রক্তাক্ত ইজতেমার ময়দান; নিহত ১, আহত ৩ শতাধিক
অনলাইন ডেস্ক । কাগজটোয়েন্টিফোরবিডিডটকম
টঙ্গীর বিশ্ব এজতেমা ময়দানে সা’দ পন্থীদের জোড় এজতেমা করতে না দেয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে শনিবার দুপুরে সা’দু’ পন্থীরা এজতেমা ময়দানে অবস্থানরত জোবায়ের পন্থীদের উপর নির্মমভাবে আক্রমন চালিয়েছে। এতে এক মুসল্লী নিহত ও তিন শতাধিক মুসল্লী গুরুতর ভাবে আহত হয়েছেন। নিহতের নাম ইসমাইল মন্ডল (৭০), পিতার নাম খলিল মন্ডল।
দেশের বাড়ি মুন্সীগঞ্জ জেলার মিলকিপাড়া গ্রামে। ৫দিনব্যাপী জোড় এজতেমা অনুষ্ঠানে বাধা দেয়ায় হাজার হাজার সা’দ পন্থী মুসল্লীরা এ হামলা চালায়। শুক্রবার থেকে জোড় এজতেমা শুরু হওয়ার কথা ছিল। জোবায়ের তথা কওমি পন্থী আলেম ওলামারা জোড় এজতেমা অনুষ্ঠানে বাধা দিলে শনিবার এ দুঃখজনক ঘটনাটি ঘটে। এজতেমা ময়দানে অবস্থানরত জোবায়ের পন্থী মুসল্লীরা যখন তালিমরত অবস্থায় ছিলেন ঠিক ওই মুহুর্তে ময়দানের চতুরদিক থেকে সা’দ পন্থীরা লাঠিসোটা নিয়ে এজতেমা মাঠের গেট ভেঙ্গে একযোগে মাঠের ভিতরে ঢুকে এলোপাথারি আক্রমন শুরু করে। এতে শত শত মুসল্লী আহত হয়ে রক্তাক্ত হয়ে পড়েন।
এ পর্যায়ে উভয় পক্ষে সংঘর্ষ বেধে যায়। সংঘর্ষে উভয় পক্ষের তিনশ’র উপরে মুসল্লী আহত হয়েছেন। সা’দ পন্থীরা একের পর এক জোবায়ের পন্থীদের কুপিয়ে ও পিটিয়ে আহত করতে থাকে। এ অবস্থায় জোবায়ের পন্থীদের মাঠ ত্যাগে বাধ্য করে সা’দ পন্থীরা। পুরো মাঠের দখল নিয়ে নেয় সা’দ পন্থীরা।
আহত মুসল্লীদের আত্মচিৎকারে আশপাশের মানুষজন ছুটে আসে তাদের উদ্ধারে। মাঠের পাশে টঙ্গী শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে আসতে থাকে আহত মুসল্লীদের। এদের মধ্যে কারো হাত, কারো মাথা, কারো বা পা পিটিয়ে ও কুপিয়ে থেতলে দেয়া হয়েছে। একে একে তিন শতাধিক মসুল্লীকে স্থানীয় জনগণ টঙ্গী হাসপাতালসহ আশপাশের হাসপাতালগুলোতে আনতে থাকে। প্রায় দুই ঘন্টাব্যাপী আহতদের উদ্ধার অভিযান চলে। আহতদের হাসপাতালে আনার পর এক হৃদয়বিধারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। আড়াইশ শয্যার হাসপাতালটি আহতদের ভীড়ে কানায় কানায় ভরে যায়। আহতদের ঠাই দেয়া হয় হাসপাতালের বারান্দা ও মাঠে। হাসপাতালের ডাক্তার ও নার্সরা আপ্রাণ চেষ্টা চালান আহতদের চিকিৎসা দেয়ার জন্য। স্থানীয় এমপি জাহিদ আহসান রাসেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে এজতেমা মুসল্লীদের দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা নিশ্চিত করেন। গুরুতর আহতদের টঙ্গী থেকে ঢাকার হাসপাতালগুলোতে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ও অন্যান্য উপজেলা থেকে আসা এ্যাম্বুলেন্স দিয়ে পাঠানো হয়।
বিবদমান দুই গ্রুপের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে অরাজনৈতিক ধর্মীয় সংগঠন তাবলীগ জামাতের সুদীর্ঘ কালের শান্তিপূর্ণ ইতিহাস ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল বিশ্ব এজতেমার শান্তিময় ঐতিহ্য। শনিবার টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে বিশ্ব তাবলীগ মারকাজের আমীর মাওলানা সাদ কান্ধালভীর সমর্থক ও সাদ বিরোধী মুসল্লিদের মধ্যে এই সংঘর্ষ হয়। নিরস্ত্র মুসল্লিরা বাশঁ, লাঠি, লোহার রড ও ইটের ভাঙা টুকরা নিয়ে পরস্পরের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে। তারা একে অপরকে ধরে নিষ্ঠুর ভাবে পিটিয়ি মারাত্মক ভাবে জখম করে।
আহতরা জানান, প্রতিপক্ষের মুসল্লিরা এক জনকে ধরে ৬/৭ জন হাঁটু,মাথা ও পায়ের গিড়ায় আঘাত করেন। আহত মুসল্লিদের অধিকাংশই হাঁটতে পারছেন না। প্রায় সবার মাথায় রয়েছে প্রচন্ড আঘাতের চিহ্ন। ইটের টুকরা দিয়ে তারা প্রতিপক্ষের মাথা ও হাঁটু থেতলে দেয়। আহতদের মধ্যে ৪১ জন কে গুরুতর অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। তিন শতাধিক আহত মুসল্লিকে টঙ্গী শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। দেড় শতাধিক আহতকে স্থানীয় বিভিন্ন প্রাইভেট হাসপাতালে ও শতাধিক আহত মাদ্রসা ছাত্রকে টঙ্গী দারুল উলুম কামিল মাদ্রাসায় নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
মুসল্লিদের সবার হাতেই ছিল বাশঁ, লাঠি এবং ইট। যেন দুই পক্ষ আগে থেকেই ছিল প্রস্তুত। সংঘর্ষ চলাকালে কে কোন পক্ষের লোক তা বোঝার কোন উপায় না থাকায় এলোপাতাড়ি হামলায় কম বেশি সবাই আঘাত পান। এজতেমা ময়দানে গিয়ে দেখা যায় বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছেন অনেক মুসল্লী। সংঘর্ষের পর স্থানীয় লোকজন ছুটে যান ময়দানে। অনেকে আহতদের কোলে তুলে রিকশায় করে হাসপাতালে নিয়ে আসেন।
টঙ্গী শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালের বারান্দা রক্তাক্ত হয়ে পড়ে। হাসপাতালের কোথাও খালি জায়গা ছিল না। সবখানেই চলছিল আহতদের চিকিৎসা।
সা’দ বিরোধী পন্থীরা আগামী ৭-১১ ডিসেম্বর থেকে পাঁচ দিন ব্যাপী জোড় ইজতেমার ঘোষণা দেয়। অপর দিকে সাদ পন্থীরা তা প্রত্যাখ্যান করে ৩০ নবেম্বর থেকে পাল্টা পাঁচ দিনের জোড় ইজতেমার ঘোষণা দেয়। এ নিয়ে উভয় পক্ষে উত্তেজনা দেখা দিলে উভয় পক্ষকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে ডেকে জোড় এবং বিশ্ব ইজতেমা আপাতত স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়া হয়। সাদ পন্থীরা পূর্ব গোষণা অনুযায়ী জোড় ইজতেমা অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্তে অটল থেকে তাদের সমর্থকদের ময়দানে উপস্থিত থাকার নির্দেশ দেয়। অপর দিকে সাদ বিরোধীরা কয়েক দিন আগেই ইজতেমা ময়দান নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়।
শুক্রবার সাদ পন্থীরা ময়দানে এলে সাদ বিরোধীরা ইজতেমা ময়দানের পাঁচটি গেট তালা দিয়ে বন্ধ করে তাদের তাড়িয়ে দেয়। সাদ পন্থীদের শীর্ষ মুরুব্বীরা যে কোন মূল্যে মাঠের কতৃত্ত ও দখল নিতে মরিয়া হয়ে উঠে। তারা শনিবার ভোরে একত্রিত হয়ে আনুমানিক লক্ষাধিক মুসল্লি এক যোগে মাঠে এসে গেট ভেঙে ভিতরে প্রবেশ করে। এ সময় সাদ বিরোধীরা বাধা দিতে চাইলে তুমুল সংর্ঘর্ষ বাধে। ইজতেমা ময়দানে সাদ পন্থীরা জড়ো হয়ে ভিতরে প্রবেশের চেষ্টা চালাচ্ছে এ খবর ছড়িয়ে পড়লে টঙ্গী ও আশপাশের এলাকার বিভিন্ন মাদ্রাসা থেকে হাজার হাজার ছাত্র-শিক্ষক মিছিল নিয়ে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহা সড়কে এসে অবরোধ সৃষ্টি করে। বেলা দুটা পর্যন্ত অবরোধ চলে। এ সময় এ সড়কে চলাচলকারি দশটি রুটের গাড়ি আটকা পড়ে। শনিবার থেকে অনার্স পরীক্ষা শুরু হওয়ার কারণে স্থানীয় কলেজ গুলোতে শিক্ষার্থীদের ছয়/সাত কিলোমিটার রাস্তা হেঁটে পরীক্ষা কেন্দ্রে পৌঁছতে বিলম্ব হয়।
বর্তমানে ইজতেমা ময়দানে সাদ বিরোধীদের হটিয়ে সাদ পন্থীরা অবস্থান করছে। গাজীপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার এম ওয়াই বেলালুর রহমান জানান, মুসল্লীদের দু’পক্ষের মাঝে শান্তি বজায় রাখতে শনিবার রাতের মধ্যে মুসল্লীদের মাঠ ছেড়ে দেয়ার অনুরোধ করা হয়েছে। তিনি এ দুঃখজনক ঘটনায় উভয় পক্ষকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।