রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র সুন্দর বনের জন্য আরেক ফারাক্কার মতো মরন ফাঁদ ।

সেলিনা জাহান প্রিয়া

বাংলাদের প্রথম ক্ষতি বা মরুভুমিতে পরিনত করে ভারত ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে। এখন আমাদের সুন্দর বনকে ধ্বংশ করার জন্য রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করার মাধ্যমে কি তা ধ্বংস কারার কোন নীল নকসা ।

মাত্র ১৩২০ মেঘাওয়াট বিদ্যুৎতের আমাদের প্রিয় সুন্দর বনকে ধ্বংশ করা হবে তা কি মেনে যায়? রামপালের বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি হবে দুই দেশে অর্থাৎ বাংলাদেশ ও ভারত সমান অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দুই দেশের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি নামে একটি কোম্পানিও গঠন করা হয়েছে।

এই প্রকল্পের অর্থায়ন করবে ১৫% পিডিবি, ১৫% ভারতীয় পক্ষ আর ৭০% ঋণ নেয়া হবে ভারতের কাছ থেকে। আর নীট লাভ হবে সেটা ভাগ করা হবে ৫০% হারে। উৎপাদিত বিদ্যুৎ কিনবে পি ডি বি। বিদ্যুতের দাম নির্ধারিত হবে একটা ফর্মুলা অনুসারে। তা হল যদি কয়লার দাম প্রতি টন ১০৫ ডলার হয় তবে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ এর দাম হবে ৫ টাকা ৯০ পয়সা এবং প্রতি টন ১৪৫ ডলার হলে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ৮ টাকা ৮৫ পয়সা। অথচ দেশীয় ওরিয়ন গ্রুপের সাথে মাওয়া, খুলনার লবন চড়া এবং চট্টগ্রামের আনোয়ারা তে যে তিনটি কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের যে চুক্তি হয়েছে পিডিবির সাথে সেখানে সরকার মাওয়া থেকে ৪ টাকায় প্রতি ইউনিট এবং আনোয়ারা ও লবন চড়া থেকে ৩টাকা ৮০ পয়সা দরে বিদ্যুৎ কিনবে।

sundarbans-national-park-animal

আমরা ৩ টাকাম ৮০ পয়সা করে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ কিনতে পারি এমন বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন করার অনুমতি দিতে পারে সরকার। কেন ৮ টাকা দরে বিদ্যুৎ কিনব। এদিকে, সরকার এর মধ্যেই ১৪৫ ডলার করে রামপালের জন্য কয়লা আমদানির প্রস্তাব চূড়ান্ত করে ফেলেছে। তার মানে ৮ টাকা ৮৫ পয়সা দিয়ে পি ডি বি এখান থেকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ কিনবো সেটা নিশ্চিত। ১৮৩০ একরধানী জমি অধিগ্রহণের ফলে রামপাল উপজেলার সাপমারী ও কৈকরদাস কাঠী মৌজার মোট ৮টি ইউনিয়নের ৭০০০-৮০০০ পরিবার উচ্ছেদ হয়ে যাবে। রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কর্ম সংস্থান হতে পারে সর্বোচ্চ ৬০০ জনের, ফলে উদ্বাস্তু এবং কর্মহীন হয়ে যাবে প্রায় ৭৫০০ পরিবার। আর সাথে সাথে আমরা প্রতি বছর হারাবো কয়েক কোটি টাকার কৃষিজ উৎপাদন।

ইআইএ রিপোর্ট অনুসারে প্রস্তাবিত ১৩২০ মেগাওয়াট রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পটি সুন্দরবন থেকেমাত্র ১৪ কি.মি. দূরে! আবার সুন্দরবন থেকে দূরত্ব আসলেই ১৪ কি.মি. কিনা সেটা নিয়েও বিতর্ক আছে। খোদ ইআইএ রিপোর্টের এক জায়গায় বলা হয়েছে প্রকল্পের স্থানটি একসময় একেবারে সুন্দরবনেরই অংশ ছিল। কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিতে ১৩২০ মেগাওয়াটের ২টি বিদ্যুৎ উৎপাদন ইউনিট থাকবে। প্রথম ইউনিটটি নির্মাণ করতে সাড়ে চার বছর সময় লাগবে। প্রথম ইউনিটটি নির্মাণের সাড়ে চার বছর সময় জুড়ে গোটা এলাকার পরিবেশ, কৃষি,মৎস ও পানি সম্পদের উপর অসংখ্য ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে।

বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের মালামাল, যন্ত্রপাতি ও বিদ্যুৎ উপকরণ কয়লা আনা হবে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নদী পথে। ফলে বাড়তি নৌযান চলাচল, তেল নিঃসরণ, শব্দদূষণ, আলো, বর্জ্য নিঃসরণ ইত্যাদি সুন্দরবনের ইকো সিস্টেম বিশেষ করে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হরিণ, ডলফিন, ম্যানগ্রোভ বন ইত্যাদির উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে বলে ইআইএ রিপোর্টে আশংকা করা প্রকাশ হয়েছে। আমাদানীকৃত কয়লা সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে জাহাজের মাধ্যমে মংলা বন্দরে এনে তারপর সেখান থেকে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে নিয়ে যেতে হবে।

Monky-1426915717

কিন্তু সুন্দরবনের ভেতরে পশুর নদীর গভীরতা সর্বত্র বড় জাহাজের জন্য উপযুক্ত না হওয়ার কারণে প্রথমে বড় জাহাজে করে কয়লা সুন্দর বনের আকরাম পয়েন্ট পর্যন্ত আনতে হবে, তারপর আকরাম পয়েন্ট থেকে একাধিক ছোট লাইটারেজ জাহাজে করে কয়লা মংলাবন্দরে নিয়ে যেতে হবে। এর জন্য নিয়মিত ড্রেজিং করতে হবে নদী গুলো। ড্রেজিং এর ফলে নদীর পানি ঘোলা হবে। ড্রেজিং সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা না হলে তেল- গ্রীজ ইত্যাদি নিঃসৃত হয়ে নদীর পানির দূষিত হবে।

পশুরনদীর তীরে যে ম্যানগ্রোভ বনের সারি আছে তা নির্মাণ পর্যায়ে জেটি নির্মাণসহ বিভিন্ন কারণে কাটা পড়বে। নদী তীরের ঝোপঝাড় কেটে ফেলার কারণে ঝোপঝাড়ের বিভিন্ন পাখিবিশেষ করে সারস ও বক জাতীয় পাখির বসতি নষ্ট হবে। তাছাড়া বিদু্ৎ কেন্দ্র থেকে অনেক ক্ষতি কর খনিজ পদাথ নদীর পানি বা সুন্দর বনকে ধ্বংশ করবে। ইআইএ রিপোর্ট অনুসারে ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে প্রতিদিন প্রায় ১৪২ টন বিষাক্ত সালফার ডাই-অক্সাইডও ৮৫ টন বিষাক্ত নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড নির্গত হবে। পশুর নদী থেকে প্রতি ঘন্টায় ৯১৫০ ঘনমিটার করে পানি প্রত্যাহার করা হবে।

0,,17860405_303,00

যতই পরিশোধনের কথা বলা হোক, কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে পানি নির্গমন হলে তাতে বিভিন্ন মাত্রায় দূষণকারী উপাদান থাকবেই যে কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বেলায় ‘শূন্য নির্গমণ’ বা ‘জিরো ডিসচার্জ’ নীতি অবলম্বন করা হয়। এনটিপিসিই যখন ভারতে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রনির্মাণ করে তখন ‘জিরো ডিসচার্জ’ নীতি অনুসরণ করে অথচ রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ইআইএ রিপোর্টে বলা হয়েছে- ‘পরিশোধনকরার পর তরল বর্জ্য বা ইফ্লুয়েন্ট ঘন্টায় ১০০ ঘনমিটার হারে পশুর নদীতে নির্গত করা হবে।’ যা গোটা সুন্দরবন এলাকার পরিবেশ ধ্বংস করবে। ইআইএ রিপোর্ট অনুসারে ২৭৫ মিটার উচু চিমনী থেকে নির্গত গ্যাসীয় বর্জ্যরে তাপমাত্রা হবে১২৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস ফলে আশেপাশের তাপমাত্রা বেড়ে যাবে।

কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রেবছরে ৭,৫০,০০০ টন ফ্লাই অ্যাশ ও ২ লক্ষ টন বটম অ্যাশউৎপাদিত হবে। এতে বিভিন্ন ভারী ধাতু যেমন আর্সেনিক, পারদ, সীসা, নিকেল, ভ্যানাডিয়াম,বেরিলিয়াম, ব্যারিয়াম, ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম, সেলেনিয়াম, রেডিয়াম মিশে থাকে। কিন্তু আরো ভয়ংকর ব্যাপার হলো, একদিকে বলা হয়েছে এই বিষাক্ত ছাই পরিবেশে নির্গত হলে ব্যাপক দূষণ হবে অন্যদিকে এই ছাই দিয়েই প্রকল্পের মোট ১৮৩৪ একর জমির মধ্যে ১৪১৪ একর জমি ভরাট করার পরিকল্পনা করা হয়েছে! এই বর্জ্য ছাই এর বিষাক্ত ভারী ধাতু নিশ্চিত ভাবেই বৃষ্টির পানি সাথে মিশে, চুইয়ে প্রকল্প এলাকার মাটি ও মাটির নীচের পানির স্তর দূষিত করবে যার প্রভাব শুধু প্রকল্প এলাকাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না।

উৎপাদিত বর্জ্য ছাই সিমেন্ট কারখানা, ইট তৈরি ইত্যাদি বিভিন্ন শিল্পে ব্যাবহারের সম্ভাবনার কথা ইআইএ রিপোর্টে বলা হলেও আসলে বড় পুকুরিয়ার মাত্র ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত দৈনিক ৩০০ মেট্রিক টন বর্জ্য ছাই কোনো সিমেন্ট কারখানায় ব্যাবহারের বদলে ছাই এর পুকুর বা অ্যাশ পন্ডে গাদা করে রেখে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটানো হচ্ছে। সরকারি পরিবেশ সমীক্ষা (ইআইএ) অনুযায়ী, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য বছরে ৪৭ লক্ষ ২০ হাজার টন কয়লা ইন্দোনেশিয়া, অষ্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে সমুদ্র পথে আমদানী করতে হবে। কিন্তু সুন্দরবনের ভেতরে পশুর নদীর গভীরতা সর্বত্র বড় জাহাজের জন্য উপযুক্ত না হওয়ার কারণে প্রথমে বড় জাহাজে করে কয়লা সুন্দরবনের আকরাম পয়েন্ট পর্যন্ত আনতে হবে, তারপর আকরাম পয়েন্ট থেকে একাধিক ছোট জাহাজে করে কয়লা মংলাবন্দরে নিয়ে যেতে হবে। ১৩২০ মেগাওয়াটের জন্য প্রতিদিন প্রায় ১৩ হাজার টন কয়লা লাগবে।

June_1326175962_5-sundor

অর্থাৎ দ্বিতীয় পর্যায়ের শেষে ২৬ হাজার টন কয়লা লাগবে দ্বিগুন। আর এর জন্য সুন্দর বনের ভেতরে হিরণ পয়েন্ট থেকে আকরাম পয়েন্ট পর্যন্ত ৩০ কিমি নদী পথে বড় জাহাজ বছরে ৫৯ দিন এবং আকরাম পয়েন্ট থেকে মংলা বন্দর পর্যন্ত প্রায় ৬৭ কিমি পথ ছোট লাইটারেজ জাহাজে করে বছরে ২৩৬ দিন হাজার হাজার টন কয়লা পরিবহন করতে হবে! এত ক্ষতি হবে তার পর কেন এই প্রকল্প বাতিল করা হচ্ছে না? তার জন্য দেশের সকল মানুষকে এক সাথে আন্দোলন করে তা প্রতিহত করতে হবে। না হলে আমাদের সুন্দর বন শেষ হয়ে যাবে।

https://youtu.be/e58fFErA4tc

ভিডিওঃ এসএটিভি

 

  • প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব কাগজ২৪এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য কাগজ২৪ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!