
— রেজিয়ার দেবর বলল তুমি হোটেল থেকে বের হবেনা। কি আবল তাবল বলছ ।
তুমি কি মনে কর । আমি কি বেঈমান নাকি ।
রেজিয়া ফোন কেটে পাগল কে বলে – আমাকে হোটেল থেকে বের হতে নিষেধ করেছে। আসলেই তো যে তার আপন ভাইয়ের বউ কে নিজ স্বার্থের জন্য ব্যবহার করে । একদিন তো অন্য কোন স্বার্থের জন্য আমাকে আবার ব্যবহার করবে । চলুন আগে হোটেল ছারি । রেজিয়া কে নিয়ে হোটেল ছেরে পাগল তাকে নিয়ে চলে আশে । নাজু আপুর বাসায় । নাজু আপুকে ডেকে গোপনে সব কথা বলে । নাজু বলে ভাইয়া তুমি চিন্তা কর না। দরকার হলে আমি ওকে ঢাকা যেয়ে দিয়ে আসব ।
পাগল বলে রেজিয়া আপু তোমার দেবরের মোবাইল নাম্বার টা দাও । একটা মেইল করি আমার এক পরিচিত জন কে সে আমাকে এক ঘণ্টার মধ্য কল লিস্ট পাঠাবে । তখন তুমি আরও পরিষ্কার হবে যে তুমি ভুল করছিলে ।
বারান্দায় বসে সবাই আলাপ করছে । রেজিয়া এসে তাদের সাথে বসল । নাদিয়া বলল
রেজিয়া কে
—- ভাইয়া কে কি করে চিনেন ?
—- তোমারা কি করে চেন বোন ?
—– ও মা আমাদের ভাইইয়া । জিনিয়াস ভাইয়া । কেন আমরা চিনব না।
—– রেজিয়া বলে আমাদের এলাকায় সবাই তাকে রহস্য পাগল মানুষ হিসাবে জানে
খুব অল্প সময় ছিল । এই অল্প সময়ে আমাদের কিছু মানুষকে সে মানুষ হতে শিখিয়েছে ।
চলমান————————–