খুকু মনির কাহিনী
অনলাইন ডেস্ক । কাগজটোয়েন্টিফোরবিডিডটকম
শারমীন রিমা! হাতে বিয়ের মেহেদি ঝাপসা হওয়ার আগেই যাকে জীবন দিতে হয়েছিল। লম্পট স্বামী মুনির হোসেনের পরকীয়ার বলি হতে হয়েছিল এই রিমাকে। ২৮ বছর আগের এ ঘটনাটি এখনো জীবন্ত মানুষের মণিকোঠায়। ঘটনাটি মনে পড়লেই এখনো মানুষকে কষ্ট দেয়। রিমার জন্য ঝাপসা হয়ে ওঠে দুই চোখ। পাশাপাশি রিমার সেই লম্পট স্বামী মুনির হোসেনের ফাঁসি হলেও তার প্রতি মানুষের ঘৃণার যেন শেষ নেই। তদন্তের সঙ্গে জড়িত পুলিশের সংশ্লিষ্ট তৎকালীন কর্মকর্তা ও বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যে সেই ২৮ বছর আগের আলোচিত এ ঘটনাটি তুলে ধরা হচ্ছে।
শহীদ সাংবাদিক নিজাম উদ্দিন আহমেদের ছোট মেয়ে শারমীন রিমা। ১৯৮৮ সালের ১১ ডিসেম্বর রিমার বিয়ে হয় মুনিরের সঙ্গে। বিয়ের মাত্র চার মাসের মাথায় স্বামীর সঙ্গে হানিমুনে গিয়ে নৃশংস খুনের শিকার হন রিমা। প্রথম দিকে এই হত্যাকাণ্ড ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। মুনির পাগলের অভিনয় করে। কিন্তু সে সময় সংবাদপত্রের বলিষ্ঠ ভূমিকার কারণে তা আর সম্ভব হয়নি। মুনিরের বিচার না হওয়া পর্যন্ত এ ঘটনার সংবাদ দেশের সবগুলো পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় স্থান পায়। ঘর থেকে শুরু করে চায়ের দোকান পর্যন্ত আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল এটি। পরকীয়ার আইডল হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে খুকু আর মুনির। তাদের নিয়ে সে সময় অনেক ছোট ছোট বই ও অনেক গান রচিত হয়েছিল। অনেক মা-বাবা তখন খুনি মুনির ও তার প্রেমিকা খুকুর প্রতি ঘৃণায় তাদের সন্তানের নাম মুনির/খুকু পরিবর্তন করে অন্য নাম রেখেছিলেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছিল এই রিমা হত্যা মামলাটি।
সাংবাদিক নিজাম উদ্দিন আহমেদের পরিবারে একাত্তর থেকে শোকগাথা শুরু। প্রথমে পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে শহীদ হন পরিবার-কর্তা নিজাম উদ্দিন। এরপর স্বামীর পরকীয়ার বলি হন শারমীন রিমা। ১৯৮৯ সালের ৮ এপ্রিল শুক্রবার ভোর রাতে। বিয়ের বছর না ঘুরতেই খুন হন তিনি। বিয়ে হয়েছিল সম্ভ্রান্ত ডাক্তার পরিবারে। রিমা ছিল পরিবারের ছোট মেয়ে। অনেক আদর-ভালোবাসায় বড় হয়েছিলেন। ডাক্তার পরিবারে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল তার সুখ হবে ভেবে। কিন্তু রিমা সুখী হতে পারেননি। স্বামীই তাকে দেয়নি সুখী হতে।
১৯৮৮ সালের ১১ ডিসেম্বর রিমার বিয়ে হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজের সাবেক প্রিন্সিপাল এবং ডাক্তারদের সংগঠন বিএমএর সাবেক সভাপতি ডা. আবুল কাশেম এবং ডা. মেহেরুন্নেছার ছেলে মুনির হোসেন সুরুজের সঙ্গে। রিমা তখন ছিলেন ধানমন্ডির কিন্ডার গার্টেনের শিক্ষিকা। ডাক্তার দম্পতি পুত্র মুনির সৎ চরিত্রবান জেনে রিমাকে তার বিধবা মা মুনিরের সঙ্গে বিয়ে দেন। যাতে তার মেয়ে দাম্পত্য জীবনে সুখী হয়। কিন্তু এটা ছিল তাদের ভুল ধারণা।
মুনির ছোটবেলা থেকেই ছিল চরিত্রহীন, লম্পট ধরনের। সচ্ছল পরিবারের সন্তান হিসেবে টাকা-পয়সার কোনো অভাব না থাকায় খুব ছোটবেলা থেকেই সে হয়ে ওঠে বেপরোয়া, মদ্যপ। নারীসঙ্গ তার জীবনে ছোটবেলা থেকেই নিত্যসঙ্গী ছিল। অবস্থার পরিবর্তন আর ছেলেকে কুপথ থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য তার বিয়ের ব্যবস্থা করেন সুন্দরী ভদ্র তরুণী রিমার সঙ্গে। কিন্তু বিয়ের কিছুদিন যেতে না যেতেই মুনির তার পুরনো কার্যকলাপ শুরু করেন, গভীর রাতে মদ্যপ অবস্থায় বাসায় ফেরেন, কথায় কথায় রিমার ওপর চালায় অকথ্য শারীরিক নির্যাতন। এরই মধ্যে মুনিরের পরিচয় হয় মধ্যবয়সী মহিলা হোসনে আরা খুকুর সঙ্গে।
পঞ্চাশের কাছাকাছি খুকু ছিলেন চট্টগ্রাম পোর্টের ইন্সপেক্টর আবু জাফরের স্ত্রী। আবু জাফর প্যারালাইজড হয়ে ঢাকায় এসে ভর্তি হন একটি ক্লিনিকে। অসুস্থ স্বামীকে চিকিৎসা করাতে এসে ক্লিনিকের মালিকের ছেলে মুনিরের সঙ্গে পরিচয়, টুকটাক আলাপ, চিকিৎসার ব্যাপারে সহায়-সহায়তা ইত্যাকার আলাপের এক পর্যায়ে খুকুর সঙ্গে মুনিরের ভাব জমে যায়। উভয়ে উভয়কে কামনা করেন। শুরু হয় স্বামীকে হাসপাতালে রেখে খুকুর পরকীয়া। এক পর্যায়ে ওরা ঢাকা ছেড়ে চট্টগ্রাম ও বিভিন্ন জেলায় ঘুরে বেড়ায়। খুকুর সঙ্গে গড়ে ওঠে দৈহিক সম্পর্ক। স্বামীর খোঁজ-খবর জানতে চাইলে নির্যাতনের শিকার হন রিমা। রিমার ওপর মধ্যযুগীয় নির্যাতন করতে থাকেন মুনির। মুনির খুকুর সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে মিলিত হতেন। আরও কাছে পেতে লালমাটিয়া এলাকায় বাসা ভাড়া পর্যন্ত করেন খুকুর জন্য। সেখানেই তারা মিলিত হতেন নিয়মিত। খুকু ছাড়াও মুনিরের সঙ্গে বয়স্ক বিভিন্ন পতিতার নিয়মিত সম্পর্ক ছিল। সব জেনেশুনে মুখ বুজে সহ্য করতে থাকেন রিমা।
ফ্লাসব্যাক ৮ এপ্রিল, ১৯৮৯ : কক্সবাজার হানিমুনে যান মুনির আর রিমা। তারা দুজন বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ান। আনন্দ-ফুর্তিতে কেটে যায়। একদিন পর রিমা জানতে চান, আমরা ঢাকায় ফিরছি কখন। মুনির বলে শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। এখন গাড়ি চালাতে গিয়ে যদি কিছু হয় তাই রাতে যাব। আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিতে মুনির বলেছেন, ‘সন্ধ্যা ৭টা ৩০ মিনিটে চিটাগাং থেকে ঢাকার পথে রওনা হই। আসার পথে আমি রিমাকে খুন করার কথা চিন্তা করি। আমি রিমাকে গাড়ি থেকে ফেলে দেওয়ার চান্স খুঁজছিলাম। তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। পরে আমি চান্স পাই। মুক্তি সরণির কাছে বিশ্বরোডে মিজমিজি গ্রামে যাওয়ার কাঁচা রাস্তার মোড়ে (মৌচাক সরণি) আমার গাড়ি থামিয়ে ফেলি। তখন রাত সোয়া ২টা বাজে। আমি গাড়ির স্টাট বন্ধ করি। গাড়িতে বোতল দিয়ে রিমার ঘাড়ে ও মাথায় আঘাত করি। তখন সে একটু অচেতন অবস্থায় ছিল। তখন আমি তাকে চুলে ধরে গাড়ির ড্রাইভিং সিটের কাছ থেকে বের করি। আমি তাকে কয়েকবার মাটিতে ফেলে বোতল দিয়ে আঘাত করি। তারপর আমার গাড়িতে থাকা ছুরি দিয়ে তাকে পেটে আঘাত করি। ছুরি দিয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত করি। এর পাশে একটা খাল ছিল। আমি তাকে ওই খালে ফেলে দেই। এরপর আমি পাগলের অভিনয় করি।
আদালত ১৯৯০ সালের ২১ মে খুকু-মুনির দুজনেরই ফাঁসির আদেশ দেয়। পরে উচ্চ আদালতে আপিল করলে খুকু প্রমাণের অভাবে বেকসুর খালাস পান। নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষণে বলা হয়ে থাকে, মিডিয়ার অতিরিক্ত প্রচার আদালতকে খুকুর ফাঁসির আদেশ দিতে প্রভাবিত করেছিল। খুকু আসলেই কতটা জানত বা কতটা অবদান রেখেছিল, সেটা শেষ পর্যন্ত একটা রহস্যই থেকে যায়।
একটা ছোট্ট ঘটনা, আদালতের রায় ঘোষণার পরদিন পত্রিকায় একটা ছবি ছাপা হয়েছিল, খুকুর ছেলেরা রায় শুনে আদালতে চিৎকার করে কেঁদেছে। ১৯৯৩ সালের জুলাই মাসের কোনো এক সুন্দর ভোরে মুনিরের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন
১৯৭৮ সালে সালেহা হত্যাকান্ড ও ডাঃ ইকবালের ফাসীর ঘটনার উপর একটা প্রতিবেদন চাই