‘সৌদি আরব ইসরাইলের হয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে কাজ করছে’
অনলাইন ডেস্ক । কাগজটোয়েন্টিফোরবিডিডটকম
সিরিয়ায় আক্রমণের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে আমেরিকার নিজ দেশের জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেয়া। নিজেদের খারাপ অবস্থা ধামাচাপা দেয়া।সিরিয়ায় মার্কিন হামলার কোনো যৌক্তিকতা নেই। আর রাসায়নিক হামলার অভিযোগ সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও অসত্য। রেডিও তেহরানকে দেয়া সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করেছেন সিনিয়র সাংবাদিক, রাজনৈতিক ভাষ্যকার ও সাপ্তাহিকের সম্পাদক গোলাম মোর্তজা।
তিনি আরো বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি তাবেদার রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে ব্রিটেন। তার নিজস্ব কোনো নীতি-আদর্শ নেই। আর মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরব ইসরাইলের হয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে কাজ করছে।
রেডিও তেহরান: জনাব গোলাম মোর্তজা, রাসায়নিক হামলার অভিযোগ তুলে সিরিয়ায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে আমেরিকা, ব্রিটেন ও ফ্রান্স। অনেকে বলছেন, শক্তি প্রদর্শনের জন্য এ হামলা চালিয়েছে আমেরিকা। আপনি কীভাবে দেখছেন?
গোলাম মোর্তজা: হ্যাঁ, শক্তি প্রদর্শন প্রধান একটি বিষয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের মতো দেশে যখন সংকট থাকে, সেখানকার সরকার যখন নানারকম বিপদে বা বিব্রতকর অবস্থায় থাকে তখন তারা দৃষ্টি ঘোরানোর জন্য বিভিন্ন দেশকে আক্রমণের লক্ষ্য বস্তুতে পরিণত করে। কখনও আফগানিস্তান, কখনও ইরাক আর এখন সিরিয়া। অবশ্যই শক্তি প্রদর্শনের জন্য এবং নিজের খারাপ অবস্থা চাপা দেয়ার জন্য এসব আক্রমণ করা হয়।
আপনারা যদি একটু পেছনের দিকে তাকান তাহলে দেখতে পাবেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেয়ার পরই থেকে মি. ডোনাল্ড ট্রাম্প বিপদের মধ্যে আছেন। তাছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে নানাবিধ কেলেঙ্কারির কারণে সেই বিপদের পরিমাণ আরো বেড়েছে। আর সেরকম একটি পরিস্থিতিতে ইউরোপের কিছু শক্তিকে সাথে নিয়ে তিনি সিরিয়ায় ক্ষেপনাস্ত্র হামলা চালালেন।
সিরিয়ায় আক্রমণের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে নিজ দেশের জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেয়া।
আরেকটি কারণ হচ্ছে, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আসাদকে যেহেতু আমেরিকা বা ইউরোপ তাদের মতো করে চালাতে পারছেন না এবং আসাদের মতো শক্ত মানুষ সেখানে ক্ষমতায় থাকলে যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপ যা ইচ্ছে তাই করতে পারে না। তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থ থেকে শুরু করে সামরিক স্বার্থ, ইসরাইলের স্বার্থ ও সৌদি আরবের স্বার্থ যেভাবে দেখা দরকার সেভাবে দেখতে না পারার কারণেই তারা সিরিয়ায় হামলা করেছে। আর সেই আক্রমণের ধারাবাহিকতায় তারা সিরিয়ার বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র বা জীবাণু অস্ত্র প্রয়োগের অভিযোগ তুলেছে।
রেডিও তেহরান: রাসায়নিক হামলার অভিযোগে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হলেও এ ব্যাপারে কিন্তু আমেরিকা বা তার মিত্ররা কোনো প্রমাণ তুলে ধরতে পারে নি। তাহলে মার্কিন হামলার যৌক্তিকতা কী?
গোলাম মোর্তজা: আসলে সিরিয়ায় মার্কিন হামলার কোনো যৌক্তিকতা নেই। তারা প্রথমে অভিযোগ তুলেছে আসাদের সেনাবাহিনী নিরীহ নাগরিকের ওপর রাসায়নিক হামলা চালিয়েছে। পশ্চিমা প্রচার মাধ্যম কিছু ছবি দেখিয়ে এটা প্রমাণ করার চেষ্টা করছে যে নিরীহ মানুষের ওপর তারা রাসায়নিক হামলা চালিয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে কয়েকটি ছবি দেখিয়ে বলা হচ্ছে মানুষের ওপর আসাদ সরকার রাসায়নিক অস্ত্র হামলা চালিয়েছে কিন্তু এটিই তো উপায় নয়। এটির জন্য বৈজ্ঞানিক প্রমাণের প্রয়োজন ছিল, ল্যাবে এবং বিষেজ্ঞদের দিয়ে প্রমাণের দরকার ছিল। যেহেতু তারা জানত যে তাদের যে অভিযোগ সেটি প্রমাণ করা যাবে না। তাছাড়া অভিযোগ প্রমাণের জন্য যে সময় দেয়া দরকার সেই সময়ের জন্যও তারা অপেক্ষা না করেই আক্রমণ চালিয়েছে।
আমেরিকার দাবি তারা সিরিয়ার রাসায়নিক অস্ত্রাগার গুড়িয়ে দিয়েছে। রাসায়নিক অস্ত্র এমন একটি অস্ত্র যা গুড়িয়ে দেয়া হলে সেটি আরো বেশি বিপজ্জনক হয়ে পড়ে। যে রাসায়নিক অস্ত্রাগার গুড়িয়ে দিয়েছে বলে আমেরিকা দাবি করছে সেটার পাশ দিয়ে মানুষ চলাচল করছে। সেই ধ্বংস্তূপের কাছে দাঁড়িয়ে সংবাদকর্মীরা সংবাদ সংগ্রহ করছেন। কেউ কিন্তু জীবাণু অস্ত্র বা রাসায়নিক অস্ত্রের গ্যাসে বা জীবাণুতে আক্রান্ত হন নি। সুতরাং তাদের অভিযোগ সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও অসত্য ছিল তা এরইমধ্যে প্রমাণ হয়ে গেছে।
রেডিও তেহরান: সিরিয়ায় হামলা চালানোর পর ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে এবং ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাকরন নিজ নিজ দেশে বিরোধীদলগুলোর তোপের মুখে পড়েছেন। এ অবস্থায় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথায় তিনি সিরিয়া হামলায় অংশ নিয়েছেন। তাহলে কী ব্রিটেন তাবেদার রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে বলে মনে হয়?
গোলাম মোর্তজা: দেখুন, ব্রিটেনের এই তাবেদার অবস্থান ও মানসিকতা তো শুধু আজকের নয় আপনারা যদি ইরাক আক্রমণের সময়কার কথা মনে করেন তাহলে দেখতে পাবেন আসলে ব্রিটেন কী! সে সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অসত্য তথ্যের ভিত্তিতে ইরাক আক্রমণ এবং ব্রিটেন সেই আমেরিকার পক্ষে বলা চলে নিরঙ্কুশভাবে সমর্থন দিয়ে সাথে থেকে নাশকতা ও ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম চালিয়েছিল। গত দশ পনের বছর ধরে দেশটি ধারাবাহিকভাবে একটি তাবেদার রাষ্ট্রের ভূমিকা পালন করছে। ফলে বলা চলে সত্যিকারার্থে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি তাবেদার রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে ব্রিটেন। তার নিজস্ব কোনো নীতি-আদর্শ নেই।
রেডিও তেহরান: সিরিয়ায় পশ্চিমা ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ঘটনাকে তুরস্ক, কাতার ও সৌদি আরব স্বাগত জানিয়েছে। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
গোলাম মোর্তজা: দেখুন, এটি মধ্যপ্রাচ্য বা মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর একধরনের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির চিত্র। মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশগুলো নিজেরা যেহেতু একধরনের রাজতন্ত্র নির্ভর সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে আছে আর রাজতন্ত্র নির্ভর সমাজ ব্যবস্থায় যেহেতু জনগণের মতামতের প্রতিফলন ঘটে না। আর তাই রাষ্ট্রপ্রধানরা ক্ষমতায় থাকার জন্য পরাশক্তিগুলোর আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থাকেন এবং দেশের সম্পদ নানাভাবে পরাশক্তিগুলোর হাতে দিয়ে দেয় ও তাদেরকে নিয়ে যাওয়ারও সুযোগ করে দিয়ে তারা ক্ষমতায় থাকেন। তারা জনমানুষের বিপক্ষে গিয়ে নিজেদের ক্ষমতায় থাকার স্বার্থে সিরিয়ায় হামলাকে স্বাগত জানিয়েছে।
এই ধরুন বর্তমানে সৌদি আরবের অবস্থান। সৌদি আরব মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব দেয়ার কথা বলে, মুসলমানরা সৌদি আরবকে নেতা বলে মনে করে, সৌদি আরব তাদের কাছে পবিত্র ভূমি সেই সৌদি আরব ইসরাইলের সাথে গোপনে নানাধরনের সম্পর্ক উন্নয়ন করছে। তারা মুসলমানদের স্বার্থবিরোধী কার্যক্রম চালাচ্ছে। সৌদি আরব তার আকাশসীমা ব্যবহার করতে দিচ্ছে ইসরাইলকে। গোপনে ইসরাইলের সঙ্গে একাধিকবার মিটিং করেছে। এসব তথ্য তো মোটামুটিভাবে সবার জানা। সুতরাং যেসব দেশের কথা আপনি বললেন তারা আসলে মুসলিম বিশ্বের স্বার্থ দেখছে না। ওইসব দেশের সরকার তাদের নিজেদের এবং তাদের পরিবারের স্বার্থের জন্য কাজ করছে আর বিরোধীতা করছে মুসলিম বিশ্বের। তারা ইসরাইলের পক্ষে কাজ করছে। আর এসব করতে গিয়ে তারা বিশ্বমানবতার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করছে। এসব দেশ মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলের পরামর্শে মুসলিম বিশ্বে শক্তিশালী দেশের মধ্যে অন্যতম ইরানকে কোণঠাসা করার জন্য এসব কাজ করছে।
রেডিও তেহরান: জনাব গোলাম মোর্তজা সবশেষে জানতে চাইবো-সিরিয়ায় সম্প্রতি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানোর বিরুদ্ধে হুঁশিয়ার উচ্চারণ করেছিল রাশিয়া। কিন্তু পরবর্তীতে দেশটি সরাসরি কোনো সংঘাতে যায় নি। এ নিয়ে গণমাধ্যমে নানা আলোচনা-সমালোচনা চলছে। আপনি কী বলবেন?
গোলাম মোর্তজা: দেখুন, আমেরিকা, রাশিয়া কিংবা ইউরোপের দেশ বলেন এরা কেউই আসলে মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের মুসলিম দেশগুলোর স্বার্থরক্ষার জন্য কাজ করে না। রাশিয়াও করে না , আমেরিকাও না।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিপরীতে সিরিয়াতে রাশিয়ার আগমন এবং সিরিয়া সরকারের পক্ষে অবস্থান নেয়া ও আইএসআইএল সন্ত্রাসীগোষ্ঠী দমনে কাজ করার বিষয়টি আপাতদৃষ্টিতে সিরিয়া এবং বাশার আসাদ সরকারের পক্ষে কিন্তু এর নেপথ্যের তাৎপর্য একটু ভিন্নরকম। সেটি হচ্ছে পুরো মুসলিম বিশ্বের এই অঞ্চল থেকে রাশিয়া প্রায় আউট হয়ে যাচ্ছিল অর্থাৎ রাশিয়ার স্বার্থ এই অঞ্চলে রক্ষিত হচ্ছিলো না। সে কারণে রাশিয়া আসাদের পক্ষ নিয়ে এখানে এসেছে। তারা যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপকে এটা বোঝাতে চায় যে এ অঞ্চলের সম্পদের অধিকার এবং লুটপাট শুধুমাত্র তোমরা একাই করতে পারবে না।
অর্থাৎ ইউরোপ এবং আমেরিকার সাথে দরকষাকষির আলোচনায় যাতে রাশিয়া থাকে সে কারণে রাশিয়া এসেছে সিরিয়ায়। এমনকি রাশিয়া আরো বেশ শক্তিশালী অবস্থান নেবে সিরিয়ার পক্ষে। এর কারণ আবারও বলছি সিরিয়ার এবং এ অঞ্চলের সম্পদের ওপর যাতে রাশিয়ার ভাগ থাকে , তার হিস্যা যাতে নিশ্চিত হয়। আমাদের দুর্ভাগ্য যে মুসলিম দেশগুলো কখনও তাদের নিজেদের স্বার্থের জায়গাটা বুঝতে পারে না। এ অঞ্চলের বেশিরভাগ সরকার রাজতন্ত্র নির্ভর হওয়ার কারণে তারা বিশ্বের শক্তিশালী রাষ্ট্র আমেরিকা এবং ইউরোপের তাবেদার হয়ে থাকতে চায় এবং ওইসব দেশগুলো মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে তাদের তাবেদার শক্তিকে ক্ষমতায় রেখে তাদের স্বার্থ হাসিল করতে চায়। ফলে ওইসব দেশে ক্ষমতাসীনরা জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করে থাকে।
ফলে আমেরিকা, ইউরোপ কিংবা রাশিয়া তারা পরস্পরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করে থাকে মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে। তবে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট জায়গায় যখন নিজেদের মধ্যে বিরোধ তৈরি হয়েছে তখন রাশিয়া সিরিয়ার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। রাশিয়ার আচরণে আসাদ বা মুসলমানদের খুশি হওয়ার খুব বেশি কারণ নেই বলে আমি মনে করি।