লিনা জাহান প্রিয়ার গল্প: ‘অ-মানব’-(৪৮ তম পর্ব)

অ-মানব-৪৮-তম-পর্ব

————————-  সেলিনা জাহান প্রিয়া

 

কেনুর মনটা ভাল না । ফুল জান তাঁকে কিছুতেই পছন্দ করছে না। কি করে যে তাঁকে বলবে যে সে ফুল জান কে মহব্বত করে মন থেকে । চেয়ারম্যান জানলেই তাঁর চাকুরী আর চেয়ারম্যান এর চামচামি সব শেষ।
ফুলজান চেয়ার ম্যানের মায়ের কাছে বেশ তাঁর মাথায় নারিকেল তেল দিয়া দিচ্ছে । চেয়ারম্যানের মায়ের সামনে যাওয়ার সাহস নাই কেনু মিয়ার । বাড়ির উঠানে তাই পাইচারি করছে । চেয়ারম্যানের স্ত্রী বলছে কেনু কি হইছে এত রোদের মধ্যে তুমি বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে । আজ কাল কোন কাজ নাই । চেয়ারম্যান কোথায় ? মামী চেয়ারম্যান মামা তো ইউনিয়ন অফিসে। অ-মানব ভাই কোথায় ?
মামী তিনি তো সকাল থেকে গেদু মিয়ার বাড়িতে ।
—— সে খানে কি করে
——- আরে মামী বিশাল ঘটনা । গেদু মিয়া যেই মায়েরে বাড়ি থেকে বের করে দিছিল । তারে আবার নিয়া আসছে । আর গেদু মিয়ার বউ ঐ যে গফুর ডাকাতের মেয়ে মেয়ে সে তো বাড়িতে উঠতে দিবে না। গেদু মিয়া তাঁকে তালাক দিবে । তাঁর আগের বউ কে আনবে ।
——- গ্রামে এই টা কি শুরু হল । আর অ-মানব কেন সেই খানে ?
——– মামী তা জানি না । এই অ-মানব মামা একটা জিনিয়াস ।
——–এই যে গত কাল রাতে রাজ্জাক মেম্বার তো তাঁর পা ধরে বসে ছিল ।
——–বলিস কি ? রাজ্জাক মেম্বার ! অ-মানের পা ধরেছে । আমি তো বিশ্বাস করতে পারছি না।
——– মামী সে এক বিশাল কামেল মানুষ । জাম গাছ থেকে জীন ধরে তাঁকে মাঠের মাঝে যেই গাব গাছ সেই খানে ছেড়েছে ।
——- বলিস কি সে জীন ধরতে পাড়ে । আমার তাই মনে হয় । কথা বলার কেনু মাথা নিচু করে কথা বলে । যা দেই তাই চুপ করে খায় । আমার মনে হয় কেনু সে আমাদের বাড়িতে থাকলে সমস্যা হবে।
—— মামী কি সমস্যা ?
——- না তকে বলা যাবে না । চেয়ারম্যান আসুক তাঁকে বলব । তুই যা।
——- মামী ফুলজান কি এই বাড়িতে থাকব ?
——- হ্যা ফুলজানের মামা বাড়ি । আর এখন সে এই খানে থাকব । তুই কিন্তু ফুলজানের সাথে কথা বলিস না। তা হলে কিন্তু তোর এই বাড়ি ছাড়তে হবে ।
——- জী মামী আমি জানি । এখন যাই ।
দুপুর হতে অনেক বাকি গেদু মিয়ার বাড়িতে অ-মানব । আজ দুপুরে সে এই বাড়িতে খিচুড়ি খাবে। গেদু মিয়ার মা সেই খিচুড়ি রান্না করছে । অনেক ছোট বেলায় গেদুর মা জমিদার বাড়িতে থাকত । বাদীর কাজ করত । জমিদার বাড়ি থেকে সে রান্না করা শিখেছে । এলাকায় ছোট খাট কোন অনুষ্ঠান হলে গেদুর মায়েই সেই রান্না করে । গেদুর বউ কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। তাই সে তাঁর বাবা গফুর ডাকাত কে খবর দিয়েছে যাতে লোক জন নিয়ে আসে । গেদু মিয়া বলল তাঁর বাবা আসার পড় ফয়সালা হবে । অ-মানব কোন কথা না বলে শুধু শুনছে । গেদু মিয়া বলল
——- ভাই আপনে আমার অন্তর চোখ খুলে দিয়েছেন । যেই মা জন্ম দিল তাঁর কথা মনে নাই । যে মা আমাকে লালন পালন করে বড় করলো তাঁকে আমি বউয়ের কথায় বাড়ি থেকে বের করে দিলাম । বলুন আল্লাহ্‌ সহ্য করব ?
——- অ-মানব বলল এই জগতে কাউকে ছাড়া চলা যায় না। সৃষ্টি কর্তা মানুষের জন্য সব সৃষ্টি করেছে । আপনি কি নিয়ে এসেছেন । আর কি নিয়ে যাবেন । আচ্ছা গফুর সাব আসুক । তিনি আসলেই সব ঠিক হয়ে যাবে । খিচুরির দাওয়াত সে ডাক্তার আর চেয়ারম্যান কেও দিয়েছে । গেদু মিয়া বলল আরে ডাক্তার চলে এসেছে । ডাক্তার বলল যার ছায়া পর্যন্ত দেখতে পারেন না গেদু ভাই তাঁর আজ তারে একদম ঘরের ভিতরে ।
——– আরে ডাক্তার ভাই গেদু মিয়ার অন্তর চোখ খুলে গেছে । এখন ভাল মন্দসব বুঝতে পাড়ি ।
——– তা আপনার বাড়ির সাপ কি গেছে । মানে অ-মানব যেই সাপ চালান দিয়েছিল।
——- অ-মানব বলল ডাক্তার ভাই । মানুষ কে বনের বাঘে খায় না। মনের বাঘে খায় ।
——- তা অ-মানব তুমি ঠিক বলেছ । তা আমাদের ভাবি কেন কান্না করছে । আজ তো তাঁর সুখের দিন । কারন বাড়িতে তাঁর শাশুড়ি আসছে ।
——– গেদু বলল মা আসছে দেখে তো তাঁর মাথা নষ্ট । সে আমার সংসার করবে না। তাঁর বাবা আসলেই একটা বিহিত করে চলে যাবে ।
——— ডাক্তার বলল ভাবি রাগ শীতল করেন । আপনি অনেক জ্ঞানী মহিলা আর
সাহসী আপনি রাগ করলে কি হয় ।
অ-মানব বলল ডাক্তার ভাই আসলে গেদু ভাই ভুল করেছে । খালাম্মকে আনবে এটা
ভাবিকে বললে ভাবি আরও খুশি হত । ভাবি কে না বলে আনায় মনে কষ্ট পেয়েছে । এত বড় বাড়ি ভাবি একা থাকে । শাশুড়ি থাকলে ভাবীর একজন সঙ্গী হবে। গেদু ভাই ভাবীকে নিয়ে তাঁর মাকে আনতে গেলে সামজিক ভাবে ভাবি কে মানুষ বলত যে একজন বড় মনের মানুষ । সৎ শাশুড়িকে নিজেই নিয়ে এল । অ-মানবের এই কথা শুনে গেদুর বউ আরও জুড়ে চিৎকার করে বলল ও ভাই আপনে আমার মনের দুঃখ টা বুঝলাইন । আমার স্বামী বুঝল না। আমি কারে নিয়া সংসার করি । আমি তো আমার স্বামীর খারাপ চাই না। অ-মানব গেদু মিয়া কে বলল – গেদু ভাই কেউ আসার আগে আপনি ভাবীর কাছে দুঃখ প্রকাশ করুন যে ভুল হয়েছে । গেদু মিয়া বলল অ-মানব ভাই আমি আপনার মতো করে চিন্তা করি নাই । আসলেই ভুল হয়েছে । এখন গেদুর মা এসে বলল শুন গেদু তুই তোর বাবা মতো হইস না। আমি তো তরে ১২ বছর রান্না করে খাওয়াইছি কিছুটা আমার মতো হইস ।
আর শুন কাল সকালে আমারে নিয়া রেজিস্ট্রি অফিসে যাবি । আমি যেই জমি ভাগে পাইব তা সব বউ কে দিয়া দিব । আমি চাই আমার ছেলের বউ রাজরানি হয়ে থাক । আর এই বাড়িতে আমার কিছু ১৭ ভরি সোনা আছে । একটা কোদাল নিয়ে আয় আমি রান্না ঘরের চুলার পাশে মাটিতে রেখেছি । এই গুলা সব তুলে বউ কে দেই ।
গেদুর বউ শাশুড়ির পায়ে ধরে বলল মা কিছুই লাগবে না । আপনি অনেক বড় মনের মানুষ । শাশুড়ি বউকে জড়িয়ে কান্না শুরু হল ।
ডাকাত গফুর খুব গরম হয়ে মেয়ের বাড়িতে আসলো । চেয়ারম্যান আসলো । গফুর ডাকাত বাড়িতে প্রবেশ করে দেখে সব শীতল । কোন ঝগড়া ঝাটি নাই । সবাই হাসি খুশি । সবাইকে নিয়ে অ-মানব খিচুড়ি খাচ্ছে । চেয়ারম্যান একটু রসিক ভাবে বলল আহারে রাজ্জাক মেম্বার থাকলে আর একটু বেশি খাওয়া যেত । গেদুর বউ বলল মেম্বার ভাই আসলে আবার রান্না করে দাওয়াত দিব । সেই দিন আমি রান্না করব । আজ তো মা রান্না করেছে ।
অ-মানব বলল ভাবি আমাকে একটু চা দিয়েন । দুধ চায়ে আদা দিয়েন । গেদুর মা এসে বলল আপনি আদা দিয়ে দুধ চা খান । অ-মানব বলল হা ।
গেদুর মা অ-মানের মুখের দিকে চেয়ে বলল – আজ থেকে ৩০ বছর আগে আমি এক জমিদার বাড়িতে কাজ করতাম । কি নাম বাবা আপনার ?
———– আমার নাম অ-আনব ।
হে আমার মনে পড়ছে সেই ছেলেটার কথা ।আমাকে বলছিল আমি অ-মানব । জমিদার তাঁকে একটা পুকুর পাড় থেকে বাড়িতে নিয়ে আসে । কেউ তাঁকে রাখতে চায় না । তখন সে আমার ঘরে এক রাত ছিল । সারা রাত বসে ঐ ছেলে শুধু অনেক গুলো বই পরেছিল । সেই ছেলে দুধ চায়ে আদা খেত । মাত্র তিন দিন ছিল আমার কাছে তাঁর পড় সেখান থেকে একটা মাদ্রসায় চিটাগং কিছু হুজুরদের সাথে চলে যায় ।
———– অ-মানব বলল খালা খুব মনে পড়ে তাঁর কথা ।
———– কি বল বাবা মনে পড়বে না মানে । আমাকে বলেছিল খুব দুঃখ তাঁর পড় সুখ আবার দুঃখ আবার সুখ সেই সুখেই জীবন শেষ হবে । আর বলেছিল সুখের সময় আমার সাথে দেখা করতে আসবে । আমার রান্না খাবে । আমার হাতের খিচুড়ি তাঁর খুব পছন্দ ।
———– অ-মানবের চোখে পানি চলে আসে । বলে খালা আমি সেই অ-মানব । তোমার হাতের রান্না খাব বলে হয়ত পথ ভুলে আবার তোমার বাড়িতে । মনে আছে সে জমিদার বাড়ির কথা । আমাকে কেউ আশ্রয় দেই নাই । জমিদারের বউ বলল তিন দিনের মধ্যে চলে যেতে হবে । সে ঐ বাড়িতে আমার আর থাকা হল না। খালা আমার দুধ চায়ের কথা তোমার মনে আছে।
———- বাবা মায়ের মন কোন দিন তাঁর সন্তানের মুখ ভুলতে পাড়ে না। আমার খুব
ইচ্ছা ছিল তুমি আমার কাছে থাক । কিন্তু জমিদারের বউ রাখতে দিল না। তুমি চলে যাওয়ার পড় আমি সত্য জেনেছি । জমিদারের বউ মনে করেছিল তুমি হয়ত তাঁর বড় সতীনের ছেলে । ঠিক তাঁর পনের বছর পড় জমিদার মারা যায় । সে জমিদারের বড় ছেলে তাঁকে বাড়ি থেকে বের করে দেয় । খুব খারাপ ব্যবহারের জন্য তাঁকে কেউ আশ্রয় দেয় না । আমি ও বিয়ে করে চলে আসি । অনেক দিন পড়ে শুনতে পাই । সে রেল লাইনে পড়ে মরে গেছে ।
খালা তুমি ভাল থেকে । হিংসা মানুষ কে ধ্বংস করে । আমার সামনে থেকে ঐ মহিলা খাবারের পাত্র তুলে নিয়ে কুকুর কে দিয়ে দেয় । কিন্তু আমাকে দেয় না। ভাবে আমি তাঁর সতীন পুত্র । কিন্তু খালা মনি সে যদি মানুষ কে ভালবাসতে জানত তাহলে তাঁর মরতে হত না। গেদুর অবাক হয়ে বলে ভাই তোমার বাড়ি কোথায় । ডাক্তার চেয়ারম্যান গফুর ডাকাত সবাই অবাক হয়ে যায় । অ-মানব বলে খালা মনি দেখুন আজ আবার আকাশে মেঘ করেছে । আপনার সাথে যে দিন দেখা সেই দিন ও মেঘ ছিল আকাশে । গেদুর মা বলে বাবা তুমি ভাল থেক । এই মন কত বার যে তোমাকে দেখতে চাইত । আল্লাহ্‌ হয়ত সেই আশা পুরন্ করেছে ।
চেয়ারম্যানের মটর সাইকেলে উঠে বসে অ-মানব । চেয়ারম্যান বলে ভাই অ-মানব আমার মায়ের শরীরটা ভাল না। ভাবছি সদর ডাক্তারের কাছে নিব সকালে । আগামী কাল তুমি আর আমি মাকে নিয়ে যাব । কেনু কে দিয়ে মাকে আগে সকালে রিকসা করে পাঠিয়ে দিব, পড়ে তুমি আমি মটর সাইকেলে করে যাব কি বল ?
——- চেয়ারম্যান সাব আজকে তো কোন কাজ নাই । চলেন বিকালে নিয়া যাই ।
——– না আজ অনেক কাজ কালকে নিয়া যাব ।
——— ঠিক আছে । আপনি যা ভাল মনে করেন ।।

চলমান ——

অ-মানব-প্রথম পর্ব    অ-মানব-দ্বিতীয় পর্ব    অ-মানব-তৃতীয় পর্ব    অ-মানব-চতুর্থ পর্ব

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!