সরকার কিছু জানত না?
সাভারের জিরাবোতে এবারের আন্তর্জাতিক সামাজিক ব্যবসা দিবস সম্মেলন ২০১৭ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। গত কয়েক মাস ধরে অনলাইনে প্রচার – প্রচারণা চলছে। সম্মেলনের একদিন আগে অনুমতি না পাওয়ায়, তা বাতিল করা হলো। অনুমতি না দেওয়ার ক্ষেত্রে একমাত্র যুক্তি, ইউনূস সেন্টারের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক সামাজিক ব্যবসা সম্মেলন বিষয়ে সরকারকে বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে কিছু জানানো হয়নি। গুরুতর অভিযোগ। কমপক্ষে ৪০০ বিদেশী অতিথি আসবেন, যারা সবাই যার যার সেক্টরের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব।
সম্মেলনের মূল বক্তা হিসেবে ঢাকায় এসেছেন জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব থমাস গাস। তিনি জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য কর্মসূচি বাস্তবায়নের প্রধান কর্মকর্তা। তাদের নিরাপত্তা বিবেচনায় অবশ্যই সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে সম্মেলনের বিষয়টি জানানোর কথা। জানানো না জানানো বা সরকার কিছু জানে কি জানে না, বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে কিছু তথ্য জানা গেল। খুব সংক্ষেপে তা বলার চেষ্টা করছি।
৪০০ বিদেশী অতিথির মধ্যে ২০০ বা তারও বেশি সংখ্যক অতিথি ২৭ জুলাইয়ের মধ্যে ঢাকায় এসে পৌঁছায়। ২৮ জুলাই রাত- ভোর- সকালে বাকি অতিথিদের এসে পৌঁছানোর কথা ছিল।
সামাজিক ব্যবসা সম্মেলন উপলক্ষে জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব থমাস গাস ঢাকায় আসার সংবাদ জেনে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইউএন’র ঢাকা অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করে ২৭ জুলাই একটি ডিনারের আয়োজন করে। জাতিসংঘের ঢাকা অফিস থেকে ইমেল করে ইউনূস সেন্টারকে ২৪ জুলাই জানানো হয়-
‘We have received the attached invitation for Mr. Thomas Gass for a Dinner hosted by the Foreign Secretary on 27 July 2017 at 19:30 hrs at the Pan Pacific Sonargaon Hotel. We understand Mr. Gass is the keynote speaker of your event the 7th Social Business Day.’
২০ জুলাই ইউনূস সেন্টারের পক্ষ থেকে পুলিশ কমিশনার, বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ, পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ আরও কিছু জায়গায় চিঠি দিয়ে সম্মেলনের কথা জানানো হয়, সহায়তা চাওয়া হয়। স্থানীয় র্যা ব- পুলিশ ২৭ জুলাই মাঝরাত পর্যন্ত সহায়তা করছিলেনও। সকল রকম নিরাপত্তা দেওয়ার জন্যে তারা প্রস্তুত ছিলেন, ইউনূস সেন্টারকে নিশ্চিত করা হয়েছিল। সম্মেলন স্থানে এসেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আয়োজকদের সঙ্গে মিটিং করেছেন, ইউনূস সেন্টার এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানত বলেই তারা থমাস গাসের সম্মানার্থে ডিনারের আয়োজন করতে চেয়েছেন। থমাস ডিনারের আমন্ত্রণ গ্রহণও করেছেন। কিন্তু হঠাৎ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এই ডিনার বাতিল করা হয়। কেন বাতিল করা হলো, কোনো কারণ বলা হয়নি।
২৬ জুলাই ইউএন’র ঢাকা অফিস ইউনূস সেন্টারকে ইমেলে জানায়-
‘We are just informed by the Ministry of Foreign Affairs that the Dinner on 27 July 2017 (hosted by the Foreign Secretary) has been cancelled. You may kindly inform Mr. Gass accordingly.’
জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব কেন বাংলাদেশে আসছেন, তা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানত। ডিনারের আয়োজন এবং বাতিল করা থেকে তা পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়।
তাহলে সরকার কিছু জানত না বা সরকারকে ইউনূস সেন্টার কিছু জানায়নি, একথা আসলে কীসের ভিত্তিতে বলা হচ্ছে? যারা ফেসবুকে লিখছেন, তারা কোন তথ্যের ভিত্তিতে লিখছেন?
প্রায় ৪০০ বিদেশী অতিথি বিভিন্ন দেশের বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে ভিসা নিয়েছেন। ভিসা দেওয়ার জন্যে ইউনূস সেন্টারের পক্ষ থেকে চিঠি ইস্যু করা হয়েছে সম্মেলনের এক থেকে দেড় মাস আগে। সেই চিঠিতে ‘৭ম আন্তর্জাতিক সামাজিক ব্যবসা দিবস ২০১৭’ আয়োজনে যোগদানের কথা পরিষ্কারভাবে লেখা ছিল। চিঠিতে বলা হয়েছিল, অতিথি তার যাওয়া- আসার খরচ নিজে বহন করবেন।
বাংলাদেশ দূতাবাসকে ভিসা দেওয়ার জন্যে অনুরোধ করা হয়েছিল। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত বাংলাদেশ দূতাবাস ইউনূস সেন্টারের এই চিঠির ভিত্তিতে সবাইকে ভিসা দিয়েছে। কাউকে ভিসা দেওয়া হয়নি, এমন কোনো তথ্য ইউনূস সেন্টারের কাছে নেই। অতিথিদের কেউ অভিযোগও করেননি।
এরপরও কী বলা যায় যে, বাংলাদেশ সরকার বা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কিছু জানত না?
ইউনূস সেন্টার চালাকি করে দেরিতে জানিয়ে সরকারকে ফাঁদে ফেলেছে যারা বলছেন, তারা কীসের ভিত্তিতে বলছেন? অনুমতি না দেওয়ায় ইউনূস সেন্টার কিন্তু কোনো অভিযোগ করেনি। তারা সম্মেলন বাতিল করেছে।
২০ জুলাই চিঠি না দিয়ে আরও আগে চিঠি দিতে পারত ইউনূস সেন্টার, হ্যাঁ পারত। যারা বলছেন, সরকারের সঙ্গে মিলিতভাবে সম্মেলনটি করতে পারত। তাদের এই ভাবনা দেখলে শব্দ করে হাসা ছাড়া কিছু করার থাকে না।
এর আগের সম্মেলনগুলো যেভাবে আয়োজন করা হয়েছে, এই আয়োজনটিও সেভাবেই করেছে ইউনূস সেন্টার। বলা যেতেই পারে, আরও আগে না জানিয়ে তারা ভুল করেছে। এই ভুলের শাস্তি সম্মেলনের অনুমতি না দেওয়া? হয়ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কষ্ট একটু বেশি হতো, বিশেষ ব্যবস্থায় নিরাপত্তা দেওয়া যেত না?
ড. ইউনূসকে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ পছন্দ করেন। তারপরও তিনি আপনার অপছন্দের মানুষ হতে পারেন। তাকে পছন্দ করতেই হবে এমন তো কোনো নিয়ম নেই।
তার গ্রামীণ ব্যাংক, ক্ষুদ্র ঋণ, সামাজিক ব্যবসার ধারণাও আপনার অপছন্দের বিষয় হতে পারে। সারা পৃথিবীতে তিনি প্রশংসিত হন। কিছু সমালোচনাও আছে। সমালোচনা আপনিও করতে পারেন। তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের মালিক নন, এক টাকার শেয়ার নেই, সুদ থেকে যে লাভ তার থেকে এক পয়সাও কোনোদিন পাননি ড. ইউনূস। তারপরও যারা তাকে ‘সুদখোর’ বলেন, হয়ত পুরোটা বুঝতে না পেরে অজ্ঞতা থেকে বলেন।
ড. ইউনূসের এরকম একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন যে কারণ দেখিয়ে অনুমতি দেওয়া হলো না, এখনও কী তা আপনি সঠিক মনে করছেন? এতে কী ড. ইউনূসের কোনো ক্ষতি হলো? অর্জন কী হলো বাংলাদেশের? বিরোধীতা করেন, সমালোচনাও করেন, জ্ঞান- বিবেককে একটু জাগ্রত রেখে!
গোলাম মোর্তোজা: সম্পাদক, সাপ্তাহিক।
s.mortoza@gmail. com