আজ প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ’র ৩৯তম মৃত্যুবার্ষিকী
সম্পাদকীয় ডেস্ক । কাগজটোয়েন্টিফোরবিডিডটকম
সাবেক এমএনএ, উপমহাদেশের প্রথম মুসলিম প্রিন্সিপাল, শিক্ষাগুরু, সাহিত্যিক ও সমাজ সংস্কারক, শিক্ষার মানোন্নয়নের পুরোধা ব্যক্তিত্ব, বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত ও একুশে পদক বিজয়ী সাহিত্যিক প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁর ৩৯তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ ২৯ মার্চ, ২০১৭ খ্রিঃ।
ইবরাহীম খাঁ টাঙ্গাইল জেলার তৎকালীন ভুঞাপুর থানার অন্তর্গত বিরামদী (শাবাজনগর) গ্রামে ২ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৪ খ্রিঃ এক মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম শাবাজ খাঁ ও মায়ের নাম রতন খানম।
সাহিত্যিক প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁ প্রথম মুসলমান ছাত্র যিনি ‘পিংনা উচ্চ বিদ্যালয়’ থেকে ১৯১২ সালে এন্ট্রাস (এস.এস.সি) পাশ করেন। ১৯১৪ সালে আনন্দ মোহন কলেজ থেকে এফএ এবং ১৯১৬ সালে কলকাতার সেন্ট পলস সিএম কলেজ থেকে ইংরেজিতে অনার্সসহ বিএ পাস করেন। ১৯১৮ সালে তিনি আইন বিষয়েও ডিগ্রি লাভ করেন। পরে তিনি প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯১৯ সালে ইংরেজি সাহিত্যে এম.এ পাস করেন।
তিনি টাঙ্গাইলের করটিয়া এইচএম ইনস্টিটিউশনে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি কয়েক বছর ময়মনসিংহ শহরে ওকালতি পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। তিনি সরকারি সা’দত কলেজের প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল, ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের প্রতিষ্ঠাকালীন প্রেসিডেন্ট, বাংলা একাডেমির অন্যতম উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা, ঢাকার মিরপুরে সরকারি বাঙলা কলেজের প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারি, টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর ইবরাহীম খাঁ সরকারি কলেজের প্রতিষ্ঠাতা এবং আজকের আধুনিক ভূঞাপুর উপজেলার স্বপ্নদ্রষ্টা ও রূপকার। ধানমণ্ডির কাকলি স্কুল অ্যান্ড কলেজ তাঁর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তিনি তৎকালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য ছিলেন।
অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনে (১৯২০-১৯২২) সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে ইব্রাহীম খাঁ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। পরবর্তীকালে তিনি একাধিকবার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৪৬ সালে তিনি বঙ্গীয় আইন সভার সদস্য এবং ১৯৫৩ সালে গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। বিভিন্ন সময়ে তিনি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সভা-সম্মেলনে যোগদান করেন। এ উপলক্ষে তিনি তুরস্ক, মিশর, লেবানন, সৌদি আরব, সিরিয়া, ইরান, চীন ইত্যাদি দেশ পরিভ্রমণ করেন।
একজন নিষ্ঠাবান মুসলিম হিসাবে ইসলামের মধ্যেই মুসলমানদের সকল সমস্যার সমাধান সম্ভব বলে তিনি গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন এবং এ লক্ষ্যে সারা জীবন কাজ করেছেন। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনার উল্লেখ করা যায়। তৎকালিন ভারতের বিশিষ্ট কমিউনিস্ট নেতা কমরেড মুজাফফর আহমদ তাঁকে একবার জার্মানি ও রাশিয়ায় পাঠানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন সাংবাদিকতা ও কমিউনিজম অধ্যয়নের জন্য। তিনি সবিনয়ে এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন- ‘‘বলশেভিকরা শোষক আর জালিমের সঙ্গে আল্লাহকে আক্রমণ করেছে, ধার্মিক বলে আমার কোনো দাবি নেই, নেই অহঙ্কার কিন্তু আমি বিশ্বাস করি আল্লাহর পথই ব্যথিত দরিদ্র মানুষের মুক্তির পথ। কাজেই আল্লাহহীন পথ আমার পথ নয়।’’
মুসলিমদের মনে আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত করার জন্য তিনি ইতিহাস, সমকালীন জীবন নিয়ে, ইসলামের গৌরবময় অধ্যায় নিয়ে লিখেছেন- এটাকেই তিনি তপস্যা বলেছেন। ব্রিটিশ ভারতে নিগৃহীত পণ্ডিতদেরকে তিনি তার কলেজে সুযোগ দিতেন- এমনকি অন্যত্র বহিষ্কৃত ছাত্ররাও তার আশ্রয়ে পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছে। তিনি তার নিজের বিশ্বাসে দৃঢ় ছিলেন, কিন্তু অন্যের মতবাদকে বিন্দুমাত্র অশ্রদ্ধা করতেন না। উদার মানবতাবাদী ইব্রাহীম খাঁ’র সাহিত্যচর্চার প্রধান উৎসই শিক্ষা এবং সংস্কার- তিনি মূলত সংস্কারকই।
ইবরাহীম খাঁ স্মৃতিকথা, শিক্ষা-সাহিত্য-ধর্ম বিষয়ক প্রবন্ধ, নাটক, ভ্রমণ কাহিনী, রসরচনা, গল্প, উপন্যাস, ইতিহাস ও জীবনচরিত, শিশু সাহিত্য, পাঠ্য বই ও অনুবাদ মিলিয়ে শতাধিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। অনেক দায়িত্বপূর্ণ পদে কর্মব্যস্ত থেকেও নিরলসভাবে তিনি বিশাল সাহিত্য ভান্ডার রচনা করেছেন। সাহিত্যের সকল শাখায়ই তিনি স্বচ্ছন্দে সফলতার সঙ্গে পদচারণা করেছেন। মুসলমান সমাজের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনের পুনর্জাগরণের প্রয়াস তাঁর লেখনীতে প্রকাশ পেয়েছে।
বহুবিধ কাজের মধ্যে ইব্রাহীম খাঁর প্রধান পরিচয় হলো লেখক হিসাবে। এক্ষেত্রেও তাঁর অবদান বিচিত্র ও বিশাল। তিনি একাধারে প্রবন্ধ, নাটক, ছোটগল্প, উপন্যাস, ভ্রমণ কাহিনী, স্মৃতিকথা ও শিশুতোষ গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের তালিকা নিম্নরূপ- নাটকঃ কামাল পাশা (১৩৩৪), আনোয়ার পাশা (১৩৩৭), ঋণ পরিশোধ (১৯৫৫), ভিস্তি বাদশা (১৯৫৭), কাফেলা। উপন্যাস : বৌ বেগম (১৯৫৮)। গল্পগ্রন্থ : আলু বোখরা (১৯৬০), উস্তাদ (১৯৬৭), দাদুর আসর (১৯৭১), মানুষ, হিরকহার। স্মৃতিকথা : বাতায়ন (১৩৭৪)। ভ্রমণ কাহিনী : ইস্তাম্বুল যাত্রীর পত্র (১৯৫৪), নয়া চীনে এক চক্কর, পাকিস্তানের পথে-ঘাটে। শিশু সাহিত্য : ব্যাঘ্র মামা (১৯৫১), শিয়াল পন্ডিত (১৯৫২), নিজাম ডাকাত (১৯৫০), বেদুঈনদের দেশে (১৯৫৬), ইতিহাসের আগের মানুষ (১৯৬১), গল্পে ফজলুল হক (১৯৭৭), ছোটদের মহানবী, ছেলেদের শাহনামা, ছোটদের নজরুল, গুলবাগিচা, নবী জীবনের ঝান্ডা বহিল যারা, তুর্কী উপকথা, নীল হরিণ, সোহরাব রোস্তম। ধর্ম বিষয়ক গ্রন্থ : মহানবী মুহাম্মদ, ইসলাম সোপান, ছোটদের মিলাদুন্নবী। শিক্ষা বিষয়ক গ্রন্থ : আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা, সংস্কৃতির মর্মকথা, ইসলামের মর্মকথা, নীতিকাহিনী ইত্যাদি।
ইব্রাহীম খাঁর রচিত গ্রন্থের সংখ্যা মোট ১১৮টি। এর মধ্যে ১৮টি অনুবাদ গ্রন্থ, ইংরাজিতে লেখা গ্রন্থের সংখ্যা ১২ এবং বাংলা ভাষায় রচিত মৌলিক গ্রন্থের সংখ্যা মোট ৮৮টি। ইংরাজিতে লেখা তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘এনেকডোটস ফ্রম ইসলাম’ একটি মূল্যবান গ্রন্থ। এটি পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
ইব্রাহীম খাঁ তাঁর অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ বিভিন্ন সময় নানা খেতাব ও পুরস্কার পেয়েছেন। বৃটিশ সরকার তাঁকে প্রথমে ‘খান সাহেব’ ও পরে ‘খান বাহাদুর’ উপাধি প্রদান করে। খান সাহেব উপাধি তিনি সঙ্গে সঙ্গেই প্রত্যাখ্যান করেন এবং খান বাহাদুর খেতাব তিনি পরবর্তীতে বৃটিশ সরকারের মুসলিম-বিরোধী মনোভাবের প্রতিবাদে প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৬৩ সনে পাকিস্তান সরকার তাঁকে ‘তঘমা-এ-কায়দে আযম’ খেতাব প্রদান করেন। ১৯৭১ সনে পাক বাহিনীর নৃশংসতার প্রতিবাদে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৭৩ সনে তিনি নাটকে বাংলা একাডেমী পুরস্কার ও ১৯৭৬ সনে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ‘একুশে পদক’ লাভ করেন। ১৯৭৭ সনে তিনি ভুয়াপুর ‘সাহিত্য সংসদ’ গঠন করে একুশে পদকের সব অর্থ ও কিছু জমি উক্ত সাহিত্য সংসদে দান করেন। মুসলিম নবজাগরণ, শিক্ষা-সাহিত্য ও সমাজকল্যাণে কৃতিত্বপূর্ণ অবদান রেখে এ মহান ব্যক্তি ১৯৭৮ সনের ২৯ মার্চ ইন্তিকাল করেন।
তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো ‘জহুর ধোপা’ (প্রবন্ধ), ‘নছর প্যায়দা’ (প্রবন্ধ), ‘ইস্তাম্বুল যাত্রীর পত্র’ (ভ্রমণকাহিনী), ‘সোনার তরফে লেখা নাম’ (প্রবন্ধ), ‘ইসলামের মর্মকথা’ (প্রবন্ধ), ‘বউবেগম’ (উপন্যাস), ‘বাতায়ন’ (স্মৃতিকথা), ‘কাফেলা’ (নাটক), ‘রসূলের দেশে’ (ভ্রমণ সাহিত্য) ইত্যাদি।
তথ্যসূত্র-বাংলাপিডিয়া, উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
সম্পাদনায়- মাহবুব এইচ শাহীন/প্রকাশক ও সম্পাদক/কাগজ২৪