সেলিনা জাহান প্রিয়ার গল্প-নতুন বউয়ের সিনেমা দেখা
নতুন বউয়ের সিনেমা দেখা (১৯৮৪ সালের একটা সত্য ঘটনার ছায়া অবলম্বনে)
——————————————————————————————– সেলিনা জাহান প্রিয়া
হাতের বিড়ি টা শেষ টান দিয়া পোস্ত গোলা ডায়না সিনেমা হলের সামনে সন্দু মিয়া চিৎকার করে বলতে লাগলো এই ডিসি খালি আর মাত্র চারটা টিকেট আছে। এই ডিসি। ডিসি। আনসার মিয়া নতুন বউ নিয়া আসছে সিনেমা দেখতে ডায়নায়। ব্ল্যাকে ছাড়া টিকেট নাই। মানুষ আর মানুষ হলের সামনে। শাবানা আর আলমগিরের ছবি। আনসার মিয়া টিকেট পায় না। ব্লাকে কিনতে গেলে শুনে চার গুন দাম। সন্দু মিয়া সাথে দুইটা টিকেট নিয়ে অনেক বার দামা-দামি করে কিন্তু সন্দু মিয়া দাম ছারে না। আনসার মিয়া দেখে হিসাব করে মনেমনে না দাম বেশি হয়ে যায়।
সন্দু মিয়া কে বলে আপনাদের মত মানুষের জন্য আজ দেশ এই অবস্থা। আপনাকে পুলিশে দেয়া দরকার। সন্দু মিয়া বলে পুলিশকে টাকা দিয়েই ব্ল্যাক করি টিকেট। অনেক বার কথা কাটাকাটি করে শেষ পর্যন্ত সন্দু মিয়ার দামেই টিকেট কিনে। যাই হউক একটু বেশি দামে সন্দু মিয়ার কাছ থেকে টিকেট কিনে বউ কে নিয়ে দু’তলায় গেল। নতুন বউ মাথায় কাপড়। হাতে মেহেদি লাগানো। একটা লাজুক লাজুক ভাব আছে যে দেখলেই বুঝা যায়। আনসার মিয়া বউ কে নিয়ে তার বোনের বাড়ির কথা বলে হলে আসছে। বউয়ের পরনে বোরখা।
ছয়টা থেকে নয়টা সিনেমা দেখবে। একটু একটু ভয়ও লাগছে আনসার মিয়ার। যদি এলাকার কেউ দেখে ফেলে তাহলে তো ইজ্জত যাবে। যে নতুন বউ নিয়ে হলে আইছে।
দেশের অবস্থা ভাল না। এরশাদ সাহেব দেশের ক্ষমতায় আইছে। আর্মি নামছে। মার্শাল ল চালু হইছে। নতুন বউয়ের মন রাখতে সে আজ সিনেমা দেখতে আসছে। কিছু বাদাম কিনে হলের ভিতরে প্রবেশ করে কেবল সিটে বসছে। বউ হাত দিয়ে দেখায়। দেখ লাল শাড়ি পড়ে আর একজন আসছে। লোকটা বউয়ের কাঁদে হাত দিয়ে বসে আছে। আনসার বলে লাজ সরম কম। হলের ভিতরে কেউ বউয়ের কাঁদে হাত দেয়। হলের ভিতরে সবাই সোজা হয়ে দাড়ায়। জাতীয় সংগীত হচ্ছে। বউ বলে দাড়ায়ে বলে আমাদের পতাকা কি সুন্দর। আর বাতাস পাইলে ফর ফর করে ঊরে। পতাকা দেখলে মনটা শান্তি লাগে। আনসার বলে ঠিক বলেছ। একটা পতাকা আমার পরিচয়। সিনেমা শুরু হয়। হল নীরব। ছবি যে মানুষ কত ভালবাসে দেখলে বুঝা যায়। শাবানা, আলমগির কে একটা গানে জড়িয়ে ধরে। সারা হলের মানুষ সীস দিয়ে উঠে। কেউ চিৎকার করে বলে মার হাবা মার হাবা। নতুন বউ লজ্জায় আরও মাথা নিচু করে।।
সিনেমা বিরতি হয়। ডায়না হলের সামনে থেকে সেভেন আপ কিনে বউয়ের জন্য নেয়। বউ বলে এইটা কি জিনিস। গ্রামের মেয়ে এর আগে দেখে নাই। আনসার বলে এটা সেভেন আপ। খুব মজা। বউ বলে গুনা হবে না তো। আনসার মিয়া হেসে বলে সিনেমা দেখলে কি গুনা হয়। বউ বলে তুমি যা বল না। আমি একবার বড় আপা আর দুলা ভাইয়ের সাথে দেখছি সিনেমা। তবে আজকের মত পলাইয়া। আনসারের বউ সেভেন আপ মুখে দিয়ে বলে এটা মুখে কেমন জানি লাগে। আমি খাব না। তুমি খাও। আনসার বলে আরে খাও বিদেশী শরবৎ অনেক মজা।
সিনেমা শেষ করে হল থেকে বের হয়ে রিক্সা নিয়ে রওনা দিল বাসার দিকে। রাত সারে নয়টা বাজে। আর্মি রিক্সা থামায় জুরাইন রেল গেইটের সামনে। রিক্সা চালকে বলে গাড়িতে হ্যারিকেন নাই কেন। রিক্সা ওয়ালাকে লাঠি দিয়ে দুইটা বারি দেয়। রিক্সার চালক বারি খেয়ে স্যার স্যার আর ভুল হবে না বলে মাটিতে গড়িয়ে পড়ে। আবার একটা লাথি দিয়ে বলে হারাম জাদা উঠে দাড়া। কান ধরে ১০১ বার উঠ বস কর। আনসার আলির দিকে এক আর্মি ভাল করে চায়। আনসারের এক হাত তার বউ ধরে রেখেছে ভয়ে। আর্মি বলে
—— এই তোমার সাথে কে?
—— আনসার বলে স্যার আমার পরিবার।
—— পরিবার নাকি অন্য কেউ। রিক্সা থেকে নেমে আসো।
—– আনসার নেমে চুপ করে দাড়ায়।
—– আর্মি বউ কে বলে এই যে ভদ্র মহিলা আপনার শ্বশুরের নাম কি?
—– আর্মির ভয়ে বউ নিজের বাপের নাম ভুলে গেছে। আর শ্বশুরের নাম কেমনে
বলে। মেয়ে কেঁদে দিয়ে বলে স্যার জানি না।
—– আনসার কে বলল এই তোমার শ্বশুরের নাম কি?
—– আনসার বলতে পারলো।
—– আর্মি বলল কোথায় থেকে এসেছ।
—– স্যার হলে সিনেমা দেখে আসলাম।
—– বাহ! বেশ তো! দেশে যে মার্শাল ল তুমি জান।
—– জি স্যার।
—– আর্মি আনসারের বউ কে বলে সিনেমা দেখতে আসলেন বাসার সবাই জানে।
—— আনসারের বউ বলল। না স্যার। মিথ্যা কথা বলে সিনেমা দেখতে আসছি।
—- আর্মি বলল বাপ মায়ের সাথে মিথ্যা। নাম রিক্সা থেকে। দুই জন মিলে কান ধরে ১০১ বার উঠ বস কর।
আর্মিরা সব রিক্সা আর গাড়ি চেক করছে। অনেক কে গাড়িতে তুলছে। কাউকে দু চারটা বারি মেরে ছেড়ে দিচ্ছে। কাউকে চুল বড় রাখার জন্য চুল ধরে মারছে। সন্দু মিয়া আর্মি অফিসার কে সালাম দিয়ে বলল স্যার এরা নতুন বিয়ে করেছে।
আমাকে স্যার ওদের বদলে সাজা দিন। সন্দু মিয়া বলল স্যার মেয়েটা একদম অল্প বয়স। ভয়ে মারা যাবে। আমার সাথে কোন পরিচয় নাই। উমুক মেজর আমার ছোট ভাই। যাই হউক দুই জনকে ৫ বার কান ধরাইয়ে আর্মি ছেড়ে দিল। আর বলল অভিভাবক ছারা ছেড়ে দেয়া যায় না। আপনি যখন বলছেন তাহলে ছাড়লাম।
সন্দু মিয়া আনসার কে বলে যাও বাবা। আমার মাকে নিয়ে বাসায় যাও। রিক্সায় বসে দুই জন মিলেই কাঁদছে সরমে। কত মানুষের সামনে কান ধরে উঠ বস করলো। রিক্সার চালক বলল আমারে খুব জুরে বারি দিছে। আপনাদের কপাল ভাল ঐ সন্দু মিয়া আহনে বেঁচে গেলেন। আল্লাহ্র নাম নেন। আনসার মিয়া তার পড় যখন সন্দু মিয়ার সাথে দেখা হয় আনসার তাকে শ্বশুর ডাকে। আর সন্দু মিয়া জামাই ডাকে। আজ এরশাদ নাই ক্ষমতায় কিন্তু সন্দু মিয়া আর আনসার মিয়া জামাই শ্বশুর সম্পর্ক আজো আছে।। আনসারের বউ সন্দু মিয়া কে আব্বাই ডাকে।।