গোপালপুরে শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে ১৪ শিক্ষকের এক পরিবার
মো. সেলিম হোসেন, গোপালপুর (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি । কাগজটোয়েন্টিফোরবিডিডটকম
একটা সময় শিক্ষকতা ছিল স্বেচ্ছাব্রত পেশা। পন্ডিতজনরা জ্ঞানের আলো ছড়ানোর জন্য স্বেচ্ছায় এ মহান পেশায় নিজেদের নিয়োজিত রাখতেন। অর্থমূল্য তখন বিবেচ্য বিষয় ছিলনা। এ জন্য সমাজের সর্বস্তরে শিক্ষকদের সন্মান ছিল আকাশচুম্বি।
কালের বিবর্তনে শিক্ষকতা পেশা, আর দশটির মতো অবনমিত হলেও, সমাজের কোন কোন স্তরে শিক্ষকদের এখনো মানুষ গড়ার কারিগর বলা হয়। কারণ সন্তানকে মানুষ করার দায়িত্ব শেষ পর্যন্ত শিক্ষকের হাতেই সোপর্দ করতে হয়। সব মিলিয়ে এ পেশা এখনো সামাজিক সম্মান কিছুটা ধরে রেখেছে।
জীবনের অন্বেষণে মানুষ নানা পেশায় নিয়োজিত হয়। পেশা বাছাইয়ে বৈচিত্র্যকেও প্রাধান্য দেয়া হয়। কিন্তু যৌথ পরিবারের সবাই একই পেশায়, বিশেষ করে শিক্ষকতার মতো কম আয়রোজগারের পেশায়, নিয়োজিত থাকার উদাহরণ খুব একটা চোখে পড়েনা। টাঙ্গাইলের গোপালপুরে এমন একটি ব্যতিক্রম পরিবারের সন্ধান পাওয়া গেছে। যে পরিবারে ১২ সদস্য এ মহান পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন।
গোপালপুর উপজেলা সদর থেকে তেরো কিলো দুরে হাদিরা গ্রাম। এ গ্রামের মরহুম আফতাব হোসেন কলেজের পড়ালেখা শেষ করে ষাটের দশকে শিক্ষকতায় আসেন। হাদিরা মাদ্রাসায় তিনি দীর্ঘ দিন শিক্ষকতা করেছেন। মরহুম আফতাব হোসেনের চার পুত্র ও তিন কন্যার সবাই শিক্ষক। বড়পুত্র গোলাম ফারুক নগদাশিমলা জামিরুন্নেছা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিনি বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি গোপালপুর উপজেলা শাখার সভাপতি। গোলাম ফারুকের সহধর্মিনী সুলতানা রুফিয়া পলশিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। রুফিয়া খাতুনের বাবামা দু’জনই আবার শিক্ষক ছিলেন।
গোলাম ফারুকের কনিষ্ঠ ভ্রাতা আব্দুল কাদের সিদ্দিকী পুস্প প্রি-ক্যাডেট ইন্সস্টিটিউটের অধ্যক্ষ। আর সহধর্মিনী সোহেলী আখতার হাদিরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক। তৃতীয় ভ্রাতা আবদুল্লাহ আল মামুন কলেজ শিক্ষক। স্ত্রী রওশন আরা বেবীও আছেন একই পেশায়। চতুর্থ ভ্রাতা মেহেদী হাসান চর চতিলা আলীম মাদ্রাসার শিক্ষক। তার স্ত্রী উর্মি আখতারও একজন শিক্ষক। গোলাম ফারুকের তিন বোনের সবাই শিক্ষক। বড়জন আমিনা খাতুন হাদিরা হাতেম আলী উচ্চবিদ্যালয়ে কর্মরত। দ্বিতীয়জন মমতাজ জাহান উদয়পুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। কনিষ্ঠা আয়েশা সিদ্দিকা হাতেম আলী উচ্চবিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন।
গোলাম ফারুক জানান, তার মরহুম পিতা আফতাব হোসেন ছিলেন গ্রামের প্রথম গ্রাজুয়েট। লেখাপড়া শেষে গ্রামে ফিরে এলাকার মানুষের শিক্ষাদীক্ষার বেহাল অবস্থা দেখে তিনি মনোঃকষ্টে ভুগতে থাকেন। এমতাবস্থায় সরকারি চাকরির দিকে না তাকিয়ে শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে গ্রামেই থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। স্থানীয় মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করা শুরু করেন। তখন আশপাশে কোন স্কুল ছিলনা। পরবর্তীতে বহু চেষ্টায় তিনি হাদিরা গ্রামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। হাদিরা হাতেম আলী উচ্চবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও তিনি ভূমিকা রাখেন। অবসর জীবনে তার পিতা বসে থাকেন নি। গ্রামের প্রতিটি ঘরে ঘরে তিনি নিয়মিত যেতেন। কার বাচ্চা স্কুলে যাচ্ছেনা, অথবা অসুস্থ হয়ে পড়ছেন বা অর্থাভাবে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, সব খবর রাখতেন এবং সাধ্যমত সহযোগিতা করতেন। তাই বাবার জীবনে কখনো অবসর ছিলনা জানান গোলাম ফারুক।
শিক্ষকতা পেশা নিয়ে বলেন, বাবার উৎসাহেই পড়ালেখা শেষে এ পেশায় আসেন। তার ভাষায়, ‘বাবা বলতেন, শিক্ষকতা করে মানুষের জন্য যা করা যায়, অন্য পেশায় থেকে সেটা করার সুযোগ নেই। রিজিক ছাড়াও পূণ্য পাবার পথ খোলা থাকে শিক্ষকতা পেশায়’। বেতনভাতা বা অন্যান্য সুযোগ সুবিধা কম থাকলেও শিক্ষকতা পেশায় একটি আত্মতৃপ্তি রয়েছে। সমাজের জন্য কিছু করার আনন্দ এখানে সহজেই মিলে।
গোলাম ফারুকের মা নূরজাহান বেগমের বয়স ৭০ বছর। তিনি জানান, তার স্বামী শিক্ষকতা পেশা বেছে নেয়ায় সংসারে অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা কখনোই ছিলনা। কিন্তু সুখ ও শান্তি ছিল। সৎ রোজগারে সব সন্তানকে উচ্চশিক্ষিত করেছেন। আদর্শ সন্তান হিসাবে তাদেরকে গড়ে তুলেছেন। এ সুশিক্ষা তাদেরকে যৌথ পরিবারে আবদ্ধ করে রেখেছে। পুত্র, কন্যা, নাতিনাতনীসহ সুখি পরিবারের আবহ নিয়ে সবাই একসাথে বসবাস করছেন। সংসার জীবনটা এখানে বাস্তবেই শান্তির নীড়।