অবিশ্বাস্য খবরে কাঁপছে দেশ

 

 

অবিশ্বাস্য খবরে কাঁপছে দেশ

ড. মোহিত কামাল

মোবাইল সেট খোলা রাখতে পারছিলাম না। কলের পর কল আসছিল। পরিচিতজনদের কল অ্যাটেন্ড করতে হয়। সবার প্রশ্ন ‘এসব কী বলছে র‌্যাব’? অপরিচিত নম্বর অ্যাভয়েট করে যাচ্ছিলাম। একজন বললেন, ‘টিভিতে র‌্যাবের কথা শুনে স্যার মনে হচ্ছে নিজেই খুন হয়ে গেছি। রক্তাক্ত হয়ে গেছি। প্লিজ মিডিয়াতে ফোন করে এ ধরনের সংবাদ পরিবেশন করতে নিষেধ করুন।’
বললাম, তারা আমার কথা শুনবে না। ঘটনা ঘটলে তার পেছনে ছুটবে ইলেক্ট্রনিক্স অ্যান্ড প্রিন্টিং মিডিয়ার সংবাদকর্মীরা। এটা ওদের পেশাগত দায়িত্ব। ওদের দায়িত্ব পালনে বাধা দিতে পারি না আমরা। ‘তাহলে আমরা কার কাছে আশ্রয় চাইব? এক মহিলা যদি খুনও করে থাকে তার সন্তানদের, খবরটি প্রচার হওয়াতে কি আরও লক্ষ লক্ষ সন্তানের বুকে ভয় জাগিয়ে তুলবে না? মায়ের আসনটি সন্তানদের চোখে অনিরাপদ হয়ে উঠবে না? এটা কি ভালো বিষয়? আপনার কথা তো মিডিয়াতে প্রচার করে, দয়া করে দায়িত্বে অবহেলা করবেন না। একজন সমাজসচেতন ব্যক্তি হিসেবে কিছু একটা করুন’।
লাইন কেটে গেল। রিমোটকন্ট্রোল টিপে টিভি অফ করে দিলাম। মোবাইল অফ রাখতে পারছি না। একটা এসএমএস এলো— প্লিজ অ্যাটেন্ড মাই কল। ইটস আরজেন্ট।
আননোন নম্বরটি থেকে পর মুহূর্তে কল এলো। আরজেন্ট শব্দটির কারণে কল ধরতে বাধ্য হলাম। ভেবেছিলাম আমার কোনো রোগীর জরুরি সমস্যা হয়েছে—সমস্যা হলে আরজেন্ট লিখে আমার পরামর্শ-সহায়তা আশা করেন তারা। না, তেমন কোনো বিষয় না।
অপরপ্রান্ত থেকে এক মহিলার উদ্বিগ্ন কণ্ঠ ভেসে এলো শুনুন প্রফেসর সাহেব, আমার সন্তান টিভিতে অবিশ্বাস্য সংবাদটি দেখে প্রশ্ন করছে, পড়াশোনা না করলে আমাকে কি মেরে ফেলবে তুমি? সে দূর থেকে বড় বড় চোখে দেখছে আমাকে। কাছে আসতে সাহস পাচ্ছে না। পড়াশোনার জন্য তাকে যে কখনো-সখনো বকিনি তা নয়, সেই বকুনি তার মাথায় গেঁথে আছে। মা দুই সন্তানকে পড়ার জন্য মেরে ফেলেছে দেখে, সে ভাবছে আমিও তাকে মেরে ফেলব। কী করব আমি?
হ্যাঁ এমন পরিস্থিতিতে কী করবে সংবাদ মাধ্যম? কী করবে র‌্যাব? কী করবে প্রশাসন? কী করবে জনগণ? কী করবে সচেতন বিশ্ববাসী? এ প্রশ্ন এখন সবার। সর্বত্র আলোচনা হচ্ছে। ঘরে ঘরে মানুষ বিষের ছোবল খাচ্ছে, টিভি অন করতে পারছে না অনেকেই। টিভিতে জাদরেল উপস্থাপকের ক্ষুরধার জিজ্ঞাসায় বেরিয়ে আসছে র‌্যাবের কথা, সংবাদকর্মীদের কথা। টিআরপিকে বাড়ছে ওইসব মিডিয়ার? নাকি কমছে? গবেষণা না করে বলা যাবে না। তবে খোলা চোখে মানুষের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারছি, পত্রিকার পাতা ওল্টাতে তারা ভয় পাচ্ছেন। টিভি অন করতে ভয় পাচ্ছেন। নির্মম ঘটনা ভয় মানুষের মনে মনে, ঘরে ঘরে, পাড়ায় পাড়ায়, দেশজুড়ে, বিশ্বময় ছড়িয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় আইনজীবীরা কী বলছেন?
মামলা হওয়ার আগেই দুই শিশুর বাবা-মা ও খালাকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ এবং সংবাদ সম্মেলন ডেকে স্বীকারোক্তির কথা প্রচার করার আইনগত ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশিষ্ট আইনজীবী শাহদীন মালিক। এ বিষয়ে তিনি বলেছেন, এক কথায় মামলা হওয়ার আগে এসব কার্যক্রম ফৌজদারি কার্যবিধি ও অভিযুক্ত ব্যক্তির সাংবিধানিক অধিকারের পরিপন্থি। তিনি (মা) র‌্যাব বা পুলিশের সামনে যা বলেছেন, তার আইনগত কোনো মূল্যই নেই। এ কথাগুলো ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে বললে তার আইনগত ভিত্তি থাকত। সংবিধানে বলা আছে, কাউকে নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করা যাবে না। সঠিক বিচারের স্বার্থে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আগে তার আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ দিতে হবে। (৪ মার্চ ২০১৬)
যাহোক, র‌্যাবকে আমরা দোষ দিতে পারি না। বরং দ্রুত তারা অ্যাকশনে গিয়েছেন, হত্যার রহস্য উদঘাটনের পথে এগিয়ে যাচ্ছেন। এটা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার বড় শর্ত। এর মধ্যে দুই সন্তান নুসরাত ও আলভীর বাবা আমানুল্লাহ মামলা করেছেন স্ত্রী জেসমিনকে আসামি করে। মামলার তদন্ত চলবে। হয়ত হত্যার ‘মোটিভ’ পুরোপুরি বোঝা যাবে তখন। দুই শিশুর বাবা আমানুল্লাহ হত্যার ঘটনা জানতো কিনা—বিষয়টি এখনো খোলাসা হয়নি। তাকেও সন্দেহের তালিকা থেকে মুক্তি দেয়নি র‌্যাব। এটি তদন্ত কাজকে আরো সহজ করবে বলে মনে হচ্ছে। বিশেষ করে স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য জীবনে চলমান কোনো সংকট ছিল কিনা, সম্পত্তি নিয়ে কোনো বিরোধ ছিল কিনা ইত্যাদি অভ্যন্তরীণ বিষয়ে খোঁজ নেবেন তদন্ত কর্মকর্তা, এমনটিই আশা করা যায়। দাম্পত্যজীবনের কোনো সংঘাত থেকে থাকলে, উদঘাটিত হলে তা যেন কেবল আইনগত প্রক্রিয়ার কাজে ব্যবহার করা হয়। কোনো মতেই যেন তা মিডিয়াতে প্রকাশ না করা হয়—প্রাথমিকভাবে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। কেবল সন্দেহের বশে কারও বিষয়ে তথ্য প্রকাশ করা শোভন নয়।
এখন আমরা একটু ঘেটে দেখব কেন পারিবারিক সংকট উন্মোচনের কথা বলছি। দাম্পত্য সম্পর্কে দীর্ঘদিন টানাপোড়েন চলতে থাকলে, বিশেষ করে মেয়েরা বিষণ্নতা রোগে আক্রান্ত হতে পারে। গুরুতর বিষণ্নতা রোগের এটা আমাদের সংস্কৃতি এবং জীবন ধারায় একটি বড় কারণ। এ রোগে সার্বক্ষণিক আবেগীয় অবস্থা বা মুভ আক্রান্ত হয়। আবেগ হচ্ছে মনের স্বাস্থ্যের একটা গুরুত্বপূর্ণ অনুষদ। এ অবস্থায় হালকা থেকে মাঝারি কিংবা গুরুতর বিষাদ হানা দিতে পারে মনে। চরমতম বিষাদের এক পর্যায়ে আত্মহননের চিন্তার উদয়ও হতে পারে। চিন্তা থেকে পরিকল্পনা কিংবা শেষ পর্যায়ে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য ঝাঁপ দিতে পারে বা অ্যাটেম্ট গ্রহণ করতে পারে যে কেউ। এ অবস্থায় মনে কেবল ঘুরপাক থেকে থাকে নেতিবাচক চিন্তা। স্বয়ংক্রিয়ভাবে মনে জেগে উঠতে পারে অন্ধকার ভবিষ্যৎ, অতীতকে মনে হতে পারে ব্যর্থতা, পংকিলতা কিংবা পাপে ভরা। ছোটখাটো বিষয়কে ব্রেন তখন ভুল বিশ্লেষণ করে, আরো নেতিবাচক জালে জড়াতে থাকে ভিকটিম। বর্তমানের সব কিছু থেকে তার আনন্দ হারিয়ে যায়, যেতে পারে। মনস্তত্ত্বের ভাষায় এটিকে বলে ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার। তবে একক কোনো কারণ দ্বারা ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডারকে মূল্যায়ন করা যাবে না। জেনেটিক্যাল, হরমোনাল অন্যান্য বায়োলজিক্যাল সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক কারণের মিথস্ক্রিয়ায় ঘটতে পারে এমন মনোরোগ এসব ক্ষেত্রে ডিপ্রেসনের কারণ বের করার জন্য মনোচিকিৎসকদেরকে নানা বিষয়ে খোঁজখবর নিতে হয়, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয়। মানসিক স্বাস্থ্য বা মেন্টাল টেস্ট ইভালুয়েশন করে নিশ্চিত হতে হয়। পত্রিকার খবর থেকে জানতে পারছি, র‌্যাব জানিয়েছে স্বীকারোক্তির সময় সম্পূর্ণ সুস্থ ও স্বাভাবিক ছিলেন হত্যাকারী মা। র‌্যাবের উদ্ধৃতি দিয়ে এ কথা প্রকাশ করা গ্রহণযোগ্য নয়। বাইরে থেকে সুস্থ মনে হলে অনেকের চিন্তন  ও আবেগে লুকানো নেতিবাচক জাল বিন্যস্ত থাকতে পারে। তা মনস্তাত্ত্বিকভাবে মূল্যায়ন করা দরকার হতে পারে। সাধারণ গভীর বিষাদে আক্রান্ত রোগীরা সরাসরি চোখের দিকে তাকাতে পারে না, তাদের দৃষ্টিনিবদ্ধ থাকে মাটির দিকে। চোখের পাতার নড়াচড়া কমে যায়, মুভমেন্ট কমে যায়। উপরের দিকে ঠেঁসে কুঁজো করে রাখে কাঁধ। দুই ভুরুর ভাঁজে লম্বালম্বি ভাঁজ পড়ে, ত্বক ম্লান থাকে। গালের দুপ্রান্ত নিচের দিকে অটোমেটিক্যালি নেমে আসে। তবে সবার এক্সপ্রেশনে সব উপসর্গ থাকবেই, বলা যায় না। মায়ের অবিশ্বাস্য স্বীকারোক্তি শিরোনামে ইত্তেফাকের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত ছবিটি (৪ মার্চ ২০১৬) দেখে বলা যায় তার চোখ শার্প। দুই ভুরুর মাঝে লম্বালম্বি ভাঁজ রয়েছে। কাঁধ একটু উঁচুতে ঠেঁসে আছে। এ দৃশ্যমান অবয়ব নিরীক্ষা করে পূর্ণাঙ্গ ধারণা না পাওয়া গেলেও বলা যায় বিচারাধীন প্রক্রিয়ায় তার পক্ষের উকিল তাকে হয়ত মানসিক রোগী বলে চালাতে চেষ্টা করবেন। মাননীয় জজ হয়ত এখন তাকে মানসিক স্বাস্থ্যগত অবস্থা নিরূপণের জন্য মনোরোগবিদ্যা বিভাগে প্রেরণ করবেন। এটিই যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া।
পত্রিকার পাতা থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বিশ্লেষণ করা যেতে পারে প্রাসঙ্গিক কারণে। সন্তানদের হত্যার আগে বনশ্রীর বাসায় গলায় ফাঁস দিয়ে দু’বার আত্মহত্যার চেষ্টা চালান জেসমিন। র‌্যাব-৩-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল খন্দকার গোলাম সারোয়ারের উদ্ধৃতি দিয়ে একটি পত্রিকায় (৪ মার্চ ২০১৬) খবর ছাপিয়েছে সন্তান দুটি হত্যার আগে এক মাসের মধ্যে দুবার আত্মহত্যার চেষ্টা চালিয়েছেন জেসমিন। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, কারও প্রতি ক্ষোভে নয়, সব সময় সন্তানদের নিয়ে তিনি টেনশনে থাকতেন।
তথ্যটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আত্মহত্যার আগের ইতিহাস মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা নির্ণয়ে বিশেষ করে বিষণ্নতারোগ পরিমাপের জন্য অপরিহার্য একটি বিষয়। সন্তানদের নিয়ে দীর্ঘ মানসিক যাতনা কিংবা চাপও তার বিষণ্নতার একটি কারণ হতে পারে। উড়িয়ে দেয়া যায় না তথ্যটি। দু’বার আত্মহননের চেষ্টার তথ্য অবশ্যই মানসিক অসুস্থতারই তথ্য। তাছাড়া জেসমিনের মা জোলেখা বেগম (৬০) মানসিক রোগী বলে জানিয়েছেন জেসমিনের চাচাতো ভাই সিদ্দিকুর রহমান। সুতরাং বংশানুক্রমিকভাবে  জেসমিনের মধ্যেও মানসিক রোগ আসতে পারে। উড়িয়ে দেয়া যায় না। আরও একটি কারণ বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। জেসমিন শিক্ষকতা করতেন। চাকরিটা কি তিনি ছেড়ে দিয়েছিলেন, নাকি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। ছাড়তে বাধ্য হলে এটা একটা ‘লস ইভেন্ট’ ইচ্ছাকৃতভাবে ছেড়ে পরে যদি ভাবেন ভুল করেছি, সেটিও মর্মযাতনা তৈরি করতে পারে। আগে কর্মক্ষম থাকা একজন নারী ঘরে বসে থাকলে অতিমাত্রায় শিশুদের ওপর ‘পজেসিভ’ হয়ে যেতে পারেন। শিশুদের নিয়ে অতি উচ্চাশা বা অতি চাহিদার বীজ রোপিত হয়ে যেতে পারে তার মননে। চাহিদার অপূর্ণতার ফাঁক দিয়ে হতাশা বাসা বাঁধতে পারে মনে। দীর্ঘদিনের হতাশা থেকেও মনে বিষাদ রোগ হানা দিতে পারে। এসব বিষয় খতিয়ে দেখার কথা এজন্যই বলব যে, সন্তানদের হত্যা করে নিজেকে খুন করার (আত্মহত্যার) কোনো পরিকল্পনা জেসমিনের ছিল কিনা তাও খতিয়ে দেখতে হবে। বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটে গেছে। দু’সন্তানকে মোটিভেট করে মা সন্তানদের নিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। দীর্ঘ পারিবারিক সংকট দিনে দিনে চাপে ঠেলে দিয়েছিল তাদের। এই নির্মমতা, নৃশংসতা স্বাভাবিক কোনো মা করতে পারেন না। মাতৃক্রোড় সন্তানের সবচেয়ে বেশি নিরাপদ আশ্রয়। সেই ক্রোড়টি মহান থাকুক। এমনতরো কঠিন উদাহরণের কারণে কালিমাযুক্ত হোক, চাই না আমরা। সন্তানরা যেন ভীত না হয়, দৃশ্যগুলো দেখে মাকে যেন কোনো সন্তান ভয় না পায়। বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে সবাইকে।
করণীয় কী?
নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটছে। পুঁজিবাদী গ্লোবাল সংস্কৃতির আগ্রাসনে ভেসে যাচ্ছে আমাদের পারিবারিক মূল্যবোধ। নীতি নৈতিকতার চর্চা বৃদ্ধি ও মাদকমুক্ত সমাজগঠনের মাধ্যমে আমরা ফিরে পেতে পারি আদর্শ পরিবার। অবিশ্বস্ত সম্পর্কের ছোবলে বিধ্বস্ত হয়ে যাচ্ছে ঘর। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে ফাটল তৈরি হচ্ছে। এসব ফাটলে বড় হতে থাকা শিশুরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মানসিকভাবে। সুন্দর পরিবার নির্মাণ করে জাতিকে আমরা উপহার দিতে পারি সুন্দর দেশ।
লেখক : হেড অব সাইকোথেরাপি, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও কথাসাহিত্যিক, drmohitkamal@yahoo.com

সুত্রঃ ইত্তেফাক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!