টাঙ্গাইলের গৌরব লালু ছিলেন বাংলাদেশের সর্বকনিষ্ঠ খেতাব প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা
মো. রাশেদ খান মেনন (রাসেল), টাঙ্গাইল, বিশেষ প্রতিনিধি । কাগজটোয়েন্টিফোরবিডিডটকম
বাংলাদেশে ৬৭৬ জন খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন টাঙ্গাইল জেলায় গোপালপুর উপজেলার শহিদুল ইসলাম লালু। তিনি মাত্র ১২ বছর বয়সে স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদান রেখে বীর প্রতীক খেতাব পেয়েছিলেন। প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশগ্রহণে তার রয়েছে আলোচিত এই ছবি। বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ৭ মার্চের ভাষণে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।
৭১’র সর্বকনিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা টাঙ্গাইলের গোপালপুর পৌর শহরের সূতীপলাশ পাড়া গ্রামের মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিনের ছেলে শহিদুল ইসলাম লালু। ছোটবেলা থেকেই দুরন্ত প্রকৃতির ছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় গোপালপুরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ফায়ারিং শুরু হলে স্থানীয়রা এলাকা ছাড়তে শুরু করে। লালুও সঙ্গে যায়। তার সঙ্গে ধনবাড়ির কেরামজানী স্কুল মাঠে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচয় হয়। কমান্ডার কাজী হুমায়ুন আশরাফ বাঙ্গাল ও আনোয়ার হোসেনের হাত ধরে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে চলে যান লালু। মুক্তিযোদ্ধাদের চা-পানি খাওয়ানোর পাশাপাশি অস্ত্র পরিষ্কারের কাজ করতেন। এভাবেই অস্ত্র ধরা শেখেন কিশোর লালু। সপ্তাহ খানেক পর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে প্রশিক্ষণে ভারত চলে যান। ভারতে স্টেনগান ও গ্রেনেড পান। আর পোশাক হিসেবে হাফপ্যান্ট, গেঞ্জি ও ক্যাপ। ভারতের তুরা ক্যাম্পে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণকালে ব্রিগেডিয়ার সামসিং শহিদুল ইসলামের নামের সঙ্গে লালু নামটি যুক্ত করেন। সেই থেকে শহিদুল ইসলামের নাম হয়ে যায় শহিদুল ইসলাম লালু। এই লালু ভারতের তুরা ক্যাম্পে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ চলাকালীন প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যা হুইসেল বাজিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের লাইনে দাঁড় করিয়ে জাতীয় সংগীত গেয়ে পতাকা উঠাতেন ও নামাতেন। লালু স্টেনগান ও গ্রেনেড বিষয়ে ভালো শিক্ষা নিয়ে চলে আসেন গোপালপুরের কেরামজানীতে। তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল গোপালপুর থানার পাকিস্তানি হানাদার বাংকার গ্রেনেড মেরে উড়িয়ে দেওয়ার। লালু হাফপ্যান্ট পড়ে বিকালে তিনটি গ্রেনেড নিয়ে গোপালপুর থানার সামনে যেতেই পরিচিতদের সঙ্গে দেখা। সেখানে রাজাকারও ছিল। এসময় বাংকারে পাঞ্জাবী সেনাদের ক্যাম্পে চা খাওয়ানোর প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায় লালু। গ্রেনেড তিনটি থানার পেছনের পুকুর পাড়ে রেখে ক্যাম্পে প্রবেশ করে। লালু ছোট হওয়ায় সহজেই লুকিয়ে রাখা গ্রেনেডগুলো আনেন। পরে খুলে দ্রুত প্রত্যেক বাংকারের দিকে ছুড়ে মারেন। এতে তিনটি বাংকারের সবাই মারা যায়। মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৯৭২ সারের ২৪ জানুয়ারি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে যখন টাঙ্গাইল বিন্দুবাসিনী স্কুলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে কাদেরিয়া বাহিনীর সব মুক্তিযোদ্ধা অস্ত্র জমা দিচ্ছিলেন। তখন শহীদুল ইসলাম লালুও তার ব্যবহৃত স্টেনগানটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে তুলে দেন। বঙ্গবন্ধু অবাক হয়ে লালুর পিঠ থাপড়ে বলেছিলেন সাব্বাশ। যখন সহযোদ্ধাদের কাছ থেকে লালুর বাংকার ধ্বংসের কথা শুনলেন তখন বঙ্গবন্ধু তাকে আদর করে কোলে নিয়ে বলেছিলেন ‘বীর বিচ্ছু’। শহিদুল ইসলাম লালু সশস্ত্র বাহিনী দিবস ২০০০, আজীবন সংবর্ধনা ২০০৩, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া কর্তৃক পুরস্কার ও আর্থিক অনুদান, মিশরের রাষ্ট্রদূত কর্তৃক পুরস্কারসহ আরও অনেক খেতাবে ভূষিত হয়েছিলেন। শহিদুল ইসলাম লালু ২০০৯ সালের ২৫ মে ঢাকার মিরপুরে নিজ বাসভবনে মারা যান। পরে মিরপুরেই তাকে সমাহিত করা হয়। যুদ্ধকালীন কোম্পানি কমান্ডারগণ জানান , ‘ওই ছবিটি ক্যামারাবন্দি করা অজ্ঞাত সেই ফটোগ্রাফার বলছিলেন, যুদ্ধ করে তো আর কিছু পাবে না, ছবিটিই থাকবে। আজ তাই এই ঐতিহাসিক ছবি নিয়ে সম্মানসূচক আলোচনা হচ্ছে।