সেলিনা জাহান প্রিয়ার – এক নয়নের গল্প
এক নয়নের গল্প
————— সেলিনা জাহান প্রিয়া
সকাল থেকে আকাশটা মেঘ মেঘ । আর যে গরম একটু বৃষ্টি হলে ভাল হত। রিক্সা টা সাইড করে টং দোকান থেকে এক কাপ চা একটা নুনতা বিস্কুট আর এক গ্লাস পানি খেয়ে নিল। শরীরের ঘামটা মুছে একটা খেপের জন্য অপেক্ষা করছে। পড়নে লঙ্গি খালি গা একটা গামছা শরীরে ঝুলানো। এর মধ্য একজন ডাক দেয় এই খালি মহাখালি যাবে। মালিবাগ থেকে মহাখালি ভাড়া টা চুকিয়ে যাত্রী তুলল। কিছু দূর যেতেই যাত্রী ভদ্র লোক বলল ড্রাইভার তোমাকে চেনা চেনা লাগছে। তোমার নাম কি?
— ৫৫ বছরের চালক বলল আমার নাম রমিজ।
— ৩০ বছরের যুবক বলল। তোমার নাম রমিজ।
— হা স্যার আমার নাম রমিজ।
— তোমার বাড়ি?
— আমার বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জ থানার খুদি জঙ্গলবাড়ি। কেন স্যার? আপনার বাড়ি কোথায়?
— আপনার এলাকায়।
— স্যার রিক্সা চালকে খুব কম মানুষ আপনে করে বলে। আগে তুমি বলছেন আর এখন আপনি করে বলছেন!
—- আমি মহাখালি যাব না। আপনি আমাকে খিলগাঁও নিয়ে যান। ভাড়া যা চান দিব। একটু ভুল করে চলে আসছি। আপনার ছেলে মেয়ে সংসার নাই।
— না স্যার। কিছুই নাই এখন।
— কেন বিয়ে শাদী করেন নাই।
—- স্যার এই বিষয় নিয়ে কোন কথা বলব না।
— কেন?
— মানুষের জিবনে অনেক ঘটনা আছে। কিছু বলা যায় কিছু বলা যায় না।
—- ঢাকা কোথায় থাকেন।
—- মিরহাজারি বাগ।
— কে কে আছে।
—- আমি আর আমার বুড়া মা।
—- ভাল। তাহলে বলবেন না।
—- না স্যার। বলব না।
—- আমাকে কি চেনা যায়।
—- ঘার ফিরিয়ে দেখল আর একবার না স্যার চিনতে পারলাম না।
—- ভাল করে দেখেছেন।
— জি স্যার। দেখেছি। কিন্তু চিনতে পারি নাই। আপনার বাড়ী কি আমাদের জেলায়।
— হ্যা। আপনাদের জেলায়। তা বাড়িতে যান না কত বছর।
—- এই তো তেইশ বছর হল।
— কারো কথা মনে পড়ে না।
— আমার খবর কেউ নেয় না। আমি কার খবর নিব। স্যার আপনি কে? কি করেন? মনে হয় সরকারি চাকুরি করেন।
— হ্যা আপনি ঠিক বলেছেন। আমি ইঞ্জিনিয়ার। রিক্সা চালানোর আগে কি করতেন।
—–রিক্সা চালাবার আগে জুট মিলে চাকুরি করতাম পলাশ থানায়।
—– তার পর।
—– তার পর আর বলতে চাই না। আপনি খারাপ মনে করবেন।
—– না মনে করব না।
—– চাকুরি করা অবস্তায় এক স্যারের কথায় মিলের কিছু পাট ট্রাকে তুলে দেই। পড়ে পুলিশ চুরির অভিযোগ আমাকে এরেস্ট করে। যে স্যারের কথায় কাজ করলাম সেই স্যার আমাকে পুলিশে দেয়। ৫ বছর জেল খেটে বের হই। গ্রামে যেয়ে আর স্ত্রী পুত্রকে পাইনা। শ্বশুর বাড়ি যাই তারাও বলে জানে না। জুট মিল এলাকায় যাই। তাদের আর পাইনা। পরে চলে যাই চিটাগাং। সেই খানে ১২ বছর থাকি। পরে ছোট ভাই ঢাকা নিয়ে আসে। এখন সে বিয়ে করে আলাদা আর আমি মা কে নিয়ে থাকি।
—- ছেলে কে আর পান নাই।
—- না আর পাই নাই। অনেক বার তার মামাদের সাথে যোগাযোগ করেছি। বিচার বসাইছি। তারা আরও বলে আমার নামে মামলা করবে আমি নাকি ওদের বোন কে মেরে ফেলেছি। স্যার কাউকে বলতে চাই না। মানুষ হিসাবে আমি খুব খারাপ। মিথ্যা মামলা জেল। সব মিলাইয়া আজ ও খুব কষ্ট পাই। স্যার আমার বউ অনেক সুন্দর ছিল। আমি বিয়া করেছিলাম নান্দাইল। এটা।
— আপনার ছেলের নাম কি ছিল?
— আমার ছেলেটা তার মায়ের রঙ পাইছিল নাম রাখছিলাম নয়ন। নয়ন ছিল স্যার নয়নের মত। মেইল গেইটে ছুটির সময় আমার জন্য চলে আসত। রিক্সার যুবক বলল- আপনার জীবন টা যেই লোক নষ্ট করল তাকে কি আপনি এখন চিনবেন।
—- স্যার কেয়ামত পর্যন্ত চিনব। তবে ঐ লোক টাকে আমি ভুলব না।
—- আপনি তাকে কি করবেন?
—- আমি কি আর করব গরীব মানুষ। তবে একটা চর দেয়ার ইচ্ছা। স্যার আমি আমার জীবনের কথা কাউকে বলি না। আজ ও বলতে চাই নাই কিন্তু কথার ফাকে চলে আসছে।
কথায় কথায় রিক্সা চলে এসেছে খিলগাঁ। গরমে শরীর দিয়ে ঘাম বেয়ে পড়ছে। রিক্সায় বসা ছেলেটা রিক্সা থেকে নেমে রমিজ মিয়ার দিকে ফেল ফেল করে তাকিয়ে আর চোখের পানি রাখতে পারছে না। রমিজ মিয়া বলে স্যার আপনার চোখে পানি কেন? যুবক রমিজ মিয়া কে জরিয়ে ধরে বলে আমি আপনার ছেলে নয়ন। রমিজ মিয়া বলে স্যার আমার সাথে মিছা কথা বলে কেন আমাকে কষ্ট দিচ্ছেন। নয়ন রমিজ মিয়া কে বলে আমার সাথে ভিতরে আসুন। দারোয়ান কে ডেকে বলল এই রিক্সাটা খেয়াল রাখো। রমিজ মিয়া যুবকের সাথে বিশাল একটা দালানে উঠে। লিফট থেকে নেমে একটা ফ্ল্যাটে প্রবেশ করে। রিক্সা চালক রমিজ মিয়া অবাক হয়। দেখে তার বউ সীমা। ছেলে বলে এখন তো বিশ্বাস হল যে আমি আপনার ছেলে। নয়ন মাকে বলে মা আমাকে কোনো চোরে জন্ম দেয় নাই। আমি কোনো চোরের ছেলে না। রমিজ মিয়া কে পাশের ঘরে নিয়ে যায়। দেখে বিছানায় একটা প্যারালাইস মানুষ শুয়ে আছে। রমিজ মিয়া বলে বাবা মরা মানুষ কে কি আর বলব। তবে এই মানুষটা যাই করুক তোমাকে মানুষের মত মানুষ করেছে। আল্লাহ তাকে মাপ করুক।
নয়ন তার মাকে বলল – মা তোমাকে দেখার মত তোমার আরও দুই ছেলে আছে। রমিজ মিয়া এখন ঠিক বুঝে গেছে এই ম্যানেজার তার বউ কে পাওয়ার জন্য এত কিছু তার বিরুদ্ধে করেছে। রমিজ মিয়া দামি বাসা থেকে বের হয়। শেষ বারের মত আর একবার তার বউ কে দেখে বলে দোয়া করি ভাল থাক। নয়ন তার বাবার সাথে নীচে নামে। রমিজ মিয়া তার ছেলে কে বলে বাবা আমার জন্য তোমার মা কে ভুল বুঝনা। মানুষের জীবন কখন কি হয় আল্লাহ্ জানে। নীচে নেমে দেখে খুব বৃষ্টি হচ্ছে রমিজ মিয়া রিক্সা বের করে ছেলে এসে বলে বাবা তুমি রিক্সায় বস আমি তোমাকে চালিয়া নিয়ে যাই। ছেলে কে বুকে জড়িয়ে বলে তুমিই আমার বাবা এই রিক্সাওলা বাপরে যে তুমি নিজের বুকে নিয়েছ। আল্লাহ যে তোমার মুখটা আবার দেখাইছে এতেই আল্লাহর কাছে আমি সুখি। ছেলে কে জোর করে রিক্সায় বসায়ে বলে নয়ন হুড তুলে দেও বাবা তোমার ঠাণ্ডা লাগবে। নয়ন বাবার রিক্সায় বসে তার বাবা তাকে বার বার পিছন ফিরে দেখে আর বৃষ্টির কান্যা চোখে হাসে। নয়ন বলে বাবা আমি কোয়াটার পেয়েছি তুমি আমি আর দাদি এক সাথে থাকব। নয়নের বাপ বলে বাপজান তুমি যা বলবে তাই হবে………………………