এবারে ভারতের লোকসভা নির্বাচন
এবারে ভারতের লোকসভা নির্বাচন
রণেশ মৈত্র
বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচন কোন না কোন ভাবে সমাপ্ত হলো। নির্বাচনের আগের রাতেই গোপনে ব্যালট পেপার কেটে বাক্স বোঝাই, বিরোধী দলীয় পোলিং এজেন্টদের ঢুকতে না দেওয়া বা বুথ থেকে তাদেরকে বের করে দিয়ে একতরফা সিল মারা, পুলিশ ও নির্বাচনী কর্মকর্তাদের এহেন কাজে নিয়োজিত হওয়া থেকে যাবতীয় অনিয়মের বহু কাহিনী প্রচারিত আছে। শতভাগ অভিযোগ যদি সত্য না ও হয় অনেকটাই যে সত্য তাতে সন্দেহ নেই।
তবে একটি ঘটনা এবারে ঘটেনি তেমন একটা। নির্বাচনের আগে পরে সংখ্যালঘু নির্য্যাতন, প্রতিমা ও মন্দির ভাংচুর, বাড়ীঘর দখল প্রভৃতি জাতীয় ঘটনার খবর তেমন একটা আসেনি। অন্তত: অতীতের মত ব্যাপকভাবে ঘটেনি। কিন্তু বাদও যায়নি একেবারে। কিছু গ্রামে গ্রামবাসীদের উপর নির্য্যাতন হয়েছে এমন খবর গুরুত্বসহকারে সংবাদপত্রগুলিই প্রকাশ করেছে। সর্বাধিক আলোচনা ঘটনা হলো সুবর্ণচরের চার সন্তানের মাকে তাঁর স্বামী সন্তানদের সামনেই ধর্ষণ বা গণধর্ষণ করেছে। কী মারাত্মক। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় ধর্ষণ আজ যেন দিব্যি নৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। আর যেহেতু সাধারণত: এর কোন প্রমাণ থাকে না সুতরাং ম..। তবে এবারের ঘটনাবলীতে পুলিশী তৎপরতা লক্ষণীয়। সংশ্লিষ্ট অভিযোগে বেশ অনেককেই গ্রেফতার করা হয়েছে। আশা করবো তাদের কারও জামিন না দিয়ে সত্বর চার্জশীট প্রদান করে দ্রুত বিচার করে কঠোর শাস্তি বিধান করা হোক। শুধু নির্বাচকালীন নয়- সারা বছরই যেন এমন সরকারি তৎপরতা বজায় থাকে।
ইতোমধ্যে বাংলাদেশের নতুন মন্ত্রীসভা গঠিত হয়ে গেল। আজীবনের মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, আমীর হোসেন আমু, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, আসাদুজ্জামান নূর, মতিয়া চৌধুরী, নূরুল ইসলাম নাহিদ, রাশেদ খান মেনন প্রমূখের এক যোগে বাদ পড়া তাৎপর্য্যপূর্ণ। বাদের তালিকায় আরও অনেকে আছেন-যদিও তাঁরা এবং তাঁদের একটি বড় অংশই সততার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ বলে শুনেছি। তবু তাঁদের ভাগ্যে এবার কেন মন্ত্রীত্ব জুটলো না তা জানবার কোন সুযোগ নেই। তবুও আশা করবো নবগঠিত তারুণ্যে ভরা এবং উৎসাহ উদ্দীপনায় প্রাণবন্ত এই মন্ত্রীরা তাঁদের কাজের ক্ষেত্রে নতুনত্ব দেখাবেন-দেশকে সকল দিক থেকেই এগিয়ে নেবেন। সকলেই আমাদের তীক্ষ্ম নজর থাকবে তাঁদের কাজকর্মের দিক। আমরা পরিচিত সাংসদদের এবারে আর নতুন মন্ত্রীসভায় ঠাঁই হয়নি বলে মনটা একটু খারাপ লাগছে বটে।
এবারে আসা যাক অত্যাসন্ন ভারতীয় লোকসভার নির্বাচনের দিকে। বিশ্বব্যাপী ঝোঁকই হলো জোট ভিত্তিক নির্বাচন। যেমন বাংলাদেশ মহাজোট, ১৪ দলীয় জোট, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট, বাম গণতান্ত্রিক মোর্চা প্রভৃতি। প্রতিটি জোটেরই পৃথক পৃথক কর্মসূচি থাকলেও, মহাজোট ও ১৪ দলীয় সরকার সমর্থিত জোট ব্যতিরেকে বাদ-বাকি বিরোধী দলের জোটের আশু কর্মসূচিতে মোটামুটি মিল থাকলেও কোন ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের কথা তাঁরা ভাবছেন বলে মনে হয় না। তেমন কোন লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না।
কিন্তু ভারতে তো অসংখ্য জোট। কি কেন্দ্রে কি প্রদেশগুলিতে। সরকারি দল বি.জে.পি একটি জোট করেই চার বছর আগে জনগণকে অসংখ্য প্রতিশ্রুতি দিয়ে দিল্লীর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসে চমক দেখিয়েছিলেন। কারণ সংবিধান লিখিত “ধর্মনিরপেক্ষতা” শব্দটিকে তারা বাংলাদেশের মত সংবিধান সংশোধন “শ্রী শ্রী দূর্গা সহায়” (বিসমিল্লার পরিবর্তে, নিষিদ্ধ ঘোষিত ধর্মান্ধ দলগুলিকে বৈধতা দেয়নি বা রাষ্ট্রধর্ম হিন্দু” বলে সংবিধানে কোন সংশোধনী…। সম্ভবত: কৌশল হিসেবেই। কিন্তু গোটা দেশ জুড়েই সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বন্যা ছুটিয়ে দিয়েছিল। এটা সম্ভব হয়েছিল ভারতের জাতীয় সংগ্রেস গণ আস্থা হারিয়ে ক্ষুত্র একটি দলে পরিণত হওয়া, বাম শক্তিগুলি অতিশয় দূর্বল হয়ে পড়া এবং প্রাদেশিক/আঞ্চলিক দলগুলির অনেকেই কংগ্রেস ছেড়ে আসা। বিষয়টা ভারতের বিবেকবান প্রগতিশীল কোট কোটি মানুষকে ভারতের অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্য সম্পর্কে হতাশাগ্রস্থ করে তোলে।
তবে ভরসার কথা, ভারতে কিন্তু কাল হলো সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা যখন যেখানেই হোক-মানুষ তার প্রতিবাদে রুখে দাঁড়ায় এবং শেষ পর্য্যন্ত থানা পুলিশও সক্রিয় হয় বিচার শেষে অপরাধীরা কঠোর শাস্তি ও পায়। ফলে অবস্থা অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আসে।
আমরা দেখেছি, মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষদের গো-হত্যা, গোমাংস ভক্ষণের বিরোধিতা করতে সাম্প্রদায়ক হিন্দুরা ধর্মের নাম করে এমন কি বেশ কয়েকজন নির্দোষ মুসলিমকে ও হত্যা করে, ক্ষেত্র-বিশেষে বাড়ীঘর ও জ্বালিয়ে দেয় নির্দোষ কতিপয় মুসলিমের। এর বিরুদ্ধে প্রথমে সে দেশের বুদ্ধিজীবী, বিদগ্ধজনেরা, সংবাদপত্র ও সাধারণ মানুষ-এমন কি বিদেশীরা পর্য্যন্ত প্রতিবাদ তোলে। ফলে ধীরে ধীরে তা বন্ধ হয়ে আসে।
আরও একটি ভয়াবহ উপসর্গের মুখোমুখি হতে হয়েছিল ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়কে। সাম্প্রদায়িক উগ্রতাবাদী হিন্দুরা বলতে শুরু করে যেহেতু ভারতবর্ষে মুসলমানরা এসেছে অনেক পরে এবং তার আগ পর্য্যন্ত দেশটি ছিল হিন্দুদেরই একচ্ছত্র, তাই মুসলমানদের হিন্দু বানাতে হবে। যে কথা সেই কাজ। শুরু হয়ে গেল মুসলমানদের হিন্দু বানানোর প্রক্রিয়া। বিষয়টি দ্রুতই ছড়িয়ে পড়তে থাকে ভারতের সর্বত্র। আর এ কাজটির প্রধান উদ্যোক্ত ছিল বিজেপির আসল তাত্ত্বিক আর এসএস নামক ভয়াবহ জঙ্গী সংগঠন। কিন্তু এ ব্যাপারেও খুব বেশী একটা এগুতে পারেনি। একই ধরণের নানা মহল থেকে তীব্র ও সক্রিয় প্রতিবাদ উত্থাপিত হলে শেষ পর্য্যন্ত বিজেপিকে ঐ আত্মঘাতী পথ থেকে সরে আসতে হয়। রক্ষা পাওয়া গেল মারাত্মক এক দুর্য্যােগ থেকে। এ সবই ঘটেছে নানা অঙ্কশের ও কেন্দ্রের বিজেবি নেতাদের অনুপ্রেরণায় আবার নেমেছে ও দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চাপে।
এগুলি যখন ঘটেছিল তখন বিজেপির সামনে পার্লামেন্ট নির্বাচন ছিল না। কিন্তু যতই নির্বাচন এগুচ্ছে ততই দেখা যাচ্ছে বিজেপি ঘরছাড়া হয়ে যাচ্ছে। মোদীর নিজস্ব রাজ্যে বিজিপি হেরেছে। পরপর অনুষ্ঠিত আরও অনেকগুলি প্রদেশের নির্বাচনেও বিজেপি মারাত্নকভাবে হেরেছে। দিন যতই যাচ্ছে ততাই তাদের পরাজয়ের মাত্রা বাড়ছে। এখন বলা যায় ভারতের প্রদেশগুলির তিন চতুর্থাংশ প্রদেশই বিজেপি বর্জিত প্রদেশ পরিণত হচ্ছে। যার ফলে দিনে দিনে বিজেপি আর এস এস মার্কা দলগুলি আরও অনেক বেশী উগ্র হয়ে উঠছে এবং মরিয়াও হয়ে পড়ছে।
কিন্তু কোন পথে এগুবে তারা ? বিজেপির এই পরাজয়ের কারণ বিগত ২০১৫ সালের নির্বাচনে জাতিকে তারা যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল-যে নির্বাচনী কর্মসূচি দিয়েছিল তা তারা পূরণ করে নি। বিপরীতে তারা কৃষক স্বার্থ বিরোধী, শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী, মধ্যবিত্ত স্বার্থ বিরোধী কাজকর্মও বিস্তর। এহেন বিজেপি বিরোধী মনোভাব তুঙ্গে উঠেছে বললেও সম্ভবত: ভুল হয় না। এর প্রত্যয় প্রমাণ আমরা দেখতে পাই লক্ষ লক্ষ কৃষকের দিল্লী মুখী পদযাত্রা শত শত কিলোমিটার পত্র অতিক্রমণ।
আর এই পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই লাভবান হচ্ছে বিজেপির এক নম্বর পথ ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস। যে কংগ্রেস পূরোপূরি নেতৃত্বহীন হয়ে এক মহাশূণ্যতায় আবর্তিত হচ্ছিল-সেই কংগ্রেসের নেতৃত্ব গ্রহণ করেছেন রাহুল গান্ধী। রাহুলের প্রতি আস্থা জানাচ্ছেন দেশব্যাপী কংগ্রেসের নেতা-কর্মীরা। নতুন এক জোয়ার বইতে শুরু করেছে কংগ্রেসের প্রাসাদে। এই নেতৃত্বে ভীত হয়ে বিজেপি নানা রাজ্য থেকে নানা সুযোগ সুবিধা, বিস্তর টাকা পয়সা দিয়ে নানা অঞ্চলে কংগ্রেস সমর্থক অন্যদলের নেতৃত্বকে বা তার এক অংশকে তাদের দলে টানার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বিরামহীনভাবে। দু একটি ক্ষেত্র সফল হলেও মূল চিত্রটা হলো বিজেপির ব্যর্থতার।
সে কারণেই দেশব্যাপী বড় বড় বিক্ষোভ কংগ্রেস জনগণের বিক্ষোভের বিষয়গুলির প্রতি সমর্থনই শুধু জানায়নি-অনেক ক্ষেত্রে তাঁরা নিজেরাও যোগ দিয়ে বিক্ষোভের প্রতি তাঁদের গভীর একাত্বতা প্রকাশ করেছেন।
এই পরিস্থিতিতে ভীত হয়ে বিজেপি তাদের শেষ অথচ অব্যর্থ অস্ত্রটি প্রয়োগের পাঁয়তারা করছে। তারা হিন্দু মুসলামনের মধ্যে নিভেদ আনতে চায় এবং সে লক্ষ্যে তাদের মোক্ষম অশ্রটি হলো বাবরি মসজিদ নির্মাণ। অর্থাৎ বাবরি মসজিদের অবশেষ টুকু ভেঙ্গে ঐ একই জায়গায় বাবরি বা রামমন্দ্রির নির্মাণ। বিষয় অনেক দিনের পুরাতন। নব্বই এর দলকে সমগ্র ভারতবর্ষ থেকে দু’একটি ইট হাতে করে মানুষের ঢল এসে বাবরি মসজিদকে ক্ষত বিক্ষত করে। বহু পুরাতন ঐ মসজিদটির একটি অংশ ভেঙ্গেও পড়ে। পরিণতিতে গোটা ভারতবর্ষে ও বাংলাদেশে অসংখ্য প্রাণহানি মন্দির মসজিদ ভাংচুর করে দু’দেশে ভয়াবহ আতংক সৃষ্টি করা হয়।
পরবর্তীতে বাবরি মসজিদ অতীতে মসজিদ ছিল না কি রামমন্দির ছিল তা নিয়ে ভারতের উচ্চ আদালতে একটি মামলা আজও বিচারাধীন।
এ অবস্থায় তারা সম্প্রদায়িকতা তুঙ্গে তুলে হিন্দু মসুলমানে বিভেদ সৃষ্টি করে বৃহত্তর হিন্দু ভোট বিজেপির পক্ষে নিয়ে তারা নির্বাচনে বিজয় অর্জন করতে সচেষ্ট।
এ অবস্থায় কংগ্রেস শুধু তার বিরোধীরাই করছেনা। সম্মান অপরাপর জোট নেতাকে তিনি এই বলে আশ্বস্ত করেছেন যে তিনি চান এই নির্বাচনে চরম গণবিরোধী বিজেপিকে হারাতে। তার জন্য তিনি প্রয়োজনে অন্য যে কাউকে প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসতে সহায়তা করতে রাজী।
এখন বিষয়টি হলো বাংলাদেশের সদ্য অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মত ভারতের আসন্ন নির্বাচনটি সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত হবে কি ? না কি আর একটি সর্বনাশ আসন্ন ?
- প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। কাগজ২৪-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য কাগজ২৪ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।