পেশাদার প্রতারক আনোয়ার হোসেন গাজীর প্রতারণায় নিঃস্ব সাধারণ মানুষ
আর কে আকাশ, পাবনা, বিশেষ প্রতিনিধি । কাগজটোয়েন্টিফোরবিডিডটকম
পেশাদার প্রতারক আনোয়ার হোসেন গাজীর প্রতারণায় নিঃস্ব হয়েছেন অসংখ্যা মানুষ। সে বিভিন্ন কৌশলে এই প্রতারণা করে বানিয়েছেন আলিশান বাড়ি ও অঢেল সম্পদ। ৮ম শ্রেণী পাশ হলেও প্রতারণাকে সে একটি পেশা বানিয়েছে ফেলেছেন। প্রতারণা ছাড়াও তার বিরুদ্ধে ভূমি দখল, মামলা দিয়ে হয়রানি, সন্ত্রাসী কার্যাকলাপের গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। প্রতারক আনোয়ার হোসেন গাজী পাবনা জেলার আমিনপুর থানার রাণীনগর ইউনিয়নের বৃ-মালঞ্চি (বেলতলা মোড়) গ্রামের মো. মোন্তাজ আলী মিয়ার ছোট ছেলে।
তার প্রতারণার বিপুল সংখ্যক অভিযোগের ভিত্তিতে প্রতিবেদক এই প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন।
মো. আনোয়ার হোসেন গাজী বিভিন্ন পরিচয়ে ঢাকা-পাবনাসহ বিভিন্ন জায়গায় প্রতারণা করে থাকেন। প্রতারণা করেই আলিশান ভাবে চলাফেরা তার। গাজী অনেকের কাছ থেকে বিভিন্ন ব্যবসার কথা বলে টাকা নিয়ে আত্মসাৎ করেছেন। তিনি নিজেকে কেরাণীগঞ্জ, চক বাজার ও বাবুবাজার-এর বড় ব্যবসায়ী বলে পরিচয় দিয়ে থাকেন। গাজী প্রতারণার ক্ষেত্রে ঢাকার চকবাজার-এর ১০ নং বেগম বাজার (মসজিদ মার্কেট)-এর ০৭ নং দোকান এবং কেরাণীগঞ্জের ব্যাবসায়ীক প্রতিষ্ঠানের নাম ভাঙ্গিয়ে নিজেকে সে একজন বড় এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যবসায়ী বলে জানায়।
কখনো কখনো নিজেকে ঢাকার পুলিশের ডিআইজি হাবিবুর রহমান-এর সাথে ঘনিষ্ঠতা এবং ব্যাংকের বড় কর্মকর্তাদের ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবদের সঙ্গে গাজীর ঘনিষ্ঠতার কথা প্রচার করে থাকেন। এছাড়াও তিনি জমির ব্রোকারি ও বিভিন্ন ধরনের অপরাধের সাথে জড়িত। ব্যাংকে চাকুরী, ব্যাংকে বদলি, ব্যাংকে মোটা অংকের লোন পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে বিপুল পরিমান অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন।
এই প্রতারক এলাকায় প্রতারণার পাশাপাশি ভূমিদস্যু ও মামলাবাজ হিসেবেও পরিচিত। অন্যের জমি বা বাড়ি নিজের নামে জাল দলিল করে বিক্রি করা ও হয়রানির অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। স্কয়ার এর পরিচালক তপন চৌধুরীর শ্যালক এনামুল হক রাব্বির জমির জাল দলিল বানিয়ে নিজের বলে দাবি করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে (যার মামলা নং- ১৩/২০১৪ সুজানগর।
পরিচিত লোকদের কাছ থেকে টাকা ঋণ নিয়ে পরিশোধ না করা, ঋণের টাকা চাইতে গেলে টাকা পরিশোধ না করে উল্টো পাওনাদার এর উপর হামলা ও মিথ্যা ডাকাতি মামলাসহ অন্যান্য মামলা দিয়ে হয়রানি করা এবং এসব বিষয়ে সালিশ হলে সালিশের স্বাক্ষীদের নামে মিথ্যা মামলা দেওয়া, পাবনায় তার গ্রামের স্থানীয় সমিতি থেকে টাকা ঋণ নিয়ে পরিশোধ না করা। ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে লোক পাঠানোর কথা বলে টাকা আত্মসাৎ করাসহ আরও বেশ কিছু অবৈধ কাজের সাথে সম্পৃক্ততার বিস্তর অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। আর এসকল কাজ করতে তিনি গড়ে তুলেছেন একটি অপরাধী চক্র। তার অপরাধচক্রের অন্যাতম সহযোগী হলেন, গাজীর বড় সম্বন্ধী বিপুল বিশ্বাস, ফুফাতো সম্বন্ধী কাশেম মন্ডল।
প্রতারক গাজী সম্পত্তির লোভে মুসা সরদারের স্ত্রী ছাহেরা বেগমকে বের করে এনে তালাক না করিয়ে ইসলামিক নিয়ম বর্হির্ভূতভাবে বিয়ে করেন।
মুসা সরদারের জামাই রাজ্জাক খানের কাছে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সুদমুক্ত ঋণ করিয়ে দেবার কথা বলে দশ লক্ষ টাকা আত্মসৎ করেছেন। রাজ্জাক খান জমি বিক্রি ও সুদের ওপর ঋণ করে গাজীকে টাকা এনে দেন। সেই ঋণের টাকার সুদ প্রতিমাসে এখনও পরিশোধ করতে হচ্ছে রাজ্জাক খানকে।
রাজ্জাক খান ও তার শ্যালক সম্বন্ধিরা পাওনা টাকা চাইলে গাজী তাদের বিরুদ্ধে ২০১৯ সালে ২ই জানুয়ারী পাবনার জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আমলি আদালতে (৬) মিথ্যা মামলা (মামলা নং- পিটিশন ০৪/২০১৯ (আমিনপুর), আদেশ নং-০১) দায়ের করে।
গাজী ও তার পালিত সন্ত্রাসী বাহিনী ২০২০ সালের ৩ জুন রাজ্জাক খানের শ্যালক রহমান, আলতাব সরদার ও সম্বন্ধি কাশেম সরদারকে হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা করে এবং শ্যালক হাশেম সরদারের দোকান পুড়িয়ে দেয়। অভিযোগকারীরা জানান, এ ঘটনায় আমিনপুর থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশ মামলা না নিয়ে আসামী পক্ষের থেকে ৩০ হাজার টাকা উৎকোচ নেয়। স্থানীয় এমপি আহমেদ ফিরোজ কবিরকে জানালে স্থানীয় শালিশে দোকান পুড়ানোর ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রতারক গাজী ৩০ হাজার টাকা পরিশোধ করে।
পাবনার টেস্টি স্যালাইন এর ডিলার দেয়ার কথা বলে মিরপুর মাজার রোডের শিহাব উদ্দিন এর কাছ থেকে আশি হাজার টাকা (সি.আর. মামলা- ১৮০/২০২০ ঢাকা), চক বাজারের আব্দুর রহমান মোল্লার কাছে থেকে দশ হাজার টাকা, অপর এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা, কেরানীগঞ্জের নূর মোহাম্মদ এর সাথে অংশীদারিত্ব ব্যবসার কথা বলে ১২ লক্ষ টাকার হিসাব না দিয়ে প্রতারণা, বড় বোন মমতাজের ছোট মেয়ের শ্বশুরবাড়ীর আত্মীয় ঢাকার আনোয়ারুল হক ভু্ইঁয়ার সাথে ব্যবসায়ীক প্রতারণা করেছেন।
পাবনার আমিনপুর থানার খানপুরের হালিম শেখের কাছ থেকে ৬ লক্ষ টাকা, গাজীর চাচাত ভাইরা হেলালকে দিয়ে সমিতি থেকে ৮০ হাজার টাকা উত্তোলন করিয়ে প্রতারণা, গাজীর চাচাত সম্বন্ধি রাজুকে জমি কট রাখার কথা বলে ৫০ হাজার টাকা নিয়ে জমি কট না রাখা, মিরপুরের রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী মালেকের সাথে ৩ লক্ষ টাকা প্রতারণা, আপন বড় বোন মমতাজের জমি তাকে না জানিয়ে রাণীনগরের রাজ্জাকের কাছে জমি বন্ধক রেখে টাকা আত্বসৎ, রাণী নগর স্কুল সংলগ্ন আওয়াল মহুরির কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা প্রতারণা, চক বাজার থেকে স্কচটেপ এনে দেবার কথা বলে রাণীনগরের ইসমাইলের কাছ থেকে পয়ত্রিশ হাজার টাকা প্রতারণা, রাণীনগরের আঞ্জু মিয়ার সমিতি থেকে ১ লক্ষ টাকা নিয়ে আত্মসৎ, কাশিনাথপুরের ভিআইপি ট্রান্সপোর্টের মালিক আইনুল হককে ভেকু (এক্সকাভেটর) আনার কথা বলে ৩ লক্ষ টাকা প্রতারণা করেছেন।
প্রতারক আনোয়ার হোসেন গাজী ঢাকার আরামবাগের আলী আহম্মেদ এর ছেলে হুমায়ন মোর্শেদকে ফ্রান্সে পাঠানোর কথা বলে দুই লক্ষ পঞ্চাশ হাজার ২,৫০,০০০ টাকা নিয়েছেন, পাবনা আমিনপুর থানার রাণীনগরের মৃত তফিজ উদ্দিন খানের ছেলে রাজ্জাক খান এর কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে দশ লক্ষ ১০,০০,০০০ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের দূর্গাপুর শাখা থেকে আট লক্ষ ৮,০০,০০০ টাকা লোন নিয়ে পরিশোধ না করার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
গাজীর প্রতারণায় আরও সর্বশান্ত হয়েছেন তাদের মধ্যে পাবনার রাণীনগরের ইসমাঈল হোসেন, কাশিনাথপুরের আইনুল হক, বেড়ার রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের সাবেক ম্যানেজার আলতাফ, রাণীনগর ইউনিয়নের বাদাই গ্রামের মেরি বিশ্বাস, কাজিরহাটের লালমিয়াসহ বিভিন্ন জনের কাছ থেকে প্রতারক গাজী বিভিন্ন কৌশলে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
এছাড়াও গাজীর নামে পাবনা ও ঢাকার একাধিক থানায় (ঢাকার কেরাণীগঞ্জ মডেল থানা, মিরপুর মডেল থানা, পল্লবী থানা, দক্ষিণ খান থানা, পাবনার আমিনপুর থানা) জি.ডি, অভিযোগ, চেক-এর প্রতারণার, জাল দলিলের ও পাওনাদারদেরকে হত্যা চেষ্টার মামলা আছে। যার জিডি নং- ১৩০৮, তারিখ- ১৫/০৩/২০২০ ইং, মিরপুর মডেল থানা (মিরপুর-০২), ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ, ঢাকা।
ঢাকাতে পল্লবী আমলী আদালত নং-০৪, সি. আর. ৩৫৩/২০ নং চেকের মামলা ও সি. আর. ১৮০/২০ নং চেকের মামলা। পাবনা জজ কোর্টে জাল দলিলের মামলা নং- অপর প্রকার ০৭/২০১১ সুজানগর উপজেলা সিনিয়র সহকারী জজ আদালত, পাবনা। মামলা নং- অপর প্রকার ৪৮/২০১১ সুজানগর উপজেলা সিনিয়র সহকারী জজ আদালত, পাবনা। মামলা নং-৩৩/১৩ পাবনা যুগ্ম জেলা জজ আদালত পাবনা।
পাওনা টাকা চাইলে বা তার বিরুদ্ধে কথা বললেই বিভিন্ন হয়রানির শিকার হতে হয় ভুক্তভোগীদের। রাণীনগর ইউনিয়ন-এর এলাকাবাসি গত ত্রিশ বৎসর যাবৎ উপরোক্ত বিষয়ে সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ব্যর্থ হয়েছেন। এমতাবস্থায় উল্লেখিত সমস্যার সমাধানকল্পে এলাকাবাসী ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করছেন।