লাইলাতুল মেরাজ বা মেরাজের রজনী
লাইলাতুল মেরাজ বা মেরাজের রজনী, যা শবে মেরাজ হিসাবে আখ্যায়িত। বছরের যে ক’টি রাত ফজিলতপূর্ণ এর একটি লাইলাতুল মেরাজ। ইসলামে মেরাজের বিশেষ গুরুত্ব আছে, কেননা এই মেরাজের মাধ্যমেই ইসলাম ধর্মের পঞ্চস্তম্ভের দ্বিতীয় স্তম্ভ অর্থাৎ নামাজ মুসলমানদের জন্য অত্যাবশ্যক অর্থাৎ ফরজ (প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ) নির্ধারণ হয়েছে।
রাসুল (সা:) জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুজেজা হচ্ছে মেরাজ। মেরাজ আরবি শব্দ, শাব্দিক অর্থ ঊর্ধ্বগমন, আকাশপথে ভ্রমণ করা ইত্যাদি। উম্মে হানির ঘর থেকে জাগ্রত অবস্থায় বোরাকে করে মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা, সেখান থেকে প্র্রথম আকাশ হয়ে সপ্তাকাশ, সেখান থেকে বায়তুল মামুর, সিদরাতুল মুনতাহা, আরশে আজিম পৌঁছে আল্লাহর দিদার লাভ করা—এসবই মেরাজের অন্তর্ভুক্ত। কোরআনুল কারীমে আল্লাহ বলেন-
سُبْحَانَ الَّذِي أَسْرَى بِعَبْدِهِ لَيْلًا مِنْ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ إِلَى الْمَسْجِدِ الْأَقْصَى الَّذِي بَارَكْنَا حَوْلَهُ لِنُرِيَهُ مِنْ آيَاتِنَا إِنَّه هُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ
উচ্চারণ: সুবহানাল্লাজি আস্রা বিআবদিহি লাইলাম মিনাল মাসিজদিল হারামী ইলাল মাসিজদিল আকসা
বঙ্গার্থ : “পবিত্র সেই মহান সত্তা, যিনি তাহার এক বান্দা (মুহাম্মদ)-কে মসজিদুল হারাম (কাবাঘর) হইতে মসজিদুল আকসা (বাইতুল মোকাদ্দাস) পর্যন্ত পরিভ্রমণ করাইয়াছেন। ইহার মধ্যে তাহাকে অসংখ্য নিদর্শনাবলী দেখান হইয়াছে।
ঐতিহাসিকদের মতে, রাসুল (সা:) ৫২ বছর বয়সে অর্থাৎ নবুয়্যাতের ১২তম সনে হিজরি সাল অনুযায়ী রজব মাসের ২৬ তারিখ দিবাগত রাতে রোজ সোমবার মেরাজে গমন করেন। হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী, মেরাজের রাতে রাসুল (সা:) উম্মে হানি বিনতে আবু তালিবের ঘরে ঘুমিয়েছিলেন। হঠাত্ হজরত জিবরাইল (আ:) এসে রাসুল (সা:) কে মসজিদুল হারামে নিয়ে যান। যেখানে তার বুক বিদীর্ণ করে জমজম কূপের পানি দিয়ে সিনা ধুয়ে পরিষ্কার করে শক্তিশালী করেন। এ ঘটনাকে ‘শাক্কুস সদর’ বলে। নবী (সা:) এর জীবনে অন্তত তিনবার এমনটা হয়েছে। তারপর সেখান থেকে তিনি ‘বোরাক’ নামক এক ঐশী বাহনে চড়ে বায়তুল মোকাদ্দাসে এসে সব নবীর ইমাম হয়ে দুই রাকাত নামাজ আদায় করেন। তারপর তিনি বোরাকে চড়ে ঊর্ধ্বে গমন করতে থাকেন। একের পর এক আসমান অতিক্রম করতে থাকেন।
রাস্তায় মুসা (আ:) সহ বেশ কয়েকজন নবী-রাসুলের সঙ্গে সাক্ষাত্ হয়। সপ্তম আসমানের পর রাসুল (সা:) কে বায়তুল মামুর পরিদর্শন করানো হয়। বায়তুল মামুরে দৈনিক ৭০ হাজার ফেরেশতা প্রবেশ করেন। ফেরেশতাদের সংখ্যা এত বেশি যে, যারা একবার এই বায়তুল মামুরে প্রবেশ করেন, কেয়ামত পর্যন্ত তাদের সেখানে প্রবেশ করার পালা আর আসবে না। সেখানে রাসুল (সা:) স্বচক্ষে জান্নাত ও জাহান্নাম দেখেন। এরপর রাসুল (সা:) এর সামনে একপাত্র মদ, একপাত্র দুধ এবং একপাত্র মধু আনা হয়। তিনি এর মধ্য থেকে দুধের পাত্রটি গ্রহণ করেন। তখন জিবরাঈল (আ:) বললেন, এটা ফিত্রত বা স্বভাব ধর্মের নিদর্শন। আপনি এবং আপনার উম্মত এই স্বভাবধর্ম ইসলামের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকবেন।
বায়তুল মামুরে জিবরাইল (আ:) কে রেখে তিনি ‘রফরফ’ নামক আরেকটি আসমানি বাহনে চড়ে মহান আল্লাহর দরবারে হাজির হন। কোনো কোনো বর্ণনায় আছে, মেরাজের রাতে রাসুল (সা:) আল্লাহ তা’আলার এতটা কাছাকাছি গিয়েছিলেন যে, দুজনের মধ্যখানে মাত্র এক ধনুক পরিমাণ ব্যবধান ছিল। এখানে রাসুল (সা:) এর উম্মতের ওপর ৫০ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করা হয়। পরবর্তী সময়ে বারবার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তা’আলা দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ উম্মতে মোহাম্মদীর ওপর ফরজ করেন।
হাদীস শরীফে শবে বরাত ও শবে মেরাজের নামায বলে কোন নামাযের কথা আসেনি। মেরাজের রাত্রিতে বিশেষ নফল নামায আদায়ের ফযীলত বিষয়ক সকল হাদীস বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। রাসূল (সা:) শুধু বিশেষ কোন রাত্রিতে নামায পড়তেন না। বরং বিশেষ কোন রাত্রিতে তা পড়ার জন্য তিনি কাউকে বলেননি। তবে রামাদান মাসে কিয়ামুল লাইলের কথা এসেছে দু’ভাবে। প্রথমত: সাধারণভাবে রামাদানে কিয়ামুল লাইলের কথা এসেছে। দ্বিতীয়ত: লাইলাতুল কাদরে কিয়ামুল লাইলের কথা এসেছে। কিন্তু অন্য কোন বিশেষ রাত্রির বিশেষ কিয়ামের কথা কোন হাদীসে আসেনি।
আমাদের দেশের কোন কোন এলাকার মসজিদে শবে মেরাজ ও শবে বরাতের এই দুই রাত্রিতে জামাতের সাথে ১২ রাকাত নামায আদায় করা হয় এবং এই নামায শেষে আবার রামাদানের মত বিতরের নামাযকেও জামাতের সাথে আদায় করা হয়।
মেরাজের রাতের ফজিলত বা অন্য কোন রাতের ফজিলতের বর্ণনা সম্পর্কে যে কয়টি হাদীস আমাদের সমাজে চালু আছে তার প্রায় সবগুলোই মুহাদ্দিসগণের বিচারে জাল ও বানোয়াট।
সহীহ হাদীসের ভিত্তিতে আমল করা সকল মুসলিমের কর্তব্য। আল্লাহ আমাদেরকে সঠিকভাবে কুরআন- হাদীস বোঝার তৌফিক দান করুন।
উৎসঃ ইন্টারনেট অবলম্বনে।
গ্রন্থনাঃ মাহবুব এইচ শাহীন/প্রকাশক ও সম্পাদক/কাগজ২৪