সুইস ব্যাংক ও ‘ঠাকুর ঘরে কে রে…’ -গোলাম মোর্তোজা
রাজনীতিবিদরা ‘রাজনৈতিক বক্তব্য’ বলে এমন একটি টার্ম তৈরি করেছেন, যা দিয়ে যে কোনো কথা বলতে পারেন। তার কোনো অর্থ থাক বা না থাক, অসত্য হলেও সমস্যা নেই। দলীয় অনুসারীরা বলতে শুরু করেন ‘এটা তার রাজনৈতিক বক্তব্য’ ছিল। বিষয়টি এমন যেন, ‘রাজনৈতিক বক্তব্যের’ সঙ্গে সত্যের কোনো সম্পর্ক নেই।
ঈদ পরবর্তী দুটি সংবাদ আলোচনায়-
ক. সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের টাকা
খ. আওয়ামী লীগের কারও টাকা সুইস ব্যাংকে নেই।
এই দুটি বিষয় নিয়ে সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা।
১. জানা তথ্য, আরও একবার বলছি।
সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমার পরিমাণ সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী ৫৫৬৬ কোটি টাকা। সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা অর্থের বিষয় নিয়ে কয়েক বছর আগে যখন আলোচনা শুরু হয়, তখন ক্ষমতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকে অন্য সব বিষয়ের মতো এক্ষেত্রেও বলতে শুরু করেন, পৃথিবীর অনেক দেশের টাকাই সুইস ব্যাংকে চলে যায়। উদাহরণ হিসেবে সামনে আনেন ভারতের প্রসঙ্গ। ভারত বা অন্য দেশের প্রসঙ্গ সামনে এনে বোঝানোর চেষ্টা হয়, এটা খুব বড় কিছু নয়। দেশের টাকা পাচার করে সুইস ব্যাংকে রাখা পৃথিবীব্যাপী মোটামুটি একটি স্বাভাবিক বিষয়।
সুইস ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাবেও ভারতের প্রসঙ্গ আছে। আছে পাকিস্তানের প্রসঙ্গও। সুইস ব্যাংকে ভারতীয়দের জমার পরিমাণ ৪৫০০ কোটি টাকা। বিশালত্বের দিক দিয়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনীতির কোনো তুলনাই চলে না। কিন্তু সুইস ব্যাংকের টাকার হিসাবে বাংলাদেশ ভারতের চেয়েও এগিয়ে। সুইস ব্যাংকে ভারতীয়দের চেয়েও ১১০০ কোটি টাকা বেশি রেখেছে বাংলাদেশিরা।
পাকিস্তান এক্ষেত্রে বাংলাদেশ বা প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের চেয়ে অনেক এগিয়ে আছে। পাকিস্তানের জমা অর্থের পরিমাণ ৯৫০০ কোটি। পাকিস্তান, ভারতের চেয়ে আবার এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। সুইস ব্যাংকে জমা রাখা অর্থের পরিমাণ ভারতীয়দের কমেছে ৪৫%। পাকিস্তানিদের কমেছে ৬%। আর বাংলাদেশিদের বেড়েছে প্রায় ২০%। প্রায় ব্যর্থ রাষ্ট্র পাকিস্তানের প্রসঙ্গটি এখানে আলোচনায় আনছি না। মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই টাকা পাচার নিয়ে সোচ্চার ছিলেন। ক্ষমতায় এসেও সেই ধারা অব্যাহত রেখেছেন। ফলে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণভাবে সুইস ব্যাংকে ভারতীয়দের টাকা রাখার পরিমাণ কমাতে সক্ষম হয়েছেন।
২. ভারতীয়রা ৪৫% কমাতে পারল, বাংলাদেশিরা ২০% বাড়িয়ে দিল, কারণ কী? কারণ ভারত সরকার তার নীতিতে কঠোরতা এনেছে। ভারতীয়রা নিরুৎসাহিত এবং কিছুটা ভয় পেয়েছে টাকা পাচারের ক্ষেত্রে। বাংলাদেশ কী নীতি নিল যে, ২০% বেড়ে গেল? ‘অর্থনীতি বড় হলে, চুরিও বাড়ে’- এই হলো আমাদের অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য। ‘পুকুর নয়, সাগর চুরি হচ্ছে’- এটাও বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য। আর্থিক খাতের সর্বত্র ‘সাগর চুরি’ বিষয়টি দৃশ্যমান হয়েছে। প্রায় কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এই বাক্যটি দেখে একদল তোষামোদকারী হইচই করে ক্ষেপে উঠবেন। বলবেন ‘সবক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে’। হ্যাঁ, এক অর্থে বলা যায় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। যিনি মূল চোর বা সাগর চোরদের গডফাদার, তাদের বাদ দিয়ে কেরানি পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ‘সাগর চোর’ বা তাদের গডফাদারদের নাম-পরিচয় জানা গেছে, তার বা তাদের বিষয়ে তদন্ত হয়নি। বেসিক ব্যাংকের ক্ষেত্রে শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর নাম অর্থমন্ত্রী নিজে সংসদে একাধিকবার বলেছেন, কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক ঘটনায় সেই উপদেষ্টার বিষয়টি তদন্তে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। ‘সাগর চুরি’র প্রতিটি ঘটনা সুনির্দিষ্ট করে দেখানো যায়। প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সেই বস্তাভর্তি ৭০ লাখ টাকার দৃশ্যমান তদন্ত হয়নি। ড্রাইভারকে গণমাধ্যম খুঁজে পেলেও, তদন্তকারীরা সন্ধান পাননি।
বাংলাদেশ সরকারের নীতি ‘সাগর চোর’দের ক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছে। দেশের ব্যাংক, আর্থিক খাতসহ অন্যান্য খাত থেকে নির্বিঘেœ অর্থ চুরি করেছে। সেই অর্থের একটা ‘ছোট’ অঙ্ক সুইস ব্যাংকে চলে গেছে।
অর্থমন্ত্রী যেমন ৪ হাজার কোটি টাকা তেমন কোনো টাকা নয় বলেছিলেন, ৫৫৬৬ কোটি টাকাকেও তেমন কোনো টাকা নয় বলছি। কেন বলছি? পাচার হওয়া মোট অর্থের পরিমাণের কাছে, এই টাকা আসলেই বড় অঙ্কের টাকা নয়! প্রতি বছর এদেশ থেকে এখন গড়ে ৭০ থেকে ৭৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়। সেখানে সুইস ব্যাংকে রাখা টাকার পরিমাণ মাত্র ৫৫৬৬ কোটি!
৩. এবার আসি ‘আওয়ামী লীগের কারও টাকা সুইস ব্যাংকে নেই’ ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য প্রসঙ্গে। সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশি কারা টাকা রেখেছেন, এটা জানা খুব সহজ না। এ কারণেই সুইস ব্যাংকে টাকা রাখে। কোন দেশের কত টাকা এসব তথ্যও আগে সুইস ব্যাংক জানাত না। এখন জানায়। সরকার খুব আন্তরিকভাবে চেষ্টা করলে টাকা রাখা ব্যক্তিদের নাম শনাক্ত করতে না পারলেও, নিরুৎসাহিত করতে পারত। ভারত যেমন পেরেছে।
সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের টাকার বিষয়টি নিয়ে সরকার কোনো তদন্ত করেছে, এমন কিছু জানা যায়নি। এই তদন্ত গোপনে করার কথা নয়। যদি গোপনে করেও থাকে তা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করার কথা। আর তদন্তে তো শুধু এই তথ্যই বেরিয়ে আসবে না যে, ‘আওয়ামী লীগের কারও টাকা নেই’। ‘আওয়ামী লীগের কেউ নয়’- সেটা যদি জানা যায়, তবে কারা জমা রেখেছে সেটাও জানা যাওয়ার কথা।
ধরেই নেয়া যায় আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক, সড়ক ও সেতুমন্ত্রী দায়-দায়িত্বহীন অনেক বক্তব্যের মতো, সুইস ব্যাংকের অর্থ নিয়েও তেমন বক্তব্যই রেখেছেন। এটা অনেকটা ‘ঠাকুর ঘরে কে রে…’র মতো হয়ে গেছে।
৪. ‘সুইস ব্যাংকে আওয়ামী লীগের কারও টাকা নেই’ বললেই দায়মুক্ত হওয়া যায়?
দেশকে ‘উন্নয়ন’র জোয়ারে ভাসিয়ে দিচ্ছেন আপনারা। ৩০০ কোটি টাকার কাজের বাজেট বাড়িয়ে ১৫০০ কোটি টাকা করছেন আপনারা। ৮ হাজার কোটি টাকার নির্মাণ বাজেট হয়ে যাচ্ছে ২৮ হাজার কোটি টাকা। এসব নির্মাণ কাজের সঙ্গে কারা জড়িত? আপনারা বাজেট বাড়াচ্ছেন। এসব কাজ কি বিএনপি-জামায়াত করছে? এসব ‘উন্নয়ন’ কাজের প্রতিটি করছে আওয়ামী লীগের লোকজন। বেসিক ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক কারা লুট করল? শেয়ারবাজারের লুটপাটের সঙ্গে কারা জড়িত? দেশের সব মানুষ তো নাম জানেন, পরিচয়ও জানেন। আপনাদেরই অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকার খন্দকার ইব্রাহীম খালেদ বলছেন, ‘ব্যাংকসহ আর্থিক খাতের লুটপাটের টাকাই সুইস ব্যাংকে রাখা হয়েছে’।
যুক্তি ছাড়া ‘উন্নয়ন’ কাজের বাজেট বাড়াচ্ছেন আপনারা। ব্যাংকের অর্থ জালিয়াতি করে যারা নিয়ে গেল, তারাও আপনাদের লোক। আপনাদের অর্থনীতিবিদও বলছেন, সেই সব টাকাই সুইস ব্যাংকে রাখা হয়েছে। ‘আওয়ামী লীগের কারও টাকা নেই’ তো কার টাকা আছে? বিএনপি-জামায়াত না হেফাজতের?
বিরোধী দলের একেকজন নেতার নামে এক-দেড়’শ মামলা দিয়েছেন। বর্তমান সময়ের টাকা পাচারের কোনো মামলা বিরোধী দলের কারও নামে করেননি। তারেক জিয়া, কোকোর টাকা পাচার নিয়ে কথা বলেন, কোকোর টাকা ফিরিয়ে আনা নিয়েও কথা বলেন। বলাটা অন্যায় বলছি না। ২২ কোটি টাকা ফিরিয়ে এনে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু প্রতি বছর ৭৬ হাজার কোটি টাকা পাচার নিয়ে চুপ থাকেন কেন? সরকার চালান আপনারা। মুখে বলেন বিএনপি শেষ। তো টাকা পাচার করে কারা? যে দল শেষ হয়ে গেছে, সেই দল আপনারা ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় টাকা পাচার করছে? আপনারা কিছুই করতে পারছেন না?
হাওরে বন্যার দায় বিএনপির, পাহাড় ধস হয় বিএনপির কারণে, চালের দাম বাড়ায় বিএনপি, তো আপনারা করেন কী? সবই যদি বিএনপি করে, ক্ষমতায় আপনারা থাকছেন কেন?
৫. জানি প্রশ্নের উত্তর দেয়ার মতো অবস্থায় সরকার নেই। সব কিছু চলছে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে। গরিব প্রবাসী কর্মীরা টাকা পাঠাচ্ছেন, সেই টাকা পাচার করছে প্রভাবশালীরা। প্রভাবশালীরা সব সময় সরকারি দলের বা সরকার সংশ্লিষ্ট হয়। যে কৃষক বিরতিহীনভাবে উৎপাদন করেন, তার ঘাড়েও এখন ৪৬ হাজার টাকার ঋণ। এই ঋণের অর্থই ‘সাগর চুরি’ হয়ে পাচার হয়ে যাচ্ছে। সুইস ব্যাংকে যাচ্ছে। গল্পের ‘উন্নয়ন’ আর বাস্তবতার ‘সাগর চুরি’র মাঝে আটকে গেছে বাংলাদেশ।
প্রবৃদ্ধির অঙ্ক আশা জাগায়। দুর্নীতি-অনিয়ম, টাকা পাচার সেই ‘আশা’কে হত্যা করে।
গোলাম মোর্তোজা : সম্পাদক, সাপ্তাহিক।
s.mortoza@gmail. com
- প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। কাগজ২৪-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য কাগজ২৪ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।