সুলতানা রুবির – প্রভাত ফেরি

 

প্রভাত ফেরি

————————- সুলতানা রুবী

 

তিথি আর জাহিদকে ঘরে ঢুুকতে দেখেই এগিয়ে এস প্রশ্ন করলেন জাহিদের মা ও বৌমা, এত সকালে রাইত পোহানের আগেই তোমরা কই গেছিলা? আজ একুশে ফেব্রুয়ারী না? প্রভাত ফেরীতে গিয়েছিলাম মা।
প্রভাত ফেরি আবার কি মা? বলতে বলতে বিছানার উপর উঠে বসেন আমেনা বেগম।
শাশুড়ীর মুখে এমন প্রশ্ন শুনে তিথির টনক নড়ে। কি ব্যাপার মা তাহলে একুশে ফেব্রুয়ারী সম্পর্কে কিছু জানে না? তা কি করে হয়? উনার বয়স কত? বয়স যাই হোক, স্বাধীনতা যুদ্ধতো অবশ্য দেখেছেন, তা হলে? আমাদের দেশে এমন মানুষ কি এখনও আছে যারা একুশে ফেব্রুয়ারী সর্ম্পকে জানে না?

শহিদ মিনারে পড়ে যাওয়া শাড়িটা খুলতে গিয়ে ফিরে এস বসে শাশুড়ির পাশে। মা আপনি একুশে ফেব্রুয়ারি কি তা জানেন না?
না। খুব সহজ সাবলিল উত্তর দেন জাহিদের মা।
কেন মা আপনি মুক্তিযুদ্ধ দেখেননি?
দেখছি তো। যুদ্ধের সময় মেলেটারীরা ঐ যে পাক বাহিনীরা আমাগো দেশে আইসা কত মানুষ মারল, কত ঘর বাড়ি পুড়াইয়া দিল। উত্তর পাড়ার নছু ভাইর পোলা যুদ্ধে গেছিল। তাই শুইনা মেলেটারীরা তারে ধইরা নিয়া গেল আর ফিরা আইলা না। জান মা, ওরা এই খবর জানত না। মধ্যের পাড়ার জমির মুন্সি রেজাকারে গেছিল ঐ হারামজাদা জমিরই মেলেটারীগো খবর দিয়া ধরাইয়া দিছিল। আহারে নছু ভাই কি ভাল মানুষই না আছিল!
আমার জাহিদ পেটে। তোমার শশুর, আমার শশুর আমারে নিয়া খুব ডরাইত। আমাগো পাড়ার নূরুর বোইনেরে ধইরা নিয়া গেছিল, দেশ স্বাধীনের পরে যহন তারে ছাইড়া দিল গেরামের মানুষ তারে আর ঘরে নিবার দিল না। পরে আর কি করব। কয়দিন কাইন্দা কাইটা এই দিক ঐদিক ঘুইরা শেষে বেচারি ফাঁসি দিয়া মরল। সেই কথা কি ভুলন যায় ..। কি যে দিন গেছে মা তোমারে কি কমু . .। দীর্ঘ শ্বাস ফেলেন আমেনা বেগম।
তিথি এতক্ষণ নিরব শ্রোতা হয়ে তার শাশুড়ির কথাগুলি খুব মনযোগ দিয়ে শুনছিল এবং অবাক হয়ে দেখছিল তার শাশুড়ির স্মৃতি চারন।
থাক মা আমার কথা, তুমি যেন আমারে কি কইতেছিলা সেই কথা কও, ঐ কি ভাত জানি.. ..
হেসে ফেলে তীথি, কি ভাত না মা, প্রভাত ফেরি।
ঐ তো হইলো পর ভাত ফারি। অত কঠিন কথা বুঝিনা মা।
হল না মা, ঠিক করে বলতে হবে।
আইছা।
আইছা না, বলেন ‘আচ্ছা’।
ঠিক আছে কমুনে।
সত্যি আপনি একুশে ফেব্রুয়ারী কি তা জানেন না মা? তিথি তার শাশুড়ি গলা জড়িয়ে ধরে বসে।
না মা জানি না তো!
তাহলে তো আপনার এ দেশে থাকার ভিসা ক্যন্সেল করা উচিত।
বিসা আবার কি? তুমি আমার লগে খালি রসিকতা কর, কঠিন কথা কও। তুমি তো জানই আমরা গাও গেরামের আন্ধা মানুষ অত কিছু বুঝি না।

এটা সত্যি তিথীর শাশুড়ি খুব সহজ সরল, হাসি খুশি, সুন্দর তুল তুলে ছোটমোট একটা মানুষ। যাকে দেখলে এখনও কোলে নিতে ইচ্ছে করে। জাহিদ কথায় কথায় মাকে কোলে তুলে নেয় এবং বলে তুমি যে ছোট বেলা আমাকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছ তার ঋণ কিছুটা হলেও শোধ করে দিলাম।
মাও ছেলের কথা শুনে হাসে এবং মজা করে। মায়ের মনের মত বউ তিথী। সেও মজা করতে বসে যায় সময় অসময়, কথায় কথায়।
এই বয়সেও আমেনা বেগমের যে কোন বিষয় শিখার এবং জানার খুব আগ্রহ। শাশুড়ির এই বিষয়টা তিথির খুব ভাল লাগে।
ওমা কও না রাইত পোহানের আগেই তোমরা কই গেছিলা?
পাশের ঘর থেকে জাহিদ গেঞ্জি গলায় ঢুকাতে ঢুকাতে এসে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বসে
ওমা, মা, মাগো তুমি একুশে ফেব্রুয়ারী বুঝ না?
মাগো, মা, ওমা। ‘মা’.. তুমি মা বুঝ না?
যা তো আল্লাাদ করিস না! সব সময় ইয়ারকি।
সত্যি কইতাছি মা। তুমি ‘মা’ কারে কয় বুঝনা?
বুঝুম না কেন, এই যে আমি তোর মা।
হ্যাঁ মা ঠিক বলেছেন। আপনি যেমন জাহিদের মা তেমনি এই দেশটা আমাদের সকলের মা।
যাও তোমরা আবারও আমার লগে ইয়াকি কর। দেশ আবার ‘মা’ হয়?
না মা ইয়ারকি নয় এটাই সত্যি। এই দেশটা আমাদের সকলের মা।
নাও এবার ভাল করে মাষ্টারী কর! আমি ভাই চা খাব, বলে জাহিদ উঠে চলে যায়।
তিথি একটু সমস্যায় পরে যায় কি ভাবে বুঝাবে মাকে, তাই একটু এরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। মা চলেন নাস্তা করি?
না মা এক দিন দেরিতে খাইলে কিছু হয় না। তুমি আমারে আগে বুঝাও।
এরই মধ্যে জাহিদ দুই হাতে দুই কাপ চা নিয়ে এসে আবারও উঠে বসে মায়ের বিছানায়। তিথির হাতে এক কাপ চা তুলে দিয়ে নিজের কাপে একটা লম্বা চুমুক দেয়। কিছুটা সময় সবাই নিরব। কি যেন চিন্তা করে জাহিদ মায়ের মুখের দিকে চেয়ে থাকে। কত বয়স তার মায়ের? ভাষা আন্দোলন দেখেনি ঠিক আছে, কিন্তু একুশে ফেব্রুয়ারী? আমাদের মত শিক্ষিত সন্তানের বাবা মারা একুশ জানে না, ভাষা আন্দোলন জানে না এটা সত্যি লজ্জা জনক ব্যাপার। এ দেশের ঘরে কি আরও এমন মা আছে যারা সত্যি আমার মায়ের মত ভাষা আন্দোলন সর্ম্পকে কিছুই জানে না? তা হলে তো সত্যি লজ্জার কথা, বিরাট ব্যর্থতার কথাও। শুধু আমার জন্য কেন এটাতো তাহলে জাতির জন্যও লজ্জা। না মাকে বুঝাতে হবে।
সবাই কে নিরব থাকতে দেখে আমেনা বেগম তিথিকে উদ্দেশ্য করে বলেন কি মা আমারে বুঝাবা না আজকা কি দিন?
জাহিদ কিছু বলার আগেই তিথি মাকে প্রশ্ন করে এদেশে কেন যুদ্ধ হয়ে ছিল তা কি আপনি জানেন?
না মা খালি জানি আগে নাকি এই দেশ পাকিস্তানীরা চালাইত, তাড়াই নাকি মালিক আছিল। আর হেগো খ্যাদাবার লিগা এই দেশে যুদ্ধ হইছে।
আপনার কথা ঠিক আছে। তবে শুধু তাই নয়, আরও অনেক কারন আছে। এই যে আজ একুশে ফেব্রুয়ারী মাতৃ ভাষা দিবস। এই গন্ডগোলটাই আগে শুরু হয়েছিল। পাকিস্তানিরা যখন এই দেশ শাসন করত তখন ওরা চাইলো এ দেশের ভাষা হবে ঊর্দু। আমরা কথা বলি বাংলায় কিন্তু ওরা তা বলতে দিবে না। জোর করেই আমাদের দিয়ে ঊর্দু ভাষায় কথা বলাবে। মা কে মা বলা যাবেনা তাই কি হয়?
তিথি এক মনে কথা গুলি বলেই চলে। হঠাৎ মা প্রশ্ন করে মায়েরে মা ডাকবো নাতো কি ডাকবো? মায়ের আবার অন্য নাম আছে নাকি যে তাই ডাকবো?
এবার জাহিদ মায়ে গলা জড়িয়ে ধরে রশিকতা করে আছে মাম্মী জি, আছে।
ও! বুঝবার পারছি যেমুন ইংরাজি মা তাইনা বৌ মা?
মায়ের কথা শুনে জাহিদ তিথি হো হো করে হেসে উঠে।
হাইস না তারপরে কি হইলো তাই কও শুনতে ভালই লাগতাছে।
ঐ যে ঢাকা ইউনিভার্সিটি যেখানে আপনার ছেলে পড়েছে, তার পর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল সেই খানকার সব ছাত্ররা, এদেশের শিক্ষিত মানুষ, ছাত্র, জনতা সবাই মিছিল করল রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই, আমাদের দাবী মানতে হবে। আরও অনেক কিছু বলে তারা মিছিল করল আর সেই মিছিলে পাকিস্তানিরা গুলি চালাল। মারা গেল রফিক, সফিক, জব্বার, বরকত আরও নাম না জানা অনেক ছাত্র জনতা। কারও ঠিকানা পাওয়া গেল কারও পাওয়া গেল না । ভার্সিসিটিতে পড়তে আসা অনেক মায়ের বুকের ধন কে এই ভাষার জন্য জীবন দিতে হল। রক্তে লাল হল রাজপথ। তাদের এই অবদানের কথা কি ভুলা যায়, নাকি ভুলা উচিত? কথা গুলি বলতে বলতে তিথির কন্ঠ আস্তে আস্তে ভারি হয়ে এল। ঘরের মধ্যেও কেমন থমথমে ভাব বিরাজ করছে। হঠাৎ তিথির মনে হল কথা গুলি হয়ত মা বুঝতে পারছে না তাই আরও সহজ করে বুঝাবার চেষ্টা করল।
আচ্ছা মা ধরেন, আপনার জমি, আপনার ঘর বাড়ি অন্য একজন জোর দখল করে যা ইচ্ছা তাই করতে চায়, আপনাকে তার মত করে চালাতে চায় আপনি কি চলবেন?
না.. মোটেও না। খুব জোড় গলায় কথা গুলি বলেন আমেনা বেগম। ভাই ভাই আলদা হইয়া গেলেই একজন আর একজনের মাতাব্বুরি সহ্য করেনা তার আবার আরেক দেশের মানুষ!
হারামজাদা গো কপালে ঝাড়ুর বারি দিয়া দৌড়ান দরকার আছিল।
দেখেছেন মা,এই টুকুতেই আপনি কত রেগে গেলেন। অথচ এ দেশেরর মানুষ সারা জীবনই পরাধীন ছিল, একবার বৃটিশদের কাছে আবার পাকিস্তানীদের কাছে। অনেক অত্যাচার সহ্য করেছে এ দেশের মানুষ। সব সময় ওরা আমাদের ছোট করে রেখেছে। ভাল একটা চাকরী দেয়নি, কোন সুযোগ সুবিধা ভোগ করতে দেয়নি, ভাল মন্দ বুঝার সুযোগ পর্যন্ত দেয়নি।
তারপর যখন এ দেশের মানুষ বুঝতে পারল, নিজেদের অধীকার আদায় করতে চাইল তখনই যুদ্ধ হল।
আর এই যুদ্ধের শুরুটা ভাষা নিয়ে। “ বাংলা ভাষা।” আজকের এই দিনে যারা আমাদের জন্য এত বড় ত্যাগ স্বীকার করল, নিজের জীবন দিয়ে দিল তাদের আমরা স্বরন করব না?
হ: অবশ্যই করবা। করতেই হইবো। নয়লেতো বেইমান হইয়া গেলাম।
এই জন্যই তো আজ এত সকালে তাদের শ্রোদ্ধা জানাতে শহিদ মিনারে গিয়েছিলাম।
তুই চুপ কর ! জাহিদের কথায় ধমক দিয়ে উঠেন আমেনা বেগম। এত দিনতো তুই আমারে কিছুই বুঝাস নাই। বৌমা আমারে না কইলে কোন দিন আমি এই সব কথা জানতামই না। তুমি কও মা, আমি তোমার কাছ থিকা সব শুনুম।
হ্যাঁ মা এই যে সকাল বেলা ফুল নিয়ে খালি পায়ে তাদের ভালবাসা জানাতে গেলাম, তাদের স্বরন করলাম এটাই প্রভাত ফেরি। হাজার হাজার মানুষ আজ তাদের স্বরনে শহিদ মিনারে ফুল দিতে গিয়েছে। টেলিভিশনেও দেখাচ্ছে।
শহিদ মিনার কোন খানে মা? আমারে একবার নিয়া যাইও, আমিও ফুল দিতে যামু। আহারে আমার বুকটার মধ্যে কেমুন করতাছে। তবে জান কি মা? খালি আমি না, আমাগো গেরামের কেউ এই সব কথা জানে না। তুমি এর পরে যহন বাড়ি যাইবা সেই সময় উঠানে পাটি বিছাইয়া গেরামের মানুষ গুলারে ডাইকা আনুম। আর তুমি এই সব কথা সবাইরে বুঝাইয়া কবা। সব মানুষের এই সব কথা জানা দরকার।
শাশুড়ীর জানার আগ্রহ দেখে তিথির খুব ভাল লাগে।
আচ্ছা মা বলব। তবে আরও একটা মজার কাহিনী আছে। জাহিদ কি সেটা জান?
কোনটা?
যারা ভাষা নিয়ে আমাদের সাথে এত লড়াই করল সেই পাকিস্তানেরই কোন জাতীয় ভাষা নেই।
তাই না কি? জানতাম না তো!
হ্যাঁ ওরা একেক আঞ্চল একেক ভাষায় কথা বলে। এখন পর্যন্ত ওরা ওদের জাতিয় ভাষাই ঠিক করতে পারে নাই।
তাইলে কইলাম বৌমা ওগো ভিসাও ক্যান্সেল কইরা দিও।
জাহিদ আর তিথি মায়ের কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠে.. ..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!