তারুণ্যের প্রতীক বিপ্লবী ফিদেল কাস্ত্রো ও চে গুয়েভারা
সম্পাদকীয় । কাগজটোয়েন্টিফোরবিডি.কম
কিউবার প্রাক্তন বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রো স্থানীয় সময় শুক্রবার (২৫ নভেম্বর, ২০১৬) রাত ১০টা ২৯ মিনিটে মারা গেছেন। তার বয়স হয়েছিল ৯০ বছর। ফিদেল কাস্ত্রো প্রায় ৫০ বছর কমিউনিস্ট রাষ্ট্র হিসেবে কিউবা শাসন করেন। এরপর ২০০৮ সালে ভাই রাউল কাস্ত্রোর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে রাজনীতি থেকে সরে পড়েন।
একনজরে দেখে নেওয়া যাক ফিদেল কাস্ত্রোর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলিঃ
১৯২৬- কিউবার দক্ষিণ-পূর্ব ওরিয়েন্তে প্রদেশে জন্মগ্রহণ করেন ফিদেল কাস্ত্রো
১৯৫৩- বাতিস্তার শাসনের বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থানের দায়ে কারাদণ্ড।
১৯৫৫- সাধারণ ক্ষমার অধীনে কারাগার থেকে মুক্তি।
১৯৫৬- চে গুয়েভারাকে সঙ্গে নিয়ে কিউবার সরকারের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ।
১৯৫৯- বাতিস্তাকে পরাজিত করে কিউবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন।
১৯৬০- যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর মদদপুষ্ট ‘বে অব পিগস’ নামের কিউবার নির্বাসিত বিরোধীদের লড়াইয়ে পরাজিত করেন।
১৯৬২- তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সমঝোতার পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রের দিকে পরমাণু অস্ত্রবাহী ক্ষেপণাস্ত্র তাক করে আলোচিত ‘কিউবার ক্ষেপণাস্ত্র সংকট’ এর জন্ম দেন।
১৯৭৬- কিউবার ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির দ্বারা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
১৯৯২- কিউবার শরণার্থীদের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি সমঝোতায় পোঁছান।
২০০৮- স্বাস্থ্যগত কারণে কিউবার প্রেসিডেন্টের পদ থেকে সরে দাঁড়ান।
২০১৬- এপ্রিল মাসে শেষবারের মতো জনসমক্ষে ভাষণ দেন।
২০১৬- ২৫ নভেম্বর শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
আরনেস্তো চে গুয়েভারা ‘ফিদেলের জন্য কবিতা’ শিরোনামে একটি কবিতা লেখেন। ফিদেল ও চের চেতনার ঘনিষ্ঠতা বুঝতে এ কবিতাই যথেষ্ট।
ফিদেলের জন্য কবিতা-
চলো যাই
অগ্নিময় প্রত্যুষে
বালুকাময় আঁকাবাঁকা নির্জন পথ পেরিয়ে
তোমার ভালোবাসার সবুজ স্বপ্নময়
দেশের মুক্তির জন্য।
চলো যাই
জমাট বাঁধা অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতে
আমাদের ললাটে অসংখ্য বিদ্রোহের তারা জ্বলছে
শপথের বহ্নিতে না হয় আমরা মরব
অথবা জিতব
যখন প্রথম বুলেটের শব্দে দেশ জেগে ওঠে
কারুময় ঘুম থেকে আচমকা কোনো এক বালিকার মতো
তখনো অবিচলিত থেকো, হে যোদ্ধা
আমরা তোমার পাশেই আছি…
থাকব।…
যখন তুমি জোর প্রচার করো :
জমি-সংস্কার, ন্যায়, রুটি-রুজি আর
স্বাধীনতার
তখন আমরাও তোমার সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করি :
আমরাও আছি;
আমাদের মুক্তির লক্ষ্যবানে
যখন বিপক্ষের বন্যপশুরা হতাহত হয়:
তখনো আমরা তোমার সাথে থাকি,
আমাদের হৃদয় গর্বে স্ফীত হয় :
আমরা সেখানে আছি।
বিপক্ষের সজ্জিত সৈন্যের নেকড়ে আক্রমণে
আমাদের প্রস্তাবিত সংকল্পের ভিত কখনো
টলবে না। আমরা চাই :
একটি রাইফেল, কিছু বুলেট
আর
লাঠিসোঁটা।
তবু যদি
বিপক্ষের রাইফেলগুলো ভীষণ গর্জে ওঠে
এবং ইতিহাসের বিক্ষুব্ধ তরঙ্গে যদি
আমরা লীন হয়ে যাই
তখন কেবল আমাদের এইটুকুই চাওয়া :
কিউবার অশ্রু যেন
যুদ্ধে মৃত সৈনিকের এক একটি কাফন হয়।
প্রায় সমবয়সি দুই বিপ্লবী নেতার হাত ধরে লাতিন আমেরিকায় কমিউনিস্ট আন্দোলন আলোর মুখ দেখে। শোষিত ও নির্যাতিত মানুষের পক্ষে সংগ্রাম করে সাম্যবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় জীবনবাজি রেখে লড়াই করেন এই দুই নেতা।
১৯৫৩ সালে পেশায় চিকিৎসক চে গুয়েভারা দক্ষিণ আমেরিকা ভ্রমণে বের হন। এর দুই বছর পর তিনি মেক্সিকোয় পৌঁছান। এখানে তার সঙ্গে দেখা হয় ফিদেল কাস্ত্রোর ছোট ভাই রাউল কাস্ত্রোর। এই সূত্র ধরে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় আইনজীবী ফিদেল কাস্ত্রোর। মেক্সিকো থেকে দুই বিপ্লবী নেতার পথচলা শুরু হয়।
ফিদেল ও চে পরিকল্পনা করেন মেক্সিকো থেকে কিউবায় আক্রমণ করবেন। ১৯৫৬ সালের ২৫ নভেম্বর তারা কিউবার উদ্দেশে রওনা দেন। কিউবায় পৌঁছামাত্র তারা বাতিস্তার সেনাবাহিনীর হামলার মুখে পড়েন। এ যুদ্ধে ফিদেলের ৮২ সহযোগী মারা যান অথবা কারাবন্দি হন। মাত্র ২২ জন সহযোদ্ধা প্রাণে বেঁচে ছিলেন। চের ভাষায়, এই যুদ্ধ তাকে চিকিৎসক থেকে বিপ্লবীতে পরিণত করে।
কিউবান বিপ্লবীদের অবিচ্ছেদ অংশ হয়ে উঠেছিলেন চে। সমাজতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে তিনি ফিদেল কাস্ত্রোকে নানা দিক থেকে পরামর্শ দিতেন। বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা, কূটনীতি ও বিদ্যমান সমস্যাগুলো নিয়ে ফিদেলের সঙ্গে আলোচনা করতেন।
বিপ্লবের সময় ফিদেল বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেন চেকে। বোমা তৈরির কারখানা, রুটি সেঁকার চুল্লি তৈরি ও নিরক্ষর সহযোদ্ধাদের জন্য পাঠশালা পরিচালনার দায়িত্ব পান তিনি। এ ছাড়া স্বাস্থ্যকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, সামরিক প্রশিক্ষণ ও পত্রিকায় বিপ্লবীদের খবর প্রচারের দায়িত্বে ছিলেন চে। সবদিক থেকে ফিদেল কাস্ত্রোকে সহযোগিতা করায় টাইম ম্যাগাজিন তাকে ‘কাস্ত্রোর মস্তিষ্ক’ বলে অভিহিত করেন।
ফিদেলের নেতৃত্বাধীন বিপ্লবীকে সংগঠিত করে রাখতে চে ছিলেন অবিকল্প নেতা। তিনি কিউবার বিদ্রোহী বাহিনীর কমান্ডার হন এবং কঠোর হাতে শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করেন। ফিদেল ও চের যৌথ নেতৃত্বে ১৯৫৯ সালে পতন হয় যুক্তরাষ্ট্রপন্থি কিউবার একনায়ক বাতিস্তার। ১৯৬১ সালে ফিদেল কিউবার শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন চেকে। ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন। কিউবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধানের দায়িত্বও পালন করেন চে।
চে’র কিছু উক্তি-
১। বিপ্লব তো আর গাছে ধরা আপেল নয় যে পাকবে আর পড়বে, বিপ্লব অর্জন করতে হয়।
২। নিষ্ঠুর নেতাদের পতন এবং প্রতিস্থাপন চাইলে নতুন নেতৃত্বকেই নিষ্ঠুর হতে হবে।
৩। নীরবতা একধরনের যুক্তি যা গভীর তথ্য বহন করে।
৪। শিক্ষা ব্যবস্থা তৃনমূল পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে, যেখানে গরীব থেকে ধনী একই শিক্ষায় শিক্ষিত হবে, এমন নয় যাদের টাকা আছে শুধু তারাই শিক্ষিত হবে।
৫। আমরা কিসের জন্য বাঁচব সেটা আমরা নিশ্চিত হতে পারি না যতক্ষণ না আমরা তার জন্য মরতে প্রস্তুত থাকি।
৬। সবাই প্রত্যেকদিন চুলে চিরুনি চালায় যাতে চুল সুন্দর পরিপাটি থাকে, কেউ কেনো হৃদয় সুন্দর পরিপাটি রাখে না?
৭। বাস্তববাদী হও,’অসম্ভব’কে দাবী কর।
৮। আমি কোনো মুক্তিযোদ্ধা নই, মুক্তিযোদ্ধা বাস্তবে কখনো হয় না যতক্ষণ মানুষ নিজে মুক্তিকামী হয়।
৯। কিছু ব্যাপার পরিষ্কার, আমরা চমৎকারভাবে শিখেছি একজন সাধারণ মানুষের জীবন পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ব্যক্তির সম্পদের চেয়েও লক্ষগুণ বেশি দামী।
১০। নতজানু হয়ে সারা জীবন বাঁচার চেয়ে আমি এখনই মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত।
১১। বিপ্লবী হতে চাও? বিল্পবের প্রথম শর্ত, শিক্ষিত হও।
মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্তে চে গুয়েভারা সৈনিকদের বলেছিলেন, “আমাকে গুলি করো না, আমি চে গুয়েভারা, আমাকে মেরে ফেলার পরিবর্তে বাঁচিয়ে রাখলে তোমাদের বেশি লাভ হবে।“ কিন্তু তাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়নি। ১৯৬৭ সালের ৯ই অক্টোবর সারারাত বলিভিয়ার লা হিগুয়েরা গ্রামের একটি স্কুলঘরে আটকে রেখে তাকে হত্যা করা হয়। তার হত্যাকারী ছিলেন বলিভিয়া সেনাবাহিনীর মদ্যপ সার্জেন্ট মারিও তেরান। চে-কে ধরা ও হত্যা করার পেছনে কাজ করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ। মৃত্যুর পরপরই তিনি বিশ্বজুড়ে বিপ্লবীদের কাছে নায়ক হয়ে ওঠেন। তাকে হত্যার পেছনে লাতিন আমেরিকার একনায়ক শাসক আলফ্রেদো ট্রয়েসনারের হাত ছিল বলে তথ্য দিয়েছেন প্যারাগুয়ের গবেষক মার্টিন আলমাদা। কারণ ‘চে’ তার বিরুদ্ধেও গেরিলা যুদ্ধ শুরু করতে পারেন বলে তার ভয় ছিল।
সম্পাদনায়/মাহবুব এইচ শাহীন/ সম্পাদক ও প্রকাশক/কাগজ২৪
তথ্যঃ (১) https://bn.wikipedia.org/wiki/চে_গেভারা
(২) বই – বলিভিয়ার ডায়েরী