‘গ্রামীণ ব্যাংক’ কী করবেন?

সারা দেশে গ্রামীণ ব্যাংকের শাখা ২৫৬৮টি। ঋণগ্রহীতা সদস্য সংখ্যা ৮৯ লাখ ১৫ হাজার। বিশাল এই ব্যাংকটি পরিচালনার জন্য একজন চেয়ারম্যানসহ ১২ জন পরিচালক, এক জন ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকার কথা। এমডি হিসেবে ড. ইউনূস বিদায় নিয়েছেন ২০১১ সালে। এই ঘটনাটিকে কেন্দ্র করেই গ্রামীণ ব্যাংকে জটিলতার শুরু। সেই জানা কাহিনীর দিকে এই লেখায় যাচ্ছি না। ২০১১ থেকে ২০১৭, এখনও পর্যন্ত এমডি নিয়োগ দেওয়া হয়নি। ৩ জন পরিচালক এবং ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক দিয়ে কাজ চলছে।

বাকি ৯ জন্য পরিচালক নেই। ২০১৫ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ৯ জন পরিচালকের মেয়াদ শেষ হয়েছে। চেয়ারম্যানসহ ৩ জন পরিচালক নিয়োগ দেন সরকার। ৯ জন পরিচালক নির্বাচন করা হতো ঋণগ্রহীতাদের ভেতর থেকে। ৩ বছরের জন্যে তারা নির্বাচিত হতেন। ২০১৪ সালে গ্রামীণ ব্যাংক (পরিচালক নির্বাচন) বিধিমালা জারি করে সরকার।

এই বিধিমালা অনুযায়ী ৯ জন পরিচালক নির্বাচন করা হবে, সব ঋণগ্রহীতার সরাসরি ভোটে। অর্থাৎ ৮৯ লাখ ১৫ হাজার ঋণগ্রহীতা সদস্য সরাসরি ভোট দিয়ে ৯ জন পরিচালক নির্বাচন করবেন। সাধারণভাবে ‘সরাসরি ভোট’ বেশ ভালোই শোনায়। একটু ভাবলে, ভয়াবহ দিকটি চোখের সামনে ভেসে ওঠার কথা। দেশের সরকারি ব্যাংকগুলোর সিবিএ নির্বাচনের চিত্রটি নিয়মিতই চোখের সামনে দেখছেন। সেখনে রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন, দাপট, অরাজকতার কথা কারোরই অজানা নয়।

সারাদেশের ৮৯ লাখ ১৫ হাজার মানুষ ভোটার, সেখানে রাজনীতির চিত্রটা কেমন হবে! আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয়পার্টি, জামায়াত সমর্থন, পক্ষ-বিপক্ষ… কল্পনা করেন সেই নির্বাচনের চিত্র। কেমন হবে গ্রামীণ ব্যাংকের অবস্থা বা পরিণতি?

২০১৪ সালের বিধিমালায় বলা হয়েছিল ‘এই বিধিমালা প্রবর্তনের ছয় মাসের মধ্যে পরিচালকগণের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে এবং নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যমান নির্বাচিত পরিচালকগণের পদ শূন্য হইয়াছে বলিয়া গণ্য হইবে।’

পরিচালকের পদ শূন্য হলেও সরকার নির্বাচন করতে পারেনি। ফলে বিধিমালায় সংশোধনী এনেছে। ৯ জন পরিচালক এখনও পরিচালক দাবি করে আদালতে রিট করেছেন। যা বিচারাধীন। দেশের সবচেয়ে বড় এই ব্যাংকটি সিদ্ধান্তহীনতায় চলছে। পূর্ণাঙ্গ পরিচালনা পরিষদ ছাড়া চলছে ব্যাংকটি। কবে পরিচালনা পরিষদ গঠিত হবে তা নিশ্চিত নয়। আবার সরাসরি ভোটের পদ্ধতিতে গেলে ব্যাংকটির নজিরবিহীন নৈরাজ্যকর অবস্থার মধ্যে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

বিষয়টি উপলব্ধি করেছেন ব্যাংকটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক খন্দকার মোজাম্মেল হক। তিনি সরকারের পছন্দের লোক। গত ১৬ জুলাই অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে তিনি একটি চিঠি লিখেছেন। চিঠিতে বলেছেন, ‘… একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘ সময় পূর্ণাঙ্গ বোর্ড না থাকলে গুরুত্বপূর্ণ অনেক কাজ আটকে থাকে এবং সার্বিক কার্যক্রম সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনায় ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়।’

সরাসরি ভোটে পরিচালক নির্বাচনের ব্যবস্থা করলে ব্যাংকটিতে রাজনীতি ঢুকে যেতে পারে, সেই আশঙ্কার কথাও তিনি লিখেছেন চিঠিতে। ড. ইউনূসের সময়ে যেভাবে পরিচালক নির্বাচন করা হতো, সেভাবে পরিচালক নিয়োগ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি।

০২.
২০১১ সালে ড. ইউনূস চলে যাওয়াকালীন ও পরবর্তী সঙ্কট এবং পূর্ণাঙ্গ বোর্ড ছাড়া নানা জটিলতায় পড়ে গ্রামীণ ব্যাংক। সরকারের মনোনীত ৩ জন পরিচালক ও ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ব্যাংকটি ঠিকমতো পরিচালনা করতে পারছিলেন না।

বাংলাদেশ ব্যাংক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেই প্রতিবেদনে আশঙ্কাজনক চিত্র উঠে আসে। প্রতিবেদনে দেখানো হয় ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর ব্যাংকের অবস্থা কেমন ছিল, ২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর কেমন অবস্থায় দাঁড়িয়েছে। এই প্রতিবেদনেও পূর্ণাঙ্গ বোর্ড না থাকা এবং সুশাসনের ঘাটতির কথা উল্লেখ করা হয়েছিল।

প্রতিবেদনে দেখানো হয়, ২০১৪ সালে গ্রামীণ ব্যাংক মুনাফা করেছিল ৪৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা। ২০১৫ সালে মুনাফা করেছিল ২ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। এক বছরে মুনাফা কমেছিল ৯৪.৪ শতাংশ।

২০১২ সালে মুনাফা ১৪৫ কোটি, ২০১৩ সালে মুনাফা করেছিল ১৩৩ কোটি ২৯ লাখ টাকা। ২০১৬ সালে এসে গ্রামীণ ব্যাংক আবার মুনাফা করেছে প্রায় ১০০ কোটি টাকা। এই সময় গ্রামীণ ব্যাংকের নীতিতে একটা বড় পরিবর্তন আনা হয়েছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। গ্রামীণ ব্যাংকের মূলনীতি ‘ব্যাংক ফর দ্য পোর’। সদস্য গরিব মানুষকে ঋণ দেওয়াই গ্রামীণ ব্যাংকের মূল উদ্দেশ্য।

গ্রামীণ ব্যাংকের মোট আমানত ১৮ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১০ হাজার ৪৪১ কোটি টাকা বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা রাখা হয়েছে। যা মোট আমানতের ৫৬ শতাংশ। যেখান থেকে লাভ পাওয়া যাচ্ছে। গরিবের মাঝে ঋণ বিতরণ সীমিত করে, অন্য ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অর্থ জমা রাখা গ্রামীণ ব্যাংকের মূলনীতি নয়। অর্থ জমা রাখায় লাভের পরিমান বাড়লেও নীতি ঠিক থাকছে না। স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট হারাচ্ছে গ্রামীণ ব্যাংক।

০৩.
ড. ইউনূস ২০১১ সাল থেকে গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে না থাকলেও তার প্রভাব রয়ে গেছে। সরকারের সঙ্গে ড. ইউনূসের টানাপোড়েন কমছে না, বাড়ছে। সরকার ব্যাংক পরিচালনা করতে না পেরে দায় চাপাচ্ছেন ড. ইউনূসের উপর। অর্থমন্ত্রী বারবার অভিযোগ করেছেন, ড. ইউনূসের কারণেই গ্রামীণ ব্যাংক ঠিকমতো পরিচালনা করা যাচ্ছে না।

সরকারের পক্ষ থেকে কিছুদিন পরপর ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে গুরুতর কিছু অভিযোগ বক্তৃতায় বলা হয়। ইউনূস সেন্টারের পক্ষ থেকে তার সুনির্দিষ্ট করে জবাব দেওয়া হয়। সম্পূর্ণ অসত্য বলা হয়। সেই জবাবের বিষয়ে কোনো বক্তব্য সরকারের পক্ষ থেকে পাওয়া না গেলেও, কিছুদিন পর পুরনো অভিযোগগুলোই আবার আনা হয়। ইউনূস সেন্টার আবার জবাব দেয়। এভাবেই চলছে।

সম্প্রতি ওয়াশিংটন ভিত্তিক ‘ডেইলি কলার’ নামক একটি অনলাইন পত্রিকা ড. ইউনূসকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। পত্রিকাটি লিখেছে, কংগ্রেসের অনুরোধে বাংলাদেশ সরকার দুটি ডকুমেন্ট দিয়েছে আমেরিকাকে। এই ডকুমেন্ট দুটির ভিত্তিতে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ‘ডেইলি কলার’।

‘ডেইলি কলার’ নামে ওয়াশিংটন ডি.সি. ভিত্তিক একটি আমেরিকান সংবাদ এবং মতামত ওয়েবসাইট প্রকাশিত হয়, অনলাইনে খোঁজ করে তা জানলাম।

দ্য ডেইলি কলার সংবাদ এবং মতামত ওয়েবসাইট প্রতিষ্ঠিত হয় ২০১০ সালে মার্কিন নাগরিক টাকার কার্লসন, একজন রক্ষণশীল রিপাব্লিকান এবং নেইল প্যাটেল’র উদ্যোগে। নেইল প্যাটেল ছিলেন রিপাব্লিকান ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনীর প্রধান পলিসি অ্যাডভাইজার, চেনীর উপদেষ্টা হিসেবে প্যাটেল’র দায়িত্বে ছিল হোয়াইট হাউসের অর্থনৈতিক ও ডোমেস্টিক নীতিমালায় ভাইস প্রেসিডেন্টের প্রতিনিধিত্ব করা, তিনি ভাইস প্রেসিডেন্টের পক্ষে ব্যবসায়ি সম্প্রদায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং ভাইস প্রেসিডেন্টের নীতিগত কাজ পরিচালনা করেন।

রিপাবলিকান সংবাদ এবং মতামত ওয়েবসাইট ‘দ্য ডেইলি কলার’ যে ডেমোক্র্যাটস দলের প্রশংসা করবে এটি কেউ আশা করে না, বরং রিপাব্লিকান পার্টির প্রশংসা করবে এটাই স্বাভাবিক। ডেইলি কলার হিলারি ক্লিনটনকে নিয়ে বহু প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তার সবই সমালোচনামূলক।

‘ডেইলি কলার’র গ্লোবাল রাঙ্কিং ৩২৬৬, ইউএস রাঙ্কিং ৭১০। ‘ডেইলি কলার’ মূলত রিপাবলিকানদের মূখপত্র। ‘ডেইলি কলার’র প্রতিবেদনে হিলারি ক্লিনটন ড. ইউনূসের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারকে চাপ দিয়েছিলেন, বিশ্বব্যাংকের পদ্মাসেতুর ঋণ বাতিল, যা বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হয়েছে, সেই বিষয়গুলো উঠে এসেছে। ‘ডেইলি কলার’র কোনো অনুসন্ধান নয়, নতুন কোনো তথ্য নেই প্রতিবেদনে।

যে সব বিষয়ে অভিযোগ আনা হয়েছে, ইউনূস সেন্টার বেশ কয়েকবার সেসবের সুনির্দিষ্ট জবাব দিয়েছেন। যদিও ‘ডেইলি কলার’র প্রতিবেদনে ইউনূস সেন্টারের জবাব বিষয়ে কোনো কিছুর উল্লেখ নেই। যা বেশ রহস্যজনক। ‘ডেইলি কলার’র প্রতিবেদন বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলছি না। ইউনূস সেন্টারের প্রতিক্রিয়া দেখার অপেক্ষায় রইলাম। তবে এই প্রতিবেদনের দুটি বিষয় নিয়ে একটু বলতে চাই।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘ড. ইউনূসের সম্পদের নিট মূল্য এক কোটি ডলার। যুক্তরাষ্ট্রে তার অলাভজনক প্রতিষ্ঠান (গ্রামীণ আমেরিকা) থেকে তিনি ক্লিনটন ফাউন্ডেশনে ৩ লাখ মার্কিন ডলার অনুদান দিয়েছেন, ওয়েবসাইটেও এই তথ্য আছে।’(Yunus’ net worth is estimated at $10 million and his own U.S.-based nonprofits donated up to $300,000 to the Clinton Foundation, according to the foundation’s website.)

গ্রামীণ ব্যাংকের নীতি -আদর্শ, নাম ধারণ করে পৃথিবীর বহু দেশে প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে। ‘গ্রামীণ আমেরিকা’তেমন একটি প্রতিষ্ঠান। ড. ইউনূসের নীতি- আদর্শ দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়েই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলা হয়েছে। পরিচালনা বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবেও তাকে রাখা হয়েছে। তার সঙ্গে আলোচনা এবং সম্মতিতেই যেহেতু প্রতিষ্ঠানটি তৈরি হয়েছে, প্রতিষ্ঠাতাদের একজন তাকে বলা যায়। বলা যায় না যে প্রতিষ্ঠানটি ড. ইউনূসের। এটা আমেরিকান আইন অনুযায়ী আমেরিকানরাই পরিচালনা করেন।

আমেরিকান আইন অনুযায়ী অনুদান সংগ্রহ করেন, কোথাও কোথাও অনুদান দেন। তা বেআইনি কিছু নয়। তারা ‘গ্রামীণ’নাম নিয়েছে। ড. ইউনূস এই প্রতিষ্ঠানের মালিক নন। পৃথিবীর কোনো দেশের ‘গ্রামীণ’নাম নিয়ে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানের মালিক ড. ইউনূস নন। ‘গ্রামীণ আমেরিকা’অনুদান দিয়েছে, ড. ইউনূসের কোনো সম্পৃক্ততা এর সঙ্গে নেই। এই তথ্য আমেরিকার সব গণমাধ্যম জানে। ‘ডেইলি কলার’ কেন জানে না বা কেন জানার চেষ্টা না করে প্রতিবেদন প্রকাশ করল?

আর সৎ পথে সম্পদ অর্জন করা তো কোনো অপরাধ নয়। ড. ইউনূসের আয়ের বড় একটি অংশ আসে বিদেশ থেকে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বক্তৃতা এবং বইয়ের রয়েলিটি থেকে তিনি অর্থ আয় করেন। বৈধ ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশে আনেন। তা এক কোটি ডলার হলে, কারও কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। এক কোটি ডলারের সম্পদ এবং ৩ লাখ ডলার অনুদানের বিভ্রান্তিকর অসত্য তথ্য একসঙ্গে দেখানোর চেষ্টাটা সাংবাদিকতার নীতিমালা পরিপন্থী। যা ‘ডেইলি কলার’ করেছে।

ডেইলি কলার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, ‘… ড. ইউনূস ২০১০ সালে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকাকালীন বিভিন্ন আর্থিক অনিয়মের কারণে তদন্তের মুখোমুখি হন। এর মধ্যে একটি ড্যানিশ ডকুমেন্টরি জানায়, ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক ফান্ড থেকে ১০ কোটি মার্কিন ডলার সরিয়ে নেন তার নিজ নামে থাকা দুটি প্রতিষ্ঠানে।’(In 2010, as a Grameen Bank managing director, Yunus faced multiple charges of financial improprieties, including accusations in a Danish documentary that he diverted $100 million from Grameen and transferred them toward his own entities.)

একথা সত্যি যে, ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে মৌখিককভাবে অনেক অভিযোগ আনা হয়েছে। তদন্তও হয়েছে। এই পর্যন্ত ‘ডেইলি কলার’র প্রতিবেদন ঠিক আছে। কিন্তু তদন্তে যে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে কোনো দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া যায়নি, তা ‘ডেইলি কলার’ তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেনি। এটা কোন মানের, কেমন সাংবাদিকতা?

‘গ্রামীণ’ নামের অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছেন ড. ইউনূস। যার কোনোটিই তার ‘নিজের প্রতিষ্ঠান’ নয়। কোনোটির মালিক তিনি নন। এসব প্রতিষ্ঠানের কোনো কোনোটি বিশাল অর্থের মালিক। যেমন ‘গ্রামীণ টেলিকম। গ্রামীণ ফোনের ৩৮% শেয়ারের মালিক গ্রামীণ টেলিকম। গ্রামীণ ফোনের মুনাফার ৩৮% জমা হয় গ্রামীণ টেলিকমে। এর এক টাকার মালিকও ড. ইউনূস নন। এখান থেকে একটি টাকাও ড. ইউনূসের নেওয়ার সুযোগ নেই, নেনও নি। সরকারের তদন্তে এসব তথ্য প্রমাণ হয়েছে।

অথচ প্রতিষ্ঠানটি তৈরি করেছেন ড. ইউনূস! ‘গ্রামীণ ব্যাংকের অর্থ গ্রামীণ কল্যাণ ফাউন্ডেশনে নেওয়া হয়েছিল। তা নিয়ে ডোনার নোরাড আপত্তি করেছিল। বেশ কয়েক দফা চিঠি চালাচালি হয় নোরাড- গ্রামীণ ব্যাংকের মধ্যে। নোরাড সন্তুষ্ট না হওয়ায় পরে সেই অর্থ আবার গ্রামীণ ব্যাংকে ফিরিয়ে নিয়ে সমস্যার সমাধান করা হয়। আর ‘ডেইলি কলার’লিখেছে ‘নিজের প্রতিষ্ঠানে’সরিয়ে নিয়েছে।

এটা কেমন অনৈতিক সাংবাদিকতা? এর থেকে ‘ডেইলি কলার’র মান ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে নিশ্চয় একটি ধারণা পাওয়া যায়। ‘ডেইলি কলার’ বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনিসহ আরও দু’একজনের বক্তব্য নিয়েছে। সাবেক আমেরিকান রাষ্ট্রদূত মরিয়ার্টিসহ অনেকের বক্তব্য চেষ্টা করে নিতে পারেনি, তা উল্লেখ করেছে। প্রতিবেদনে যার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে, সেই ড. ইউনূস বা ইউনূস সেন্টারের কোনো বক্তব্য নেওয়া হয়নি। বক্তব্য নেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল কি না, প্রতিবেদনে তাও উল্লেখ করা হয়নি।

০৪.
‘ডেইলি কলার’র প্রতিবেদনকে কেন্দ্র করে হয়তো গ্রামীণ ব্যাংক, ড. ইউনূস আবার আলোচনায় আসবেন। যেমন আলোচনায় এসেছিলেন সামাজিক ব্যবস্থা সম্মেলন আয়োজন করতে গিয়ে। গ্রামীণ ব্যাংক কেউ পছন্দ করবেন কেউ করবেন না। ড. ইউনূসকে সবাই পছন্দ করবেন, সেই ধারণাও ঠিক না। তার কাজের সমালোচনা হতেই পারে। তা তো হওয়া দরকার তথ্যভিত্তিক।

ড. ইউনূসকে’ ‘সুদখোর’ বলে বিষোদগার করা হয়। বিষোদগার থেকে মনে হয়, গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্রঋণের সুদ থেকে আয়, তার পুরোটা ড. ইউনূস নিয়ে যান। বাস্তবে গ্রামীণ ব্যাংকের একটি শেয়ারের মালিকও ড. ইউনূস নন। আয়ের একটি টাকাও কোনোদিন তিনি নেননি, এমডি হিসেবে বেতন ও সুযোগ-সুবিধা ছাড়া।

ক্ষুদ্রঋণের বিরুদ্ধে সরকার ও সরকার সংশ্লিষ্টরা কত যে কথা বলেন। অথচ বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণ ব্যবসার ১২% সরকার নিজে নিয়ন্ত্রণ করে। ১৮% নিয়ন্ত্রণ করে গ্রামীণ ব্যাংক। বাকি ৭০% নিয়ন্ত্রণ করে ৬৯৭টি এনজিও। সবাই চলে সরকারি নিয়মনীতির মধ্যে। গ্রামীণ ব্যাংকের লাভের ২৫ শতাংশ এখন সরকার পান। সেই অর্থে সুদ খায় সরকার, ড. ইউনূস নয়।

কেউ জেনে বুঝে, অনেকে অজ্ঞতা থেকে বিষোদগার করতে গিয়ে মূল ক্ষতিটা করা হচ্ছে গ্রামীণ ব্যাংকের। যার মালিক ৮৯ লাখ ১৫ হাজার ঋণগ্রহীতা গরিব মানুষ। ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছেন, নোবেল নিজে পেয়েছেন, নিজের গড়া প্রতিষ্ঠান পেয়েছে। সেই গ্রামীণ ব্যাংকের পরিণতি কী সরকারি ব্যাংকগুলোর মতো হয়ে যাবে!

গোলাম মোর্তোজা: সম্পাদক, সাপ্তাহিক।
s.mortoza@gmail.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!