মানবতা মুক্তির দিশারী আম্বেদকরের জন্মদিন ও নববর্ষের প্রত্যাশা
মানবতা মুক্তির দিশারী আম্বেদকরের জন্মদিন ও নববর্ষের প্রত্যাশা
লেখক: শিপন রবিদাস প্রাণকৃষ্ণ
মহাসচিব, বাংলাদেশ রবিদাস ফোরাম (বিআরএফ), কেন্দ্রীয় কমিটি।
বাংলা নববর্ষের প্রথমদিন (পহেলা বৈশাখ) আজ। পাশাপাশি মহান ব্যক্তিত্ব বাবাসাহেব ড. ভীমরাও রামজী আম্বেদকরের জন্মদিন। তৎকালীন অছ্যুৎ পরিবারে পিতা রামজী মালোজী শকপাল ও মাতা ভীমাবাঈ-এর ১৪ সন্তানের সর্বকনিষ্ঠ সন্তান ছিলেন আম্বেদকর। পারিবারিক নাম ভীমরাও। যদিও চৌদ্দজন ভাই বোনের মধ্যে ৫ জন বেঁচে ছিলেন, ৩ ভাই ২ বোন। বলরাম, আনন্দরাও, মঞ্জুলা, তুলসী ও সর্বশেষ ভীমরাও। পৈতৃক বাড়ী ছিল তৎকালীন বোম্বাই প্রদেশের রত্নগিরি জেলার আম্বেদাবাদ গ্রামে। পিতা রামজী শকলাল মধ্যপ্রদেশের ‘মোউ’ সেনানিবাসে চাকুরিকালীন সময়ে ১৮৯১ সালের ১৪ এপ্রিল আম্বেদকরের জন্ম। পুত্রের নাম রাখা হলো ভীমরাও শকপাল। আম্বেদকর হলো পার্শ্ববর্তী এক গাঁয়ের নাম। স্কুলজীবনে প্রবেশের পর এক ব্রাহ্মণ শিক কৌতুহলবশত শকপালের স্থলে ভীমরাও এর সাথে জুড়ে দেন আম্বেদকর শব্দটি। সেই থেকে ভীমরাও শকপাল হয়ে গেলো ভীমরাও আম্বেদকর। তাঁর পূর্বপুরুষদের অনেকেই ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর সৈনিক ছিলেন। তাঁর পিতামহ মালোজী শকপালও সৈনিক ছিলেন। থানা জেলার অন্তর্গত মুরবাদ গ্রামের মুরবাদকর পরিবারের তাঁর মাতামহরাও ছিলেন সামরিক বাহিনীর সুবেদার-মেজর।
যারা অস্পৃশ্যতার শিকার তাদের জন্য সবচেয়ে কষ্টদায়ক তথ্য হল তাঁদের সমাজ থেকে কেউ সুযোগ্য হয়ে গড়ে উঠলে ও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা পর্যন্ত এ অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে ব্যর্থ হয়। আদিবাসী ও দলিত সমাজের সেইসব যোগ্য মানুষগুলো পর্যন্ত সমাজে আদৌ পুরোপুরি গ্রহনযোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। তেমনি একজন মহান ব্যক্তিত্ব বাবাসাহেব ড. ভীমরাও রামজী আম্বেদকর। তিনি ভারতের আইনমন্ত্রী ছিলেন এবং নিম্নবর্গের মানুষের অবিসংবাদিত নেতা। তৎকালনি সমাজের তথাকথিত নিম্নবর্ণের বা অস্পৃশ্য পরিবারে জন্ম নেয়ার কারণে তাকে যে পরিমান বৈষম্য ও অবজ্ঞার শিকার হতে হয়েছে তা যেকোন মানুষের কল্পনা-শক্তিকে হার মানায়। স্কুলে পড়ার সময় অন্যান্য ছেলেদের সঙ্গে একই বেঞ্চিতে বসতে দেওয়া হতো না তাকে। তার খাতা শিক্ষকেরা হাত দিয়ে ও ছুতেন না, দূর থেকে দেখতেন। তাকে বসতে দেওয়া হতো বেঞ্চি গুলো থেকে দূরে বাড়ী থেকে নিয়ে যাওয়া ছেঁড়া মাদুরে। এমন কি তেষ্টায় জলও ছুঁতে পারতেন না, কাউকে চাইতেও পারবেন না। রীতি হল হাঁ করে উপরের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। কেউ সহানুভূতির সঙ্গে উপর থেকে মুখে জল ঢেলে দিলে তবে জল খেতে পারে। স্কুলজীবন শেষে কলেজজীবনেও তাকে যেমন জল পাত্র বা উচ্চবর্ণের জলাশয়ের পাশেও যেতে দেওয়া হত না। তেমনি তাকে সংস্কৃত পড়তে দেয়া হয়নি। বিদ্যালয় গ্রন্থাগারে ঢুকতে দেয়া হত না। বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে পারলেও চা জল খাবার বা রেষ্টুরেন্টে যাবার সুযোগও ছিল না। সর্বত্র তাকে একঘরে থাকতে হতো। তিনি জন্মছিলেন মধ্য প্রদেশের ( বোম্বে প্রভিন্স) নিম্নবর্ণের চর্মকার “মহার” সম্প্রদায়ে। তার প্রতি এত অবজ্ঞা অবহেলা মূলত চর্মকার পরিবারে জম্মগ্রহণ করারই প্রায়শ্চিত্ত। আর এ কারণেই ঘোড়ার গাড়ীতে চড়ায় গাড়োয়ান তাকে নামিয়ে দিয়েছিল এবং গাড়ীকে অপবিত্র করায় গালি গালাজ করেছিল। স্থানীয় এক পুকুরে তাঁকে স্নান করতে দেওয়া হতো না সেটা অপবিত্র হয়ে যাবে বলে। মাহারদের সেই সময় ঘন্টা বাজিয়ে রাস্তায় চলতে হতো। যাতে উচ্চবর্ণের হিন্দুরা অপবিত্র হওয়ার থেকে বাঁচতে পূর্বাহ্নে দূরে সরে যেতে পারে। তথাকথিত অচ্ছ্যুত জাতিতে জন্মের পর এত সামাজিক বৈষ্যম্যের শিকার হওয়া সত্বেও আম্বেদকর নানা দিক থেকে গৌরবের চরম শিথরে আরোহন করেছিলেন। অর্জন করেন বিশ্বের শ্রেষ্ট সব ডিগ্রী। বৃত্তি নিয়ে তিনি আমেরিকা যান। লন্ডন ও বার্লিন যান ১৯১৫ সালে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এম এ ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে পি এইচ ডি, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় এম এস সি, ডি এস সি এবং বার এটাল, কলম্বিয়া থেকে এলএলডি পান। ভারতের সংবিধান রচনার বিশেষ কৃতিত্বের জন্য, হায়দ্রাবাদের ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে দেয় তার বিদ্যাক্ষেত্রে সামগ্রিক আবদানের জন্য ডি লিট। যার মধ্য বাণিজ্য শাস্ত্র, দর্শন, ভারতবিদ্যা, অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি সবই আছে। তার এই অগাধ পান্ডিত্যের জন্য তৎকালীন বিশ্ববিখ্যাত সাংবাদিক ব্রিটিশ র্কুটনীতিক ও লেখক রেভারলি নিকল্স অভিমত দিয়েছিলেন যে, বর্তমান বিশ্বের শ্রেষ্ট ৬ জন প্রাপ্ত মনীষীর অন্যতম একজন ড. আম্বেদকর। এছাড়া রাজনৈতিক হিসেবে তার যে বিরাট ব্যক্তিত্ব ছিল তা তার চিরশক্রগণও অস্বীকার করতে পারত না। ১৯৪২ সালে তিনি Scheduled Caste Federation নামে একটি দল গঠন করেছিলেন। যা পরবর্তীতে Republican Party of India নামে পরিবর্তিত হয়। ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে আম্বেদকরের অবদান বলে বা লিখে শেষ করার মত নয়। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর Flag Committee এর সদস্য হিসাবে তারই পরামর্শে ভারতের জাতীয় পতাকায় অশোক চক্র স্থান পেয়েছিল। আইন বিষয়ে অসাধারন পারদর্শীতার কারনে তাকে নবগঠিত কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার আইন মন্ত্রী নিযুক্ত করা হয়েছিল। নতুন রাষ্ট্রের সংবিধান রচনা করার জন্য যে খসরা সংবিধান কমিটি গঠন করা হয়েছিল, তিনি ছিলেন তার চেয়ারম্যান। ভারত ভ্রমন কালে আমেরিকার চীফ জাস্টিস মন্তব্য করেছিলেন লিখিত সংবিধান গুলোর মধ্যে ভারতের সংবিধান সবচেয়ে উত্তম সংবিধান কমিটির চেয়ারম্যানের ক্ষমতা বলেই তিনি ভারতীয় সংবিধানে অস্পৃশ্যতাকে নিষিদ্ধ করতে পেরেছিলেন। আজ ভারতে অন্তত তার নামে দুটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। কিন্তু এত কিছুর পরও সবচেয়ে পীড়া দায়ক তথ্য হল এই ড. আম্বেদকর নিজেকে এমন সুযোগ্য করে তুলতে সক্ষম হলেও সমাজ থেকে অস্পৃশ্যতা দূর করতে পুরোপুরি সফলকাম হননি। “ভারত রত্ন” খেতাব প্রাপ্ত দলিত আন্দোলনের পুরোধা এই মহান ব্যক্তি বহু চেষ্টা করেও তৎকালীন হিন্দু নেতাদের মানসিকতার কোন পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি দেখলেন ব্রাক্ষন তথা হিন্দু নেতাগণ নিজেদের অবস্থান থেকে এক ইঞ্চি ও সরে যেতে রাজি নয়। কারন তারা সবাই চেয়েছিলেন বর্ন প্রথাকে বহাল রেখে সমাজ সংস্কার করতে। দলিতদের প্রতি তাদের বক্তব্য ছিল- পূর্ব জন্মের পাপ করার কারনেই তারা দলিত হয়েছে। তাদের পরামর্শ দেওয়া হত, দেবতার নিকট প্রার্থনা করতে। যাতে তারা পরজন্মে দলিত না হয়, যা হোক এত চেষ্টাতেও যখন আম্বেদকর আশানুরূপ সাফল্য পেলেন না , পেলেন না তার প্রাপ্য মর্যাদা, তখন তিনি হতভাগা দলিতদের অস্পৃশ্যতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষা লাভ করেন।
আম্বেদকর যে কতটা অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে লড়ে গেছেন তা বিভিন্ন সময়ের আন্দোলনে তাঁর ভাষনেই এর প্রমাণ মেলে। আত্ম নির্ভরতা, আত্ম উন্নয়ন ও আত্মসম্মান, এই তিনটি মূলমন্ত্রকে সামনে রেখে অত্যন্ত প্রাঞ্জলভাবে তাঁর বক্তব্যে শোনা যায়: ‘আমাদেরও জন্মভূমির উপর অন্যান্যদের মতো সমান অধিকার রয়েছে, যে অধিকার থেকে আমাদেরকে শত সহ¯্র বছর ধরে বঞ্চিত রাখা হয়েছে। আজ মরনপণ সংগ্রাম করেও সে অধিকার আমাদের আদায় করে নিতে হবে।’ এমনকি ১৯২৭ সালে ড. আম্বেদকর ১৯ ও ২০ মার্চ মাহারদের একটি সম্মেলন আহ্বান করেন। এ সম্মেলনে বিভিন্ন জেলা থেকে প্রায় দশ হাজার প্রতিনিধির উপস্থিতিতে ড. আম্বেদকর এক জ্বালাময়ী বক্তৃতায় বলেন- ‘আমরা যদি নিজেদের মর্যাদা নিজেরা সৃষ্টি করতে না পারি কেউই আমাদের মর্যাদা দেবে না এবং পদে পদে অপমান ও ঘৃণা করবে। আমাদের প্রত্যেককে শিক্ষাগ্রহণ করতে হবে। ভবিষ্যৎ বংশধরদের যদি আমাদের চেয়ে উন্নতস্তরে পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা না করি তবে আমাদের সঙ্গে পশুদের পার্থক্য কোথায় ?’
বিশ্বায়নের এ যুগে সারাবিশ্ববাসী এখন পাশাপাশি গ্রামের প্রতিবেশী তুল্য। আমাদের সমুদয় চিন্তার সংকীর্ণতাকে কাটিয়ে উঠে সারাবিশে^র ইতিবাচক যেকোন প্রণম্য ব্যক্তি/ব্যক্তির অবদান সম্মানে গ্রহণপূর্বক নিজেদের বিকশিত করার কাজে লাগালে লাভ ছাড়া ক্ষতি কিছু হবার আশঙ্কা থাকার কথা না। যাচাইপূর্বক প্রকৃত সত্যকে উদঘাটন করে বহুল ব্যবহৃত ও প্রচলিত মিথ্যা/কুটতাকে পরিহার করবার সৎসাহস থাকা চাই। মানবতাবাদী, আজন্ম সংগ্রামী ও গণমানুষের কন্ঠস্বর আম্বেদকরের মতো একজন ব্যক্তিত্ব যেকোন মানবিক মুক্তিকামী মানুষের শ্রদ্ধার্ঘ পাবার যোগ্য। তথাকথিত অস্পৃশ্য, দলিত ও বঞ্চিত মানুষের প্রতি চলে আসা দীর্ঘদিনের অকথ্য নির্যাতন ও মর্যাদাহীনভাবে জোরপূর্বক চাপিয়ে দেওয়া শোষণের অভিনব সব নিয়ম/প্রথা থেকে তাঁদের বেড়িয়ে এনে মুক্তির অমৃত স্বাদ আনতে গিয়ে আম্বেদকরের যে ত্যাগ তা অনেকটাই অভাবনীয়। তাঁর সারাটাজীবনের পদে পদে অবহেলার বদৌলতে অসীম ধৈর্য, পরিশ্রম, সাধনা দ্বারা অর্জিত অবস্থান আমাদের কল্পনা শক্তিকেও হার মানায়। বাংলাদেশে বাবাসাহেব ড. ভীমরাও রামজী আম্বেদকরকে নিয়ে বেশি বেশি গবেষণা, অধ্যয়ন ও জানাবোঝার দরকার আছে। রাষ্ট্রীয়, ব্যক্তি উদ্যোগে আম্বেদকরের ভাস্কর্য স্থাপন করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে আমরা অনেকটাই এগিয়ে যেতে পারবো বলে বিশ^াস। পাঠ্যপুস্তকে তার জীবন সংগ্রাম অন্তর্ভূক্ত করলে শিক্ষার্থীরা শুধু তাকেই জানবেন ব্যাপারটা এমন নয়। কিভাবে মানবিক মানুষ হয়ে গড়ে ওঠা যায় তারও একটা হাতেখড়ি হয়ে যাবে ছাত্রজীবন থেকেই। মানুষ তো আমরা সবাই, কিন্তু মানবিক বোধসম্পন্ন মানুষ ক’জন ?
বাংলা নববর্ষের প্রথমদিন পহেলা বৈশাখ ও আম্বেদকরের জন্মদিন একই দিনে পরে। পুরনো বছরের দুঃখ-কষ্ট ভুলে নূতন বর্ষের সূচনাক্ষণে বঞ্চিতশ্রেণির প্রত্যাশাও তেমনি অনেকটা উপচে পড়ার মতোই। তাঁরাও আশায় বুক বাধতে চায় নূতন করে। ভুলতে চায় বিগত দিনের বহুল আকাঙ্খিত না পাওয়াগুলোর কথা। সবাই আজকের আনন্দের এই দিনে একসাথে সুর মেলাই, “বর্ণবাদ নিপাত যাক, মানবতা মুক্তি পাক”।