আজ ভয়াল ২৯শে এপ্রিল, দুঃসহ স্মৃতি এখনো তাড়া করে উপকূলের মানুষকে
অনলাইন ডেস্ক । কাগজটোয়েন্টিফোরবিডিডটকম
আজ ভয়াল ২৯ শে এপ্রিল। ১৯৯১ সালের আজকের এই দিনে ‘ম্যারি এন’ নামক প্রলংকরী ঘূর্ণিঝড় লন্ড ভন্ড করে দেয় দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকার পূরো উপকূল।
লাশের পরে লাশ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল চারদিকে। বিস্তীর্ণ অঞ্চল ধ্বংস্তূপে পরিণত হয়েছিল। দেশের মানুষ বাকরুদ্ধ হয়ে সেদিন প্রত্যক্ষ করেছিল প্রকৃতির করুণ এই আঘাত। স্বজন হারার আর্তনাদে ভারি হয়ে ওঠে চারিদিকের পরিবেশ। প্রাকৃতিক দূর্যোগের এত বড় অভিজ্ঞতার মুখোমুখি এদেশের মানুষ এর আগে আর কখনো হয়নি। পরদিন সারা বিশ্বের মানুষ অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখেছিলেন ধ্বংসলীলা।
প্রলংকরী ঘূর্ণিঝড়ে নিহতের সংখ্যা বিচারে পৃথিবীর ভয়াবহতম ঘূর্ণিঝড় গুলোর মধ্যে অন্যতম। এ ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড়টিতে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘন্টায় প্রায় ২৫০ কিঃ মিঃ (১৫৫ মাইল/ঘন্টা)। ঘূর্ণিঝড় এবং তার প্রভাবে সৃষ্ট ৬ মিটার (২০ ফুট) উঁচু জলোচ্ছ্বাসে সরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা ১ লাখ ৩৮ হাজার ২৪২ জন। তবে বেসরকারি হিসাবে এর সংখ্যা আরো বেশি। মারা যায় ২০ লাখ গবাদিপশু। এদের বেশিরভাগই নিহত হয় চট্টগ্রাম জেলার উপকূল ও দ্বীপসমূহে। সন্দ্বীপ, মহেশখালী, হাতীয়া দ্বীপে নিহতের সংখ্যা সর্বাধিক। এরমধ্যে শুধু সন্দ্বীপে মারা যায় প্রায় ২৩ হাজার লোক।
কর্ণফুলি নদীর তীরে কংক্রিটের বাঁধ থাকলেও এটি জলোচ্ছ্বাসে ধ্বংস হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের ১০০ টন ওজনের একটি ক্রেন ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে স্থানচ্যুত হয় এবং আঘাতের কারণে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। বন্দরে নোঙর করা বিভিন্ন ছোট বড় জাহাজ, লঞ্চ ও অন্যান্য জলযান নিখোঁজ ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যার মধ্যে নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর অনেক যানও ছিল। এছাড়াও প্রায় ১০ লাখ ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
গৃহহারা হয় হাজার হাজার পরিবার। ক্ষতি হয়েছিল ৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি সম্পদ। এবং প্রায় এক কোটি মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে খোলা আকাশের নিচে বসবাস করে। এই ঘূর্ণিঝড়ে চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। ‘ম্যারি এন’ নামে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছিল নোয়াখালী, চট্টগ্রামসহ দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকা আর পূরো উপকূল। উপকূলবাসী আজও ভুলতে পারেনি সেই রাতের দুঃসহ স্মৃতি।
ঘূর্ণিঝড়টি সেই দিন প্রত্যক্ষ করেছিলেন ও স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন, রেডক্রিসেন্ট কক্সবাজার জেলা ইউনিটের সদস্য ও পেকুয়ার টীম লিডার এম মনজুর আলম সেই দিনের কথা বলেন, সেদিন আমাদেরকে জানানো হয়েছিল সমুদ্রে ঝড় ওঠেছে। তখন আমি আমার সাধ্য মতো সবাইকে খবরটি পৌঁছাতে চেষ্টা করি, সবাইকে রেডিও শুনতে বলি তখন কিন্ত যোগাযোগ ব্যাবস্থা তেমন উন্নত ছিল না এমনকি মানুষ সচেতন ছিল না।
আকাশ মেঘলা ছিল হঠাৎ হালকা বৃষ্টি পড়তে শুরু করে তখন আমরা কিছুটা বুজতে পারছিলাম, সন্ধ্যা হতে না হতেই সংকেত বাড়তে শুরু করে তখন আমরা প্রচার শুরু করি আমি নিজে প্রচার করতে করতে রাত অনেক হয়ে যায় এক পর্যায়ে আমি সরাসরি গোয়াখালী সাইক্লোন সেন্টারে মানুষ আনা শুরু করি বাতাসের গতিবেগের কারনে সবাই ভীত হয়ে যায় হঠাৎ পানি চলে আসে রাত ৩টার দিকে আমার বাড়িতে পানি ওঠে তখন দেখি আমার বাড়ির উঠান দিয়ে মানুষ ভেসে যাচ্ছে। আমরা মহান আল্লাহকে স্মরণ করতে থাকি সকাল হলে দেখি চারিদিকে লাশের মিছিল আমরা এলাকা বাসির সহায়তায় লাশ দাফন করার ব্যাবস্থা করি চারিদিকে এক হৃদয় বিদারক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। আমরা বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট এর সহযোগিতায় ত্রানের ব্যাবস্থা করি। আমার জীবনে সবচেয়ে ভয়াবহ অভিজ্ঞতা ছিল এটি বলে তিনি উল্লেখ করেন।
শতাব্দীর এই প্রলয়ঙ্করি ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে বৃহত্তর চট্টগ্রাম এবং দেশের উপকূলীয় অঞ্চল মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়। ধ্বংস স্তূপে পরিণত হয় কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদ। প্রলয়ঙ্করি এই ধ্বংসযজ্ঞের ২৭ বছর পার হতে চলেছে। এখনো স্বজন হারাদের আর্তনাদ থামেনি। ঘরবাড়ি হারা অনেকে মানুষ এখনো মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিতে পারেনি। এই ঘুর্ণিঝড়ে পেকুয়া ও কুতুবদিয়া এবং বাঁশখালীতে বেশি মানুষ মারা গিয়েছিলেন। এসব এলাকা কিছু অংশে এখনো বেড়িবাঁধ নেই। তাই আতঙ্কে আছেন কয়েক লক্ষাধিক মানুষ।
সন্দ্বীপের অনেক জায়গায় এখনো বেড়িবাঁধ নেই। আবার থাকলেও কোনো বেড়িবাঁধের উচ্চতা চার ফুটের বেশি নয়। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস থেকে সন্দ্বীপকে রক্ষা করতে দ্বীপের চারদিকে কমপক্ষে ১০ ফুট উঁচু বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা জরুরি।
এই ঘূর্ণিঝড়ে দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ায় প্রাণহানি হয়েছিলো প্রায় ৮ হাজার লোকের। স্বজন হারানোর বেদনায় এখনো কাঁদে হাতিয়ার বাসিন্দারা। ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের ২৬ বছর অতিবাহিত হলেও উপকূলীয় মানুষের সুরক্ষায় নেয়া হয়নি কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। দ্বীপের চারপাশে নির্মাণ করা হয়নি মজবুত কোনো বেড়িবাঁধ। তাই প্রতি বছর জোয়ার ও বন্যার পানিতে তলিয়ে যায় দ্বীপের শত শত একর জমির ফসল। সাগরে কোনো লঘুচাপ, নিম্নচাপ কিংবা মেঘ দেখলেই আতঙ্কে চমকে ওঠেন উপকূলবাসী।
চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকায় বাঁধ সমূহ বর্তমানে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। এমনকি চট্টগ্রাম শহর রক্ষা বাঁধের বিরাট অংশ এখন বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের পরে নেয়া পরিকল্পনার মধ্যে স্বল্প মেয়াদী পরিকল্পনার কিছু বাস্তবায়ন হলেও মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা সমূহের বেশির ভাগই বাস্তবায়ন হয়নি। উপকূলীয় এলাকা ও দ্বীপাঞ্চলে যে পরিমাণ সাইক্লোন শেল্টার সেন্টার নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল তাও করা হয়নি। তার ওপর বিদ্যমান সাইক্লোন শেল্টারগুলো রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ব্যবহার অনুপযোগী। কোথাও কোথাও সাইক্লোন শেল্টার সাগর ও নদী ভাঙনের কারণে অস্তিত্ব হারিয়েছে। যার কারণে ২৭ বছর পরেও উপকূল আজও নিরাপদ নয়।