অটিজম এর সচেতনতায়- লার্ন এন্ড লিভ
অটিজম এর সচেতনতায়- লার্ন এন্ড লিভ
অটিজম সম্পর্কে সচেতনতার প্রয়োজন কতটুকু?
আমরা এ বিষয়টি ভাবছি কি? নিজের ঘরে, নিজের সন্তানকে পাগল বলে লোকে যখন সমালোচনা করে, তখন আমরা আমাদের সন্তানকে ধীরেধীরে লোক চক্ষুর আড়াল করে রাখি এবং আমরা নিজেরা ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই। আমি লন্ডনের স্কুল গুলিতে দেখছি কোন বাচ্চা যখনি কারো সাথে মিশতে চায়না, নিজে কথা বলতে পারেনা, তখনিই বাচ্চাটিকে নিখুতভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয় তার কোনো সমস্যা আছে কিনা অথবা সে অটিস্টিক কিনা। কারন এটা অটিজম রোগের লক্ষন। বলা হয়, অটিজমে আক্রান্ত শিশুরা নিজেদের একটি আলাদা জগৎ তৈরি করে নেয় যেখানে সবার যাতায়াত থাকে না। তাদের সাথে সবার যোগাযোগ করার উপায় থাকে না বলে অটিজমে আক্রান্ত বাচ্চাদেরকে এক রকম আলাদা করেই রাখা হয়।
অটিজম আসলে কি?
বিষয়টি নিজেরা যদি জানি তাহলে নিজের বাচ্চাটির মধ্যে অসাভাবিকতা দেখা দিলেই আমরা বুঝে নিতে পারবো আমার বাচ্চাটির আসলে কি সমস্যা। অটিজম অটিস্টিক ডিজঅর্ডার নামেও পরিচিত। অটিজম হচ্ছে স্নায়ু বা স্নায়ুতন্ত্রেরগঠন ও পরিবর্ধন জনিত অস্বাভাবিকতা যার কারণে আক্রান্ত শিশুর সামাজিকভাবে বেড়ে উঠতে অসুবিধা হয়। এ ধরনের শিশুরা কথা বার্তায়, অঙ্গভঙ্গিতে ও আচরণে একটা নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে আবদ্ধ থাকে। আপনার বাচ্চার বয়স তিন বছর হবার পূর্বেই এই লক্ষন গুলো দেখতে পারেন। এসময়ে অটিজম স্নায়ুকোষ এবং স্নায়ুকোষের সংযোগস্থলের গঠন এবং বিন্যাসের উপর বিরুপ প্রভাব ফেলে, ফলে তথ্য আদান প্রদানে শিশুরা ব্যহত হয়। আমাদের সবার মধ্যে অটিজম সচেতনতা থাকা অবশ্যই দরকারি, অটিজমের ধরন ও প্রকৃতি আমরা যদি না জানি তাহলে অনেকর কাছ থেকে দেখেও আমরা বুজতে পারবোনা আমার বাচ্চাটির কি হয়েছে। এবং এই সমস্যাটা নির্ধারণ করতে খরচ করতে হবে আমাদের একটি মোটা অংকের টাকা। আমাদের জানা প্রয়োজন কোন শিশুরা অটিজমে আক্রান্ত হয়। অটিজমে আক্রান্ত হওয়ার নির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই। এই রোগের জটিলতা, লক্ষণ এবং তীব্রতার উপর নির্ভর করে এর কারণগুলো ভিন্ন হতে পারে। পরিবেশগত ,বংশগত ও জীনগত কারণেও এই রোগ হতে পারে। বংশগত ও জীনগত কারণ (Genetic Problems) বিভিন্ন জীনের কারণে অটিজম স্পেক্ট্রাম ডিজঅর্ডার হয়ে থাকে। কোন কোন শিশুর ক্ষেত্রে জেনেটিক ডিজঅর্ডার যেমন রেট সিন্ড্রোম (নবজাতকের মস্তিষ্কের স্নায়ুগত সমস্যা) বা ফ্র্যাজাইল এক্স সিন্ড্রোমের সাথে এই রোগটি হয়ে থাকে। অন্যদের ক্ষেত্রে এই জীনগত কারণে অটিজম স্পেক্ট্রাম ডিজঅর্ডার হওয়ার সম্ভাবনা এবং পরিবেশগত ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। পরিবেশগত কারণ (Environmental Factors) বিজ্ঞানীদের মতে, ভাইরাল ইনফেকশন, গর্ভাবস্থাকালীন জটিলতা এবং যেসব উপাদান বায়ু দূষিত করে এসব অটিজম স্পেক্ট্রাম ডিজঅর্ডার হওয়ার ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। আর ভ্যাকসিন বা প্রতিষেধকের সাথে এই রোগ হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই।
অটিজমের লক্ষণগুলো কি?
বাচ্চারা কি ধরনের আচরন করলে কিংবা তাদের মধ্যে কি ধরনের প্রবনতা দেখা দিলে আমরা সচেতন হতে পারি তার লক্ষণ গুলি অটিজমের কিনা। চিকিৎসকরা এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে সাধারণত যেসব লক্ষনগুলো দেখতে পান সেগুলো হোলঃ খিঁচুনি, বিষণ্ণতা, ক্ষিপ্র ব্যবহার, শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধির অভাব, কোষ্ঠকাঠিন্য, খিটখিটে মেজাজ, অসামাজিক আচরণ, কথা বলতে সমস্যা হওয়া, অস্থিরতা, আসক্তি, দীর্ঘকালীন মাসিক, ঘন ঘন চোখের পাতা পড়া ইত্যাদি। যেসব বিষয়ের কারণে অটিজম স্পেক্ট্রাম ডিজঅর্ডার হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায় সেগুলো হোলঃ বাচ্চার লিঙ্গঃ মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা ৪ গুণ বেশি থাকে। পারিবারিক সুত্রেঃ বাবা-মা, ভাই-বোনের অটিজম থাকলে এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। অপরিণত অবস্থায় নবজাতকের জন্মঃ যেসব নবজাতক ২৬ সপ্তাহের পূর্বেই জন্মগ্রহন করে তাদের এই রোগের ঝুঁকি বেশি থাকে। অটিজম হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের লক্ষণের সমষ্টি। এই রোগ ঠিক কিভাবে ব্রেইনের উপরে প্রভাব ফেলে তা এখনও নিশ্চিত ভাবে জানা যায় নি।
অটিজমের ভয়াবহতা ও চিকিৎসা!
আমাদের হয়তো ধারনায় নেই যে প্রায় ১৫০ জন শিশুর মধ্যে ১ জন শিশুর এই রোগ হতে পারে। এই রোগের ব্যপ্তি অনেক। আমাদের ভাবতে হবে কি করে এই রোগ থেকে প্রতিকার পাওয়া যায়। অটিজম প্রতিরোধে সর্ব প্রথম অটিজম সচেতনতা বাড়াতে হবে। এছাড়াও নিম্নলিখিত উপায়ে অটিজম মোকাবেলা করা সম্ভব। শিশুদের মধ্যে সামাজিক ও ভাষাগত দক্ষতা আনায়নের উদ্দেশ্যে থেরাপিস্টরা একটি নির্দিষ্ট কাঠামো অনুযায়ী শিক্ষা বা ট্রেইনিং দিয়ে থাকেন। এছাড়াও অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের সাথে যেন খাপ খাইয়ে থাকতে পারে সেজন্য পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়স্বজনদেরও কাউন্সিলিং করা যেতে পারে। উদ্বিগ্নতা, বিষণ্ণতা এবং অতিরিক্ত আসক্তি নিয়ন্ত্রণ করতে ডাক্তার অ্যান্টি-ডিপ্রেসেন্ট ঔষধ গ্রহনের পরামর্শ দিতে পারেন। আচরণগত সমস্যার চিকিৎসায় অ্যান্টি-সাইকোটিক ধরনের ঔষধ দেয়া যায়। খিঁচুনি প্রতিরোধক হিসেবে অ্যান্টি-কনভালসেন্ট ঔষধ গ্রহন করা যায়। যাদের মনোযোগের অভাব থাকে তাদের মনোযোগ বৃদ্ধির জন্য স্টিমুল্যান্ট জাতীয় ঔষধের পরামর্শ দেয়া যায়। অটিজম মোকাবেলায় বেশ কিছু থেরাপি-ও দেয়া হয়ে থাকে। তবে এসব থেরাপি প্রয়োগের আগে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। সমাজ কল্যান মন্ত্রনালয়ের গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোট ১.৪ মিলিয়ন মানুষ অটিজমের শিকার যার মধ্যে ১০০ জনেরও কম ব্যক্তি সঠিক চিকিৎসা পান। আরও একটি গবেষণায় দেখা গেছে বাংলাদেশে প্রতি ৫০০ জনের মধ্যে ১ জন শিশু অটিজমে আক্রান্ত; তার মানে বাংলাদেশে অটিজমে আক্রান্তের সংখ্যা ২৮০,০০০ এর কম নয়। অনেক ডাক্তার অটিজম সম্পর্কে সঠিক ধারণা রাখেন না। প্রায়-ই শিশুরা ভুল রোগ নির্ণয়ের শিকার হয়ে থাকে যা অটিজম সচেতনতা’র অভাবের ফলে হয়ে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সঠিক রোগ নির্ণয় না করেই তাদের অ্যান্টি-সাইকোটিক জাতীয় ঔষধ দেয়া হয়ে থাকে। আমরা নিজেরা যদি না জানি এই রোগের লক্ষন ও প্রতিকার, তাহলে ডাক্তার এর ভুল রোগ নির্নয়ের কারনে আমাদের শিশুর জীবনকে ঝুকির মধ্যে ফেলে দেবো।