পুঁজিসংকটে বেসরকারি ব্যাংক
অনলাইন ডেস্ক । কাগজটোয়েন্টিফোরবিডিডটকম
নজিরবিহীন অর্থসংকটে বেশির ভাগ বেসরকারি ব্যাংক।বর্তমানে পরিস্থিতি তে, বড় কোনো চেক এলে কোনো কোনো ব্যাংক টাকা দিতে পারছে না। এছাড়া শিল্প প্রতিষ্ঠানসহ বড় বড় খাতে অনেক ব্যাংক ঋণ দেয়ার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। এমকি কিছু ব্যাংক অনুমোদিত ঋণের অর্থও দিতে পারছে না। এসব খবর শুনে নানা শঙ্কায় সাধারণ গ্রাহকরা ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিচ্ছে। অনেকে তাদের এফডিআর ভেঙে ফেলছেন। শোনা যাচ্ছে, সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বেসরকারি ব্যাংকে রাখা তাদের বাল্ক ডিপোজিট সরিয়ে নিচ্ছে।
ব্যাংক ও অর্থনীতি বিশ্লেষকদের ধারণা, বেশির ভাগ ব্যাংকে কমবেশি ২০-৩০ হাজার কোটি টাকা পুঁজি থাকার কথা। এগুলো সাধারণ মানুষের গচ্ছিত টাকা। ব্যাংক তার নিয়মানুযায়ী এসব টাকা ঋণ দিয়ে ব্যবসা করে থাকে। যথানিয়মে এ পদ্ধতি চালু থাকলে কখনও কোনো ব্যাংকের অর্থ সংকটে পড়ার কথা নয়। কিন্তু বাস্তবে তা তো হয়নি। প্রথমদিকে অনিয়ম দুর্নীতি করে যাকে তাকে বাল্ক প্যাকেজে ঋণ দেয়া হয়। ফলে এসব ঋণগ্রহীতা এখন খেলাপি। অথচ এসব গুরুতর অপরাধে কারও কোনো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি। এ কারণে তা পরবর্তীতে আরও ভয়াবহ রূপ নেয়।
কিছু ব্যাংকের পরিচালক তথা মালিক পক্ষ ভাগাভাগি করে একজন আরেকজনের ব্যাংক থেকে মোটা অংকে ঋণ নিয়েছে। এলসি খুলে কোনো পণ্য না এনে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন। এভাবে গত এক দশক থেকে ব্যাংকে ঋণখেলাপি ও জালিয়াতির পরিমাণ ক্রমেই বেড়েছে। এখন যা বিপদসীমায় অতিক্রম করেছে।
নজিরবিহীন এই তারল্য সংকট প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, প্রাইভেট ব্যাংকের তারল্য সংকটের জন্য তারা নিজেরাই দায়ী। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম উপেক্ষা করে তারা বেপরোয়াভাবে ঋণ দিয়েছে।
বিভিন্ন ব্যাংক ও ব্যবসায়ীদের সূত্রে জানা গেছে, বেসরকারি খাতের বেশ কিছু ব্যাংকের কাছে নতুন ঋণ দেয়ার মতো কোনো অর্থ নেই। এমনকি আগের অনুমোদিত ঋণও টাকার অভাবে ছাড় করতে পারছে না। এছাড়া ফারমার্সসহ কোনো কোনো ব্যাংক এফডিআরের টাকাও ফেরত দিতে পারছে না।
এ প্রসঙ্গে ব্যাংকগুলোর এমডিদের সংগঠন-অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, খেলাপি ঋণ ছাড়াও ডলারের উচ্চমূল্যের কারণে টাকার ওপর চাপ পড়েছে। এছাড়াও বাস্তব কিছু কারণে তারল্য সংকট সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন তিনি। তবে এটা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করা হচ্ছে।
ব্যাংকগুলোতে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, বেসরকারি একটি ব্যাংকের মধ্যম সারির এক কর্মকর্তাকে গড়ে প্রতিমাসে ৫০ লাখ টাকা আমানত সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়েছে। হিসাব করলে দেখা যায়, প্রতিদিন প্রায় দুই লাখ টাকা করে আমানত সংগ্রহ করতে হবে এ সারির একজন ব্যাংকারকে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আরও বেশি লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। কিন্তু তারা সম্ভাব্য বিভিন্ন স্থানে ধরনা দিয়েও এই হারে আমানত রাখার মতো লোক জোগাড় করতে পারছেন না। এর ফলে ব্যাপক মানসিক চাপে রয়েছেন ব্যাংকাররা। ব্যাংকের তারল্য সংকট এখন এমনই দাঁড়িয়েছে যে, দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটানোর মতো অর্থও অনেক ব্যাংকে নেই। এ অবস্থায় অন্য ব্যাংকের কাছ থেকে ধার নিয়ে প্রয়োজনীয় কাজ সারতে হচ্ছে। এজন্য আন্তঃব্যাংক কলমানি সুদহার প্রায় সাড়ে চার শতাংশ হয়েছে।
এদিকে আমদানি-রফতানিসহ অন্য প্রায় সব ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাংকের টাকায় পরিচালিত হয়। এসব কার্যক্রমের জন্য চুক্তি মোতাবেক অর্থ চেয়ে পাচ্ছেন না উদ্যোক্তারা। ফলে বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে অর্থনীতিতে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিভিন্ন ব্যাংকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রায় সব ব্যাংকই আমানতের সুদহার বাড়িয়েছে। বিশেষ করে যেসব ব্যাংকের আমানত তুলনামূলক কম তারা বেশি বাড়িয়েছে। বেসরকারি খাতের নতুন প্রজন্মের ব্যাংকগুলো এক্ষেত্রে বেশি এগিয়ে রয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষে সুদ ১৪ শতাংশ পর্যন্তও দেয়া হচ্ছে, যা গত এক মাস আগেও এ হার ছিল এক অঙ্কের ঘরে। অর্থাৎ ৯ শতাংশের মধ্যে। অন্যদিকে নতুন ব্যাংকের পাশাপাশি পুরনো ব্যাংকগুলোও আমানতে এখন ১০ থেকে ১১ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, গত বছরের শেষের দিকে ব্যাংকিং খাতে এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা অলস তারল্য ছিল। গত কয়েক মাসে ঋণ বিতরণের ফলে তা ৮৬ হাজার কোটি টাকায় নেমে এসেছে। এর মধ্যে বেশিরভাগ ঋণই গেছে সরকারি ব্যাংক থেকে। গত বছর ব্যাংকগুলো ৮৫ হাজার ৯১১ কোটি টাকা আমানত সংগ্রহ করে। কিন্তু ঋণ বিতরণ করেছে এক লাখ ৩১ হাজার ৩২৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ আমানতের তুলনায় ৪৫ হাজার ৪১২ কোটি টাকা বেশি ঋণ বিতরণ করেছে। এতে অলস অর্থ চলে গেছে। এদিকে তারল্য সংকট সামাল দিতে এরই মধ্যে আকর্ষণীয় মুনাফায় আমানত সংগ্রহের ঘোষণা দিয়ে মাঠে নেমেছে বেশ কিছু ব্যাংক। এগুলোর তালিকায় রয়েছে নতুন প্রজন্মের ফারমার্স ব্যাংক, মধুমতি ব্যাংক ও সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক। তবে ব্যাংকাররা বলছেন, আস্থা সংকটের কারণে এভাবে কাক্সিক্ষত আমানত সংগ্রহেও কাজ হচ্ছে না। কারণ ফারমার্স ব্যাংক গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে পারছে না বলে বেশির ভাগ মানুষের আস্থা নষ্ট হয়ে গেছে।