টাঙ্গাইলে ১৯৫২ সনের প্রথম একুশে ফেব্রুয়ারি ও শহীদ মিনার নির্মাণ
বুলবুল খান মাহবুবঃ বাংলাদেশের গৌরবদীপ্ত মুক্তিযুদ্ধের মত উনিশ’শ বায়ান্নের রক্তঝরা ভাষা আন্দোলনে টাঙ্গাইলের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ ও পঞ্চাশ দশকের পূর্বপাকিস্তানের সবচেয়ে রাজনীতি সচেতন মহকুমা শহরগুলির মধ্যে (বর্তমানে জেলা শহর)
টাঙ্গাইল ছিল অন্যতম। মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর জন্ম সিরাজগঞ্জের সয়াধানগড়ায় হলেও টাঙ্গাইল ছিল তার অন্যতম বাসস্থান এবং কর্মভূমি। আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম এবং প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ‘বৈল্পবিক দৃষ্টিতে ইসলাম’ গ্রন্থের প্রণেতা তরুণ রাজনীতিবিদ টাঙ্গাইলের শামসুল হককে মওলানা সাহেব আওয়ামী লীগের জন্মলগ্ন থেকেই গড়ে তুলেছিলেন একজন অনলবর্ষী বক্তা ও সাংগঠনিক নেতা হিসেবে।
এই দুই রাজনৈতিক নেতা এবং কমিউনিস্ট পার্টির কতিপয় নিবেদিতপ্রাণ কর্মী ছাড়াও প্রগতিশীল চিন্তাধারা ও আন্দোলনের সাথে যুক্ত কিছু নেতা-কর্মীর অবস্থানের কারণে টাঙ্গাইল ছিল পঞ্চাশ দশকের পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতির অন্যতম কেন্দ্রভূমি। এখানে সৃষ্টি হয়েছিল হাতেম আলী খান, নারায়ন বিশ্বাসসহ বামপন্থী চিন্তাধারার কিছু প্রগতিশীল ব্যক্তিত্বের। করটিয়ার জমিদার খুররম খান পন্নীর মতো প্রভাবশালী জমিদারের বিরুদ্ধে অতি সাধারণ ঘরে জন্ম নেয়া রাজনৈতিক নেতা আওয়ামী লীগ সম্পাদক শামসুল হক যখন উপ-নির্বাচনে মুসলীম লীগ প্রার্থী জমিদার পন্নীকে পরাজিত করলেন তখন মুসলীম লীগের রক্ষনশীল এবং পূর্ব বাংলা বিদেষী রাজনীতিরই শুধু পরাজয় ঘটলো না, এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠলো সচেতন এবং প্রগতিশীল বিরাট এক কর্মী বাহিনী। আওয়ামী মুসলীম লীগের যুগ্ন সম্পাদক তখন শেখ মুজিবুর রহমান এবং খন্দকার মোশতাক আহমেদ। তিনি বেশ কিছুদিন টাঙ্গাইলে অবস্থান করায় আওয়ামী মুসলীম লীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীদের মধ্যেও সক্রিয়তা বেড়ে যায়। জনাব বদিউজ্জামান খান ও সৈয়দ নূরুল হুদার নেতৃত্বে গড়ে উঠে ছাত্র ও যুবকর্মী বাহিনী। শামসুল হক টাঙ্গাইলে এসে অনেক সময় বদিউজ্জামান খানের বাসায় উঠতেন এবং বর্তমানে জাহাঙ্গীর হাসপাতাল যা সে সময় শান্তিকুঞ্জ নামে পরিচিত ছিল তার বিপরীত রাস্তার পূর্বপাশে লাল মিয়াদের বাসায় তরুন নেতৃবৃন্দকে নিয়ে বৈঠক করতেন। ভাষা আন্দোলনের কেন্দ্রীয় দুই নেতা ঢাকার তমুদ্দুন মজলিসের অন্যতম প্রাণপুরুষ গৌরাঙ্গীর শামসুল ইসলাম, চারান গ্রামের ডাঃ মাজহারুল ইসলাম কলকাতা লেডী ব্রাবোর্ন কলেজের প্রাক্তন ছাত্রী ও বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনের ঢাকার কেন্দ্রীয়ভাবে প্রস্তুতি টাঙ্গাইলেও একটি উর্বর ভিত্তি তৈরী করেছিলেন। জনাব শামসুল ইসলাম ও সোফিয়া খানের গ্রামের বাড়ী ছিল ঘাটাইলের গোরাঙ্গী ও দিঘলকান্দী নামক পাশাপাশি দুটি গ্রামে। ভাষা আন্দোলনের মূল পর্ব শুরু হয় রমনা রেসকোর্স ময়দানের জনসভা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে কার্জন হলের ছাত্র সমাবেশে কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ‘উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ’ এই দাম্ভিক উচ্চারণের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের ‘না’ ‘না’ ধ্বনির সুস্পষ্ট উচ্চারণের মধ্যে দিয়ে। ইতিপূর্বে রেসকোর্সে একই বক্তব্য উচ্চারিত হলেও কার্জন হলের প্রতিবাদী কন্ঠস্বর ছিল অনেক বেশী সুসংহত এবং সুস্পষ্ট। কে অথবা কারা এই প্রতিবাদ করেছিলেন এটা নিয়ে দ্বিমত অথবা বহুমত রয়েছে। অনেকেই ব্যক্তি বিশেষকে বড় করার জন্য প্রতিবাদের কৃতিত্ব একেকজনকে দিয়েছেন। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রথম সারির নেতা ও সংগঠকগণ যথা অলি আহাদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, ভাষা সৈনিক মতিন, সুফিয়া খান এদের মতে নির্দ্দিষ্ট কোন ব্যাক্তি নয় উপস্থিত মানুষের পিছন দিক হতে বা মাঝখান থেকে কিছু স্পষ্ট উচ্চারণ ‘না’ ‘না’ ধ্বনি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে হতচকিত করে দিয়েছিল। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর পর পল্টন ময়দানের জনসভায় নাজিম উদ্দিনের রাষ্ট্র ভাষা সর্ম্পকিত একই বক্তব্য বাঙ্গালী জাতি বাংলা ও বাংলা সংস্কৃতির বিরুদ্ধে পাকিস্তান সরকারের সুগভীর চক্রান্তকে সচেতন ছাত্র সমাজ ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সামনে উদ্ঘাটিত করে দিল। তারা বুঝতে পারলেন রাষ্ট্র ভাষা উর্দু ব্যাপারটা কথার কথা নয়। পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মলগ্নের সামান্য আগে হায়দ্রাবাদে উর্দু সম্মেলনে গৃহীত সীদ্ধান্তের চূড়ান্ত এবং বাঙ্গালী জাতির ভাষা, শিল্প-সাহিত্যকে চিরতরে পঙ্গু করে, এই জাতিসত্ত্বার সব অর্জনকে ব্যর্থ করে, পাকিস্তানি সংস্কৃতি ও তাহজির তমুদ্দুনের নামে এক জগাখিচুড়ি মার্কা নতুন সংস্কৃতির জন্ম দেওয়ার চক্রান্ত শুরু হয়েছে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সহ দু’একজন বুদ্ধিজীবি তাদের লেখনীর মাধ্যমে এর বিরুদ্ধে জবাব দিলেন। পাশাপাশি মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে সংগঠিত হলেন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে ঢাকার বার লাইব্রেরী মিলনায়তনে প্রথম সর্বদলীয় প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হলো এবং মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত হলো সর্বদলীয় ভাষা আন্দোলন কমিটি। কিন্তু এই আন্দোলনকে জঙ্গি আন্দোলনে পরিণত করা ছাড়া পাকিস্তানি উর্দু ভাষাপন্থী নেতাদের চক্রান্তকে মোকাবিলা করা সম্ভব ছিলনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল ছাত্রনেতা- কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ এবং সংগঠিত করে বিভিন্ন স্কুল কলেজের ছাত্রদের ভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ত করার মধ্য দিয়ে উনিশ’শ বায়ান্ন সনের একুশে ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী আন্দোলন ও বিক্ষোভ মিছিলের মাধ্যমে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ শ্লোগানে রাজপথ মুখরিত করে জনগনকেও আন্দোলনের সাথে একাত্ব করার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেল। একুশে ফেব্রুয়ারি ছাত্র-জনতার মিছিল গণপরিষদের অধিবেশনে স্মারকলিপি প্রদান করবে এই সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র পাবনার আব্দুল মতিন বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষনার দাবিতে সংগ্রামী ছাত্র সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য প্রচার অভিযান শুরু করলেন। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে তিনি ‘রাষ্ট্রভাষা মতিন’ নামে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। অলি আহাদ, গাজীউল হক, ভাষা মতিন, আব্দুস সামাদ আজাদ, মোহাম্মদ সুলতান প্রমুখ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতাদের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ স্কুল কলেজ ও দেশের সর্বত্র রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলন দানা বেধে উঠল। জেলখানায় বন্দি থেকেও শেখ মুজিবুর রহমান এই আন্দোলনকে বেগবান করার জন্য আহব্বান জানালেন। ভাষা আন্দোলনে মেয়েরাও পিছিয়ে ছিলনা। ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের ছাত্রী নাদিরা চৌধুরী (মুনির চৌধুরীর বোন), সোফিয়া খান(টাঙ্গাইলের মেয়ে), সাফিয়া খাতুন, হালিমা খানম, রওশন আরা বাচ্চু, রোকেয়া ইসলাম প্রমুখ। ছাত্রী নেত্রীরা এগিয়ে এলেন ঢাকার বিভিন্ন স্কুল কলেজের মেয়েদের আন্দোলনে সম্পৃক্ত করার জন্য। ১৯৫২ সনের ২১ শে ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী হরতাল ও বিক্ষাভ মিছিল করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো। টাঙ্গাইলের যুব সমাজ ও ছাত্র ছাত্রীদের ঐ দিনটিতে সংগঠিত করে আন্দোলনে সম্পৃক্ত করার জন্য একুশে ফেব্রুয়ারির তিন চার দিন আগে সোফিয়া খান একদিনের জন্য টাঙ্গাইল চলে আসেন। আইবি’র সতর্ক চোখকে ফাকি দেবার জন্য সবার সাথে বৈঠক না করে তিনি তৎকালীন ছাত্র ও যুবনেতা বদিউজ্জামান খান, সৈয়দ নুরুল হুদা, শামসুদ্দোহা ও নারায়ন বিশ্বাসের সাথে বৈঠক করে একুশে ফেব্রুয়ারির ছাত্র ধর্মঘটকে সফল করার জন্য আলোচনা করেন। এর পর রোকেয়া খান, নাজমি আরা রুবি, হাসিনা খান ঝর্ণা, দরিয়া ইফসুফজাইসহ কুমুদিনি কলেজ ও বিন্দুবাসিনী গার্লস স্কুলের নেতৃস্থানীয় মেয়েদের একুশে ফেব্রুয়ারি বিক্ষোভ মিছিলে ছাত্রীদের অংশ গ্রহন ও তাদের করণীয় কিছু কর্মসূচি বুঝিয়ে দিয়ে ঢাকা চলে গেলেন কেন্দ্রীয় পর্যায়ে দায়িত্ব পালনের জন্য। ঠিক হলো বদিউজ্জামান খান ও সৈয়দ নুরুল হুদা টাঙ্গাইল শহরের ও করটিয়া সা’দত কলেজের ছাত্র নেতাদের নিয়ে কর্মসূচি প্রনয়ন করবেন। এ পর্যায়ে ফজলুর রহমান কায়সার, শামসুর রহমান খান শাজাহান, মির্জা তোফাজ্জল হোসেন মুকুল, আলী আকবর খান, ইসরাইল হোসেন, ফজলুর রহমান ফজলু (প্রিন্স হোটেলের মালিক), আবু সাইদ সহ ছাত্র নেতৃবৃন্দ একুশের বিক্ষোভ মিছিল ও জনগণের মধ্যে ভাষা আন্দোলনের বিষয়বস্তুু প্রচারের দায়িত্ব পালন করলেন। কুমুদিনি কলেজের ছাত্রীনেত্রী খন্দকার রুবী ও হাসিনা খানসহ অন্যান্য মেয়েদের সাথে যোগাযোগ করলেন বদিউজ্জান খান ও সৈয়দ নুরুল হুদা। নেয়া হল একুশে ফেব্রুয়ারির বিক্ষোভ মিছিল বের করার জন্য সর্বাত্বক প্রস্তুতি। আজ থেকে চৌষট্রি বছর আগে সাড়ে সাত কোটি মানুষ অধ্যুষিত পূর্ব পাকিস্তানের পিছিয়ে থাকা রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থা ও পরিবেশে একটি মফস্বল শহরের সরকার বিরোধী এই আন্দোলনে অংশ নেয়া এবং পুলিশ ও আইবি,র নজরদারির মধ্যে কাজ করাটা ছিল খুব ছিল কঠিন। উল্লেখ্য টাঙ্গাইলের কৃতী সন্তান আওয়ামী লীগের সম্পাদক শামসুল হক বর্তমানে জাহাঙ্গীর সেবাশ্রমের পাশের সড়কের পূর্ব দিকে অবস্থিত লাল মিয়াদের বাড়িতে অনেক সময় ছাত্র যুবকদের নিয়ে আলোচনা করে তাদের রাজনীতি সচেতন করে তুলেছিলেন। টাঙ্গাইলের কয়েকজন মেয়েকে নারীর অধিকার ও রাজনীতি সচেতন করে তুলেছিলেন সোফিয়া খান। তিনি টাঙ্গাইলে একটি মহিলা পাঠাগার স্থাপন করেন। একুশে ফেব্রুয়ারি কুমুদিনী কলেজের মেয়েরা নাজমি আরা রুবি, হাসিনা হক ও অন্যান্য ছাত্রী নেত্রীদের নেতৃত্বে মিছিল বের করার জন্য কলেজ গেটে জমায়েত হয়। শ্লোগান ধরে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। কিন্তু কলেজ কর্তৃপক্ষ গেট বন্ধ করে দিয়েছিল। সোফিয়া খানের ছোটবোন বিন্দুবাসিনীর ছাত্রী ঝর্ণা খান স্কুলের গেট বন্ধ থাকায় জানালা দিয়ে বের হয়ে কুমুদিনী কলেজ গেটে এসে দারোয়ানকে বলল আমার মা খুব অসুস্থ। আমার বোন হাসিনা আপা (জ্যোসনা খান) হোস্টেলে আছে, তাকে খবর দিতে হবে। বেশ কিছুক্ষণ ইস্তত করে তার অনুরোধে দারোয়ান গেট খুলে দিতেই বাধ ভাঙ্গা বন্যার মত কলেজ ছাত্রীরা নাজমি আরা রুবী, দরিয়া ইউসুফজাই ও অন্যান্য কয়েকজন ছাত্রীর নেতৃত্বে মিছিল নিয়ে বেরিয়ে এলো। বিন্দুবাসিনী বালিকা বিদ্যালয়ের দিকে এগিয়ে চললো কলেজ ছাত্রীদের মিছিল। স্কুলের ভেতর থেকে গেট বন্ধ। গেটে স্বাস্থবান দারোয়ান হারান দা। নাজমি আরা রুবী ছিল একটু দীর্ঘকায় এবং সাহসী। সে দু’হাত দিয়ে পুরান গেট ধাক্কা দিয়ে একটু উপর করে ধরলো। খুলে গেল বন্ধ দরজা। স্কুলের মেয়েরা ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’ বলে বেরিয়ে এলো দলে দলে। সোফিয়া খানের বোন রোকেয়া খানম ছিলেন হোস্টেল সুপার। তিনি হোস্টেলের মেয়েদের মিছিলে যাওয়ার জন্য সহযোগিতা করেন। স্কুলের মেয়েদের বিশাল মিছিল শ্লোগান দিতে দিতে বেরিয়ে পড়লো রাজপথে। করটিয়া কলেজ ও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মিছিল তখন রাজপথ উচকিত করে শহরের পথ প্রদক্ষিণ করছে। করটিয়া কলেজের মিছিলটি একটু ঘুরপথে গ্রামের মধ্য দিয়ে টাঙ্গাইল এসেছিল। কারণ, শিবনাথ উচ্চ বিদ্যালয়ের একটু আগে পুলিশ বাহিনী অপেক্ষা করছিল মিছিলটিকে প্রতিহত করার জন্য। সৈয়দ নুরুল হুদা ও আরো কয়েকজন ছাত্র নেতার নেতৃত্বে মিছিল শহরের কাছকাছি এসে গ্রামের মধ্য দিয়ে শহরের ছাত্র মিছিলের সাথে মিলিত হলো। করটিয়ার ছাত্র মিছিল এসে পৌছলে ছাত্র-ছাত্রীদের মনে দ্বিগুণ উৎসাহের সঞ্চারণ হলো। তখন ঢাকা টাঙ্গাইলে সরাসরি যাতায়াতের ব্যবস্থা ছিলনা। ময়মনসিংহ পর্যন্ত ট্রেনে এসে তার পর বাসে আসতে হতো। পত্রিকাও আসতো একদিন পর।
তবুও সন্ধ্যার মধ্যেই ঢাকায় ছাত্র মিছিলে গুলিবর্ষণ ও ছাত্র জনতা হত্যার সংবাদ এসে পৌছালো। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন, ঢাকায় পুলিশের গুলিতে নিহতদের তালিকায় আবদুস সালামের নাম ছিল। ঔ সময়ে টাঙ্গাইলের দাপনাজোর নিবাসী আবদুস সালাম নামে একজন ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ছিলেন। তিনি ফজলুল হক হলে থাকতেন এবং ঐ দিন মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন। ভাষা আন্দোলনে গুলিবর্ষণে আবদুস সালাম নামের ছাত্র নিহত হওয়ার পর টাঙ্গাইলে সালামের পরিবারের নিকট খবর আসে সালাম নিহত হয়েছেন। আত্বীয়স্বজন ও পরিচিতদের মাঝে শোকের ছায়া ও কান্নাকাটি শুরু হয়ে গেল। এমনকি যথাসময়ে তার কুলখানি অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। এরপর তিনি যখন স্বশরীরে ফিরে এলেন, তখন জানা গেল শহীদ আবদুস সালাম অন্য এক ব্যক্তি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের আবদুস সালাম এরপর অনেক বছর বেচে ছিলেন এবং পিটিআই’র সুপারিন্টেনডেন্ট হিসেবে অবসর গ্রহন করেন। তিনি কবি মাহমুদ কামাল ও ব্যবসায়ী সমিতির নেতা আবুল কালাম মোস্তফা লাবুর পিতা। ছাত্র জনতার মিছিলে গুলি বর্ষণ এবং কয়েকজন শহীদ হবার সংবাদ পেয়ে টাঙ্গাইলের নেতৃবৃন্দ তৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত নিলেন শহীদদের স্মরণে শহীদ মিনার নির্মাণের। পরদিন ২২শে ফেব্রুয়ারি পুলিশ প্যারেড ময়দানে
(বর্তমানে পৌর উদ্যান) অনুষ্ঠিত হলো প্রতিবাদ সভা। এখানে একটি হাসির ঘটনা ঘটেছিল।
সভা চলাকালীন সময়ে এসডিও’র বাসায় বাজানো হচ্ছিল (বর্তমানে পৌর উদ্যানের পশ্চিম পাশে এডিএম এর বাসা) উর্দু গান। প্রতিবাদ সভার পেছন থেকে দু’একজন বলে উঠল গান বন্ধ করো। সভায় উপস্থিত কেউ কেউ মনে করল পুলিশ বন্দুক (গান) তাক করেছে।
কয়েকজন দুর্বল চিত্তের মানুষ গুলি চলবে মনে করে দৌড় দিল, তাদের দেখাদেখি আরো অনেকেই দৌড় দেয়। দু’এক মিনিটের মধ্যে ভুল ভেঙ্গে গেলে সবাই হাসা হাসি করে সভার কাজ শুরু করল। এবার শহীদ মিনার তৈরির পালা।
বর্তমান শহীদ মিনারের পাশে পাবলিক লাইব্রেরীর স্থানে তখন ছিল একতালা দালান নামে রমেশ হল। রমেশ হলের দক্ষিণ পশ্চিম কোণে কবরের আদলে একটি মিনার তৈরির পরিকল্পনা করা হলো। মহর রাজ নামে একজন দক্ষ রাজমিস্ত্রীকে ঠিক করলেন তৎকালীন জননেতা জনাব খোদা বখ্শ মোক্তার সাহেব। বিন্দুবাসিনী স্কুলের পাকা ভবন তৈরীর জন্য মাঠের প্রান্তে ইট ও বালু স্তুুপ করে রাখা ছিল। সিমেন্টও জোগাড় হয়ে গেল। শহীদ মিনার স্থাপনের প্রাথমিক পরিকল্পনা ও বিভিন্ন প্রস্তুতি, ভিত্তিস্থাপনসহ অন্যান্য কাজে রমেশ হলের বারান্দায় প্রায় একটি নির্ঘুম রাত কাটালেন শামসুর রহমান খান শাজাহান, ফজলুর রহমান কায়সার, বদিউজ্জামান যাদু, মন্টু তালুকদার, মির্জা তোফাজ্জল হোসেন মুকুল, আবু সাঈদ সহ তরুণ নেতা কর্মী। বদিউজ্জামান খান, শামসুজ্জোহা, সৈয়দ নুরুল হুদা মাঝে মাঝে এসে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিচ্ছিলেন। শহীদ মিনার নির্মাণ প্রায় সমাপ্ত হলো। কিছু ইট এবং বালু শেষ হয়ে গেলে বিন্দুবাসিনী স্কুলের দক্ষিণ-পূর্বকোণের ইদারার কাছ থেকে ইট বহন করে নিয়ে এসেছিল তিন কিশোর নুরুজ্জামান খান, বুলবুল খান মাহবুব ও অরবিন্দ চন্দ। সন্তোষের পরিত্যক্ত রাজবাড়ী থেকে আনা একখন্ড শ্বেত পাথর খোদাই করে সাইনবোর্ড লেখক ঋষিকেশ পোদ্দার লিখলো “ভাষা আন্দোলনে মুসলিম লীগ সরকারের গুলিতে নিহত শহীদরে স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ”। পঞ্চম, ষাট ও সত্তর দশকের দিকে বহু বছর ঐ প্রথম শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হতো। খুব ভোরে গান গেয়ে প্রভাত ফেরীর পর শহীদ মিনারে এসে ফুল দিয়ে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য ও শপথ গ্রহনের মাধ্যমে শহীদদের আত্বার প্রতি শদ্ধা জানানো হতো। পুলিশ ও আইবি’র কড়া নজরদারির মধ্যে স্কুল কলেজের কিছু সচেতন ছাত্র-ছাত্রী, রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও প্রগতিশীল সচেতন মানুষ একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করতো। আজ মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশে রাত বারোটা এক মিনিটে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে শহীদ মিনারে পুষ্পাঞ্জলি প্রদান, আলোকিত মিনার প্রাঙ্গণে হাজার হাজার মানুষের ঢল; আনুষ্ঠানিকতা সর্বস্ব নির্ভয় আয়োজনের যুগে মনে পড়ে সেই প্রতিরোধের একুশে ফেব্রুয়ারি পালনের দিনগুলির কথা।
(লেখকঃ কবি,মুক্তিযোদ্ধা ও ভাষা আন্দোলনের প্রত্যক্ষদর্শী)