আইনের শাসন মানে, রাস্তায় ফেলে গলা টিপে ধরা নয়
আদর্শ কাগজে লেখা থাকে। কাজের সঙ্গে তার মিল থাকে না, তবে মুখে থাকে। প্রতিপক্ষের উদ্দেশে আদর্শের কথা বলেন, নিজে মেনে চলেন না। বলছি রাজনীতি ও রাজনীতিকদের কথা, বিশেষ করে বাংলাদেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দল ও নেতাদের কথা। তারা একে অপরের ভুল, অন্যায়-অনিয়ম-অনৈতিকতা, দুর্নীতি নিয়ে কথা বলেন। অন্যকে যা বলেন, নিজে বা নিজেরা তা করেন না। সম্প্রতি বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার জেল-জরিমানার প্রতিবাদে আন্দোলন করছে বিএনপি। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের অংশ হিসেবে গত ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় সমাবেশের অনুমতি চেয়েছিল বিএনপি। অনুমতি দেওয়া হয়নি। এর প্রতিবাদে কালো পতাকা প্রদর্শনের কর্মসূচি দিয়েছিল তারা। আজকের লেখা এই কালো পতাকা প্রদর্শন ও পুলিশি প্রতিরোধ বা তাণ্ডবকে কেন্দ্র করে।
১. পাঁচ বছরের দণ্ড মাথায় নিয়ে খালেদা জিয়া কারাগারে। ধারণা করা হয়েছিল, এর প্রতিবাদে বিএনপি মারদাঙ্গা কর্মসূচি দেবে। হরতাল, ধর্মঘট, গাড়িতে আগুন, ভাঙচুর হবে। আক্রমণ হবে পুলিশের ওপরও। রায় ঘোষণার কয়েকদিন আগে তার আলামতও পাওয়া গিয়েছিল। হাইকোর্টের সামনে বিএনপি কর্মীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল পুলিশ বাহিনির সদস্যরা। বিএনপি নেতৃবৃন্দের দাবি, তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এমন ছিল না। বিএনপির ভেতরের একটা ক্ষুদ্র অংশ বিশেষ সংস্থার প্রযোজনায় পুলিশকে আক্রমণ করে বসে। সেদিন পুলিশ বেশ রহস্যজনকভাবে পরিচিত মারমুখী অবস্থান না নিয়ে, নীরবে মার হজম করে। খালেদা জিয়ার রায়ের পরে বিএনপি আরও মারমুখী কর্মসূচি দেবে, অনেকেই এমনটা ভাবছিলেন। সরকার, সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনি সেভাবেই প্রস্তুত ছিল। ২০১৪ সালের সহিংসতা দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনি সফল হয়েছিল। তাদের এই আত্মবিশ্বাস ছিল যে সহিংস কর্মসূচি দুই চারদিন চলার পরই তা বন্ধ করে দেওয়া যাবে। বিএনপি সহিংস, প্রায় জঙ্গি দল একযোগে এমন প্রচারণা শুরু করা যাবে। ২০১৪-১৫ সালের মতো আবারও ইমেজ সংকটে পড়বে বিএনপি।
কিন্তু সরকারসহ আর অনেককে হতাশায় ডুবিয়ে, আক্রমণাত্মক সহিংস কর্মসূচির পথে হাঁটল না বিএনপি। কারাগারে যাওয়ার আগে বেগম খালেদা জিয়া কড়া নির্দেশনা দিয়ে গেলেন, কোনও প্রকার সহিংসতা নয়।
বিএনপি কেন এমন সিদ্ধান্ত নিল বা নিতে পারলো? বিএনপি ২০১৪ সালের অবরোধের কর্মসূচি এবং তার প্রেক্ষিতে সহিংসতার বিষয়টির আত্মমূল্যায়ন করেছে। বিএনপি বিশ্বাস করে, সব সহিংসতা, পেট্রোলবোমায় মানুষ তারা পোড়ায়নি। কিন্তু পুরো দায় নিতে হয়েছে। সরকারকে বিপদে ফেলা গেলেও সফল হওয়া যায়নি। সাময়িক বিপদে পড়লেও, কঠোরভাবে সহিংসতা দমন করে সফল হয়েছে সরকার। গুলি করে হলেও সহিংসতা দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনি বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেছে। ফলে পুরনো সেই সহিংস কর্মসূচির ধারে কাছে দিয়ে যায়নি বিএনপি। এমন শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি বিএনপি নিয়েছে, যা প্রতিরোধ বা বাধা দেওয়ার যুক্তি খুঁজে পায়নি পুলিশ বা সরকার।
২. শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির অংশ হিসেবে সমাবেশের অনুমতি না পেয়ে, কালো পতাকা প্রদর্শনের কর্মসূচি দেয় বিএনপি। বিএনপি নেতাকর্মীরা হাতে কালো পতাকা নিয়ে জড়ো হয়েছিল, পল্টনে তাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে। যুদ্ধক্ষেত্র বা প্রায় রণাঙ্গনের প্রস্তুতি নিয়ে পুলিশ তা প্রতিরোধ করেছে।
প্রশ্ন হলো, শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচির অংশ হিসেবে, কালো পতাকা প্রদর্শন করা যাবে না কেন? সমাবেশের জন্যে পুলিশের অনুমতির বিষয়টি মেনে নেওয়া যায়। সেটাও সমতাভিত্তিক হওয়া দরকার। আওয়ামী লীগ অনুমতি চাইলেই পাবে, ছাত্রলীগের জন্যে অনুমতিরও দরকার হবে না। অনুমতি শুধু বিএনপি বা বিরোধীদের জন্যে। এমন আইন তো নেই, সরকার রীতি করে নিয়েছে।
বিএনপির শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির অংশ হিসেবে সমাবেশের অনুমতি না দেওয়ার কোনও কারণ ছিল না। যদিও বড় রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি বা সমাবেশ মানে জনগণের চরম ভোগান্তি। বিএনপিকে সমাবেশের অনুমতি না দেওয়ার ক্ষেত্রে জনগণের ভোগান্তি বিবেচনায় নিয়ে তো আর সরকার সিদ্ধান্ত নেয়নি। কারণ, জনভোগান্তির উপলক্ষ সরকার বা আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনই বেশি ঘটায়।
বিএনপি বা বিরোধীদের কর্মসূচির সময় সরকার হঠাৎ করে জনবান্ধব হয়ে ওঠে।
বিএনপি নেতাকর্মীরা কালো পতাকা প্রদর্শনের জন্যে জড়ো হয়েছিলেন ফুটপাতে। সংখ্যা বাড়ায় তা রাস্তায় চলে আসে। যদিও তখন পর্যন্ত পুরো রাস্তা বন্ধ হয়নি। রাস্তা বন্ধ করা ঠিক নয়।কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতায় রাজনৈতিক কর্মসূচিতে রাস্তা বন্ধ করাটাই সবচেয়ে স্বাভাবিক ঘটনা। রাস্তা বন্ধ করতে দেওয়া হবে না, এমন উদ্যোগ নিলে তা হবে প্রশংসনীয়। তা প্রয়োগ করতে হবে সব দলের ক্ষেত্রে। শুধু বিরোধীদলের জন্যে নয়।
৩. কালো পতাকা প্রদর্শনের নামে রাস্তা বন্ধ করে জনভোগান্তি সৃষ্টি করা হয়েছিল, এ কারণে পুলিশ ব্যবস্থা নিয়েছে।
কয়েকশ’ মানুষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নামে পুলিশ, জলকামান- রঙ্গিন পানি- গরম পানির ব্যবহার করেছে। একজন কালো পতাকা প্রদর্শনকারীকে, সাদা পোশাকের পাঁচ সাতজন পুলিশ মাটিতে ফেলে গলা টিপে ধরেছে। সরকার প্রতিদিনই মুখে মুখে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করে ফেলে। যে আইনের শাসন মানে, একজন রাজনৈতিক কর্মীর গলা টিপে ধরবে সাতজন পুলিশ। যে আইনের শাসনে বাংলাদেশ একটি পুলিশি রাষ্ট্র। কালো পতাকা প্রদর্শনের জন্যেও সেই রাষ্ট্রে পুলিশের অনুমতি নিতে হবে। তা প্রযোজ্য হবে শুধু বিরোধীদলের ক্ষেত্রে, এবং বিরোধীরা অনুমতি চাইবে কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে পাবে না। রাস্তায় নামলেই গলা টিপে ধরা হবে।
৪. বাংলাদেশের রাজনীতিতে কৌতুককর কিছু উপাদান সব সময়ই থাকে। মন্ত্রিত্ব হারিয়ে হাছান মাহমুদ সেই স্থানটি গত কয়েক বছর দখল করে রেখেছেন। এখন তার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছেন সড়ক ও সেতু মন্ত্রী, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। খালেদা জিয়া কক্সবাজার গেলেন। ওবায়দুল কাদের বললেন, অরাজকতা তৈরির জন্যেই খালেদা জিয়া সড়ক পথে গেছেন। কেন তিনি সড়ক পথে গেলেন? ঠিকই তো, খালেদা জিয়া কেন সড়ক পথে যাবেন! যেখানে ছাত্রলীগের সভাপতি যান হেলিকপ্টারে!
কালো পতাকা প্রদর্শনে পুলিশি তাণ্ডবের পর ওবায়দুল কাদের বিএনপিকে, ঘরের ভেতরে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করার উপদেশ দিয়েছেন। স্বৈরাচারী শাসনে তেমন নজিরই ছিল। ওবায়দুল কাদের কি স্বীকার করে নিচ্ছেন, এখন বাংলাদেশের মানুষ তেমন শাসনেই আছে?
৫. সরকার বিনাভোটের নির্বাচনে গঠিত হলেও, সরকারের পরিচয় তো গণতান্ত্রিকই। মানুষের প্রতিবাদ করার অধিকার আছে। আইন করে তা বন্ধ করা হয়নি। এখনকার আওয়ামী লীগের বক্তব্য, রায় দিয়েছে আদালত, সরকার নয়। আদালতের রায় মানতে হবে, আদালতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা যাবে না।
কী চমৎকার বক্তব্য! আদালতের বিরুদ্ধে লাঠি মিছিলের কথা হয়তো মানুষ ভুলে গেছে। কিন্তু ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের প্রসঙ্গ তো মানুষ ভুলে যায়নি। আদালত, প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে দেওয়া বক্তব্যের কথা কি আওয়ামী লীগ এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেল? জনগণ তো ভোলেনি। প্রধান বিচারপতিকে এত নাটক আয়োজন করে বিদেশে পাঠানো হলো। তার বিরুদ্ধে নাকি ১১টি সুনির্দিষ্ট গুরুতর অভিযোগ। সব অভিযোগ বক্তব্যে থাকল, বিদেশে পাঠানোর আগে পর্যন্ত। দুর্নীতি, নৈতিক স্খলনের অভিযোগে বিচার নয়, বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া! এর নামও আইনের শাসন।
৬. সমতাভিত্তিক সমাজ গড়ার উদ্যোগ না নিলে, যত সময় যাবে তত বেশি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে হবে। পুলিশি রাষ্ট্র কায়েম করে ক্ষমতায় হয়তো থাকা যাবে, জনসমর্থন পাওয়া যাবে না। জনসমর্থন ছাড়াও ক্ষমতায় থাকা যায়, এমন নজির পৃথিবীর বহু দেশে আছে, ছিল। কোনও কোনও কট্টর একনায়ক শাসিত দেশও সমৃদ্ধ হয়েছে। নজির আমাদের আশপাশেও আছে। সেসব দেশের একনায়কদের সময়ে আর্থিক অসততা বা অনিয়ম ছিল না। তাদের কারও জামানায় রাষ্ট্রায়ত্ত কোনও ব্যাংক লুটপাট হয়ে যায়নি, নিয়ম করে প্রতি বছর দেশ থেকে ৭৬ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যায়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি হয়নি। ৩০০ কোটি টাকার একটি ফ্লাইওভারের বাজেট ১২০০ কোটি টাকা বাড়িয়ে ১৫০০ কোটি টাকা করে, ১২০০ কোটি টাকা চুরি করা হয়নি। লুটপাটকারীরা ক্ষমতা বলয়ের কাছাকাছি থাকার সুযোগ পায়নি।
কাগজের ‘উন্নয়ন’র গল্পের সঙ্গে দেশের সাধারণ জনমানুষের তেমন কোনও সম্পর্ক নেই। ক্ষমতা বলয়ের কাছের অল্প কিছু মানুষের আয় বাড়ছে, অনিয়ম- দুর্নীতি করে। দেশের অধিকাংশ নিম্ন আয়ের মানুষের আয় আরও কমছে। ‘উন্নয়ন’র এত গল্পের মাঝে সরকারি পরিসংখ্যানও তেমনটাই বলছে।
মানুষের কথা বলার অধিকার কেড়ে নেওয়ার উদ্যোগ নিলে, শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচি জঙ্গি কায়দায় প্রতিরোধ করলে, সহিংসতাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। কৌশল কি তেমনটাই!
লেখক: গোলাম মোর্তোজা, সম্পাদক, সাপ্তাহিক।