নবাব সিরাজউদ্দৌলার বংশধর এখন ঢাকায় বসবাস করছেন।

নবাব সিরাজউদ্দৌলার বংশধর এখন ঢাকায় বসবাস করছেন।
-সেলিনা জাহান প্রিয়া

ভাগীরথী থেকে বুড়িগঙ্গা। মুর্শিদাবাদ থেকে ঢাকা। রাজকীয় হীরাঝিল প্রাসাদ থেকে ঢাকা শহরের এক ছোট্ট ফ্ল্যাটে বসবাস করছেন নবাব সিরাজউদদৌলার নবম বংশধরেরা। একদা বাংলা, বিহার, ওড়িশার আকাশ বাতাস কেঁপে উঠতো যাদের হুংকারে, ভাগিরথীর তীরে মুর্শিদাবাদ নগরে আলোকোজ্জ্বল মহল সর্বদা সরগরম থাকতো যে দাপুটে নবাবের পদচারণায় সুবে বাংলার সেই শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদদৌলার বংশধরেরা এখন ঢাকা শহরে বসবাস করছেন লোকচক্ষুর অন্তরালে, নীরবে নিভৃতে। অনেকেই তাদের খবর জানে না, অনেকেই খবর নেয় না। নবাব সিরাজউদদৌলা বাঙালি ছিলেন না। তিনি বাংলার ছিলেন না কিন্তু বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব ছিলেন। ভালবাসতেন বাংলাকে, বাঙালিকে।

আলিবর্দী খাঁ ইরান থেকে এসে ১৭৪০ সালে ৬৬ বছর বয়সে বাংলার নবাব হন।
নবাব সিরাজ উদ দৌলা ( ফার্সি:مرزا محمد سراج الدولہ, বাংলা: সিরাজ উদ দৌলা) ছিলেন আলিবার্দি খান-এর খুবই আদরের নাতি। নবাব সিরাজ উদ দৌলার জন্ম হয় ১৭৩৩ ( মতান্তরে ১৭৩৩ , ১৭২৭ ) খ্রিস্টাব্দে, জুলাই মাসের ২ তারিখ রাজমহলে এবং মৃত্যু হলো ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে | কারো মতে জন্ম ১৭২৭ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর।
১৭৫৬ সালে সিরাজউদ্দৌলা বাংলার মসনদে বসেন। ১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন পলাশীর প্রান্তরে সিরাজের পরাজয় এবং ২রা জুলাই ঘাতকের হাতে তার প্রাণ হারানোর মধ্য দিয়ে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়ে যায় বহুকালের জন্য। ১৭৫৭ সালের ২ জুলাই বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল।

সিরাজের পিতা জাইন উদ্দিন ছিলেন বিহারের নবাব ও আলী ওয়ার্দি খানের বড় ভাই, হাজী আহমেদের ছেলে এবং তার মা, আমিনা বেগম ছিলেন নবাব আলী ওয়ার্দি খানের সর্ব কনিষ্ট মেয়ে। যেহেতু আলী ওয়ার্দি খানের কোনো ছেলে ছিল না, সিরাজ, তার নাতি হিসেবে, তার মনের অনেক কাছে ছিল এবং সিরাজের বাল্যকাল থেকেই, ওকে, মুর্শিদাবাদ এর উত্তরসুরী হিসেবে দেখা হত। তার অনুসারে, সিরাজকে নবাবের দুর্গে, সকল সুযোগ, সুবিদা এবং শিক্ষা দেওয়া হয়, ভবিষ্যতের নবাব হিসেবে। ১৭৪৬ সালে, বাল্য সিরাজ তার নানা আলী ওয়ার্দিকে, মিরাথাস্দের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সাহায্য করে। ১৭৫২ সালে, ১৯ বছর বয়সী সিরাজকে, তার নানা আলী ওয়ার্দি, তার উত্তরসুরী (আলী ওয়ার্দির রাজ্যের নবাব) হিসেবে ঘোষিত করে এবং তার রক্তের অন্য কাউকে তার কোনো সম্পত্তির মালিক করেনি।

সিরাজউদ্দৌলার প্রকৃত নাম মীর্জা মুহম্মদ আলী । সিরাজ উদ দৌলার আরেক নাম ছিল “Sir Roger Dowllet” বা “সার রজার দৌলেত”, কারণ অনেক ইংরেজরা তার নাম উচ্চারণ করতে পারত না |

আমাদের এই ঢাকার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বাধা হয়ে আছে নবাব পরিবারের দুর্দিন, দুঃসময়ের জীবন। সিরাজউদদৌলার মৃত্যুর পর তার প্রিয়তমা স্ত্রী লুৎফুননিসা একমাত্র শিশু কন্যা উম্মে জোহরা, নানা আলীবর্দী খানের স্ত্রী আশরাফুন্নেসা সহ নবাব পরিবারের নারীদের ৮ বছর বন্দি করে রাখা হয়েছিল বুড়িগঙ্গা পাড়ের জিঞ্জিরা এলাকার একটি প্রাসাদে। স্থানীয় লোকজন ওই জরাজীর্ণ প্রাসাদটিকে এখনও জানে ‘নাগরা’ নামে। বর্তমানে ঢাকা শহরের খিলক্ষেত এলাকার লেকসিটি কনকর্ড-এর বৈকালী টাওয়ারে বসবাস করছেন নবাব সিরাজউদদৌলার নবম বংশধরেরা। তাদের একজন সৈয়দ গোলাম আব্বাস আরেব । তিনি কাজ করেন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক হিসেবে। বর্তমানে ড. ফজলুল হক সম্পাদিত সাপ্তাহিক পলাশী পত্রিকার সহ সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন। ওই বাসাতেই আছেন তার পিতা বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ গোলাম মোস্তাফা। তিনি নবাব সিরাজউদদৌলার ৮ম বংশধর। তার প্রয়াত স্ত্রী সৈয়দা হোসনেআরা বেগম ছিলেন নবাবের স্ত্রী লুৎফুননিসার রক্তের উত্তরাধিকার। এখানেই বাস করছেন তিনি এবং তার ২ ছেলে গোলাম আব্বাস আরেব ও ইমু এবং ২ কন্যা মাসুমা ও মুনমুন।

নবাব পরিবারের নবম বংশধর সৈয়দ গোলাম আব্বাস আরেবের পূর্ববর্তী বংশধরের কুষ্ঠি বিশ্লেষণ করে জানা যায়,
(১) নবাব সিরাজউদ্দৌলার মেয়ে উম্মে জোহরা ওরফে কুদসিয়া বেগম (প্রথম বংশধর),
(২) জোহরার ছেলে শমসের আলী খান (দ্বিতীয় বংশধর),
(৩) তাঁর ছেলে লুৎফে আলী (তৃতীয় বংশধর),
(৪) লুৎফের মেয়ে ফাতেমা বেগম (চতুর্থ বংশধর),
(৫) তাঁর মেয়ে হাসমত আরা বেগম (পঞ্চম বংশধর),
(৬) হাসমত আরার ছেলে সৈয়দ জাকি রেজা (ষষ্ঠ বংশধর),
(৭) তাঁর ছেলে সৈয়দ গোলাম মোর্তজা (সপ্তম বংশধর)
(৮) তাঁর ছেলে সৈয়দ গোলাম মোস্তফা (অষ্টম বংশধর)
(৯) এবং তাঁর ছেলে সৈয়দ গোলাম আব্বাস আরেব (নবম বংশধর)।

কিভাবে তারা নবাব সিরাজউদদৌলার বংশধর? বংশতালিকার সে হিসাব দিলেন গোলাম আব্বাস আরেব। ইরান থেকে ভাগ্য অন্বেষণে বাংলায় আসা নবাব আলীবর্দী খানের কোন ছেলে সন্তান ছিল না। তার ছিল ৩ কন্যা। ঘসেটি বেগম, ময়মুনা বেগম ও আমেনা বেগম। আলীবর্দী খানের বড় ভাই হাজী মির্জা আহমেদের ছিল ৩ পুত্র। মুহাম্মদ রেজা, মুহাম্মদ সাঈদ ও মুহাম্মদ জয়েনউদ্দিন। আলীবর্দী খানের ৩ কন্যাকে বিয়ে দেন তার ভাই হাজী আহমেদের ৩ পুত্রের সঙ্গে। মুহাম্মদ রেজার সঙ্গে বিয়ে দেন ঘসেটি বেগমের। মুহাম্মদ সাঈদের সঙ্গে ময়মুনা বেগমের এবং আমেনা বেগমের বিয়ে দেন জয়েনউদ্দিনের সঙ্গে। জয়েনউদ্দিন ও আমেনা বেগমের ৩ ছেলে ও ২ মেয়ে। তাদের বড় সন্তান নবাব সিরাজউদদৌলা, অপর ২ ছেলে হচ্ছেন ইকরামউদদৌলা ও মির্জা মেহেদি। ২ কন্যা আসমাতুন নেসা ও খায়রুন নেসা।

নবাব সিরাজউদদৌলা বিয়ে করেন ইরাজ খানের কন্যা লুৎফুননিসাকে। ইরাজ খানের পূর্বপুরুষরা ছিলেন মোঘল দরবারের কর্মকর্তা। সিরাজউদদৌলার একমাত্র কন্যা উম্মে জহুরা বেগম। সিরাজউদদৌলার যখন মৃত্যু হয় তখন উম্মে জহুরা শিশু। সিরাজ কন্যা জহুরা বেগমের বিয়ে হয় সিরাজের ভাই একরামউদদৌলার পুত্র মুরাদউদদৌলার সঙ্গে। তাদের একমাত্র পুত্র শমসের আলী। তার পুত্র সৈয়দ লুৎফে আলী। তার কোন ছেলে সন্তান ছিল না। তার একমাত্র কন্যা ফাতেমা বেগম। ফাতেমা বেগমের ২ কন্যা হাসমত আরা বেগম ও লুৎফুননিসা বেগম। লুৎফুননিসা নিঃসন্তান। হাসমত আরার ছেলে সৈয়দ জাকির রেজা। তার ছেলে সৈয়দ গোলাম মর্তুজা। সৈয়দ গোলাম মর্তুজার ছেলে এই সৈয়দ গোলাম মোস্তফা।

২৩শে জুন পলাশীর প্রান্তরে পরাজয়ের পর ২৫শে জুন নবাব সিরাজউদদৌলা স্ত্রী লুৎফুননিসা ও শিশুকন্যা জহুরা বেগমকে সঙ্গে নিয়ে আবার সৈন্য সংগ্রহ করে বাংলা উদ্ধার করতে বিহারের উদ্দেশে যাত্রা করেন। পথিমধ্যে ভগবানগোলায় ক্ষুধার্ত নবাব পরিবার দানা শাহ নামের এক লোকের বাড়িতে খাদ্য গ্রহণ কালে ওই ব্যক্তি মুর্শিদাবাদে খবর দিয়ে ধরিয়ে দেন নবাব সিরাজউদদৌলাকে। সেখানে গিয়ে মীর জাফরের ছেলে মিরন গ্রেপ্তার করে মুর্শিদাবাদে নিয়ে আসেন নবাবকে। বন্দি অবস্থায় ২রা জুলাই মোহাম্মদী বেগ হত্যা করে নবাবকে।

নবাবকে হত্যার পর তার স্ত্রী শিশুকন্যা সহ নানা আলীবর্দী খানের স্ত্রী আশরাফুন নেসাকে নৌকায় করে ভাগীরথীর তীর থেকে বুড়িগঙ্গার পাড়ে জিঞ্জিরার একটি প্রাসাদে তাদের আটকে রাখা হয় ৮ বছর। সেখান থেকে আবার তাদের মুর্শিদাবাদে নিয়ে মুক্ত করা হয়। নবাব সিরাজউদদৌলার মৃত্যুর পর থেকে তার ৫ম বংশধর পর্যন্ত কাউকে সরকারি কোন চাকরি দেয়নি বৃটিশ সরকার। নবাবের ৬ষ্ঠ বংশধর সৈয়দ জাকি রেজা ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহর কাছে এসে ধরনা দিলে ১৯১৩ সালের ১৬ই সেপ্টেম্বর তিনি বাংলার গভর্নরের নিকট তাকে একটি চাকরি দেয়ার জন্য অনুরোধ করে চিঠি লেখেন। চিঠিতে উল্লেখ করা হয় তিনি সিরাজউদদৌলার বংশধর। সে অনুরোধের প্রেক্ষিতে বৃটিশ সরকার সৈয়দ জাকি রেজাকে মুর্শিদাবাদের ডেপুটি সাব-রেজিস্টার পদে নিয়োগ দেন। তার পুত্র সৈয়দ গোলাম মর্তুজা চাকরি করতেন মুর্শিদাবাদের কালেক্টরেট বিভাগে।

সপ্তম বংশধর সৈয়দ গোলাম মুর্তজা ১৯৪৭ সালে মুর্শিদাবাদ থেকে পূর্ব বাংলায় চলে আসেন। প্রথমে আসেন রাজশাহীতে, রাজশাহী থেকে খুলনা শহরে একটি বাড়ি কিনে স্থায়ী হন।
১৯৮৪ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে প্রথিতযশা সাংবাদিক ফজলে লোহানী তার জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান (বিটিভি-তে প্রচারিত) ‘যদি কিছু মনে না করেন’-এ জনাব সৈয়দ গোলাম মুর্তজা-কে পরিচিত করিয়ে দেন। গোলাম মর্তুজার ছেলে সৈয়দ গোলাম মোস্তাফা পাকিস্তান আমলে চাকরি নেন বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী পদে। তিনি এখন ছেলে সন্তান সহ বসবাস করছেন ঢাকা শহরে। তার বড় ছেলে সৈয়দ গোলাম আব্বাস আরেব সমাজের গুণীজন, বিত্তবান সহ সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছেন তারা নবাব সিরাজউদদৌলার নামে একটি একাডেমী স্থাপন করতে চান। সে জন্য সহযোগিতার প্রয়োজন। ঢাকা শহরে বসবাস করা নবাব সিরাজউদদৌলার বংশধরদের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে এখনও কি যেন এক ধরনের অজানা আতঙ্ক তাদের মাঝে। সম্ভবত সে আতঙ্ক থেকেই অন্তর্মুখী প্রচারবিমুখ হয়ে আছেন তারা। মিডিয়াকে এড়িয়ে চলেন, সমাজে নিজেদের পরিচয় লুকিয়ে রাখেন। ভারত সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মীর জাফরের বংশধররা স্ব-স্ব পরিচয় দিয়ে দাপটে আছেন। জানা গেছে, তারা আছেন বাংলাদেশেও।

(মানবজীবন পত্রিকা থেকে কিছু তথ্য সংগ্রহীত , পরিমার্জিত এবং নিজ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে লেখা)

Giasliton007_1310119860_1-Nobab_Shiraj

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!