স্মৃতিতে একাত্তরের দিনগুলি (তিন)
স্মৃতিতে একাত্তরের দিনগুলি (তিন)
সিডনীর কথকতা-১৪
রণেশ মৈত্র (সিডনী থেকে)
সভাপমতিমন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ
দেশ থেকে যুদ্ধ কালীন জরুরী ও গোপন দায়িত্ব পালনে এডভোকেট আমজাদ হোসেন সহ কলকাতার কালীঘাটে পৌঁছে গেলাম যেদিন সেদিন এপ্রিলের দুই তারিখ সন্ধ্যা। মেজদী পরিমল মৈত্রের ভাড়া নেওয়া বাসার তেতলার চিলাকোঠায় ছোট্ট কিন্তু সুন্দর একটি রুমে খুবই আরামে থাকার সুযোগ পেয়েছিলাম। আমজাদ ভাই তো বড্ড খুমী। বলেই উঠলেন রাতের খাবারের পর-বিনা পয়সায় থাকা ও এহেন খাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারবেন এই কলকাতা শহরে এমনটিতো ভ্রুনাজ্ঞরেও চিন্তা করতে পারি নি রনেশবাবু। হ্যাঁ তৎকালীন পরিস্থিতিতে এমন একটি আন্তরিক ব্যবস্থার কথা সত্যিই আগে থেকে ভাবা যায় নি।
যা হোক আগের দিনের কথামত পরদিন সকালে মেজদা ডেকে আনলেন ঐ এলাকার সি.পি.আই.এর এক তরুণ কর্মীকে। তাকে বললাম, আমাদের প্রাদেশিক কমিটির কোন নেতা এদিকে থাকলে তাঁর সাথে একটু দেখা করিয়ে দিন জরুরী ভিত্তিতে আমরা দেশে মুক্তিযুদ্ধ করছি তা নিয়ে কথা বলবো। কর্মীটি বললেন, “আমি তা হলে সন্ধ্যায় আসবো কোলকাতা জেলা কমিটির সম্পাদকের বাসায় নিয়ে যাব। উনি শুনে পরবর্তী ব্যবস্থা নেবেন।” বললাম, “দেবরী তো করতে পারছি না-এখুনি নিয়ে চলুন না।” কর্মীটির উত্তরে জানা গেল, উনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েরে অধ্যাপক – বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবেন – তাই তাঁকে সকালে বাসায় পাওয়া যাবে না।
অগত্যা “তথাস্তু” বলে কর্মীটিকে ছেড়ে দিলাম। সারাদিন আকাশ বানী, বিবিসির খবর শুনা আর রীতিমত খাওয়া দাওয়া। এভাবেই দিনটি কাটানোর পর সন্ধ্যায় সি.পি.আই. কর্মীটি ঠিক চলে এলেন আমাদেরকে কলকাতা জেলা কমিটির সম্পাদক আশুতোষ বাবুর বাসায় নিয়ে যাবার জন্য। তিনি সমাদরে বসতে দিলেন সব শুনে বললেন, চা খেয়ে চলুন এখুনি আমাদের রাজ্য কমিটির সদসন্য কমরেড ইলা মিত্রের বাসায়। কয়েক মিনিটেই চা-নাস্তা সেরে রওনা হলাম কিংবদন্তী নেত্রী ইলা মিত্রের মধ্য কলকাতার বাসায়।
আশুতোষ বাবু তাঁর গাড়ী করেই নিয়ে গেলেন-ফোনে আগেই ইলাদিকে জানিয়েছিলেন আমাদের কথা। গিয়ে আবার খানীকটা বলতেই দেখি কমরেড রমেন মিত্র সি.পি.আই. এর রাজ্য সম্পাদক বিশ্বনাথ মুখার্জীর সাথে আমাদের ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলছেন। অত:পর রমেন দা জানালেন, ব্যাপারটা তো সরকারী পর্য্যায়ের পশ্চিম বাংলার রাজ্য সরকার তোমাদের আন্দোলন সংগ্রামের পাশে আছে। বিশ্বনাথ আমাদের রাজ্য সম্পাদক কিন্তু তাঁকে সন্ধ্যার আগে থেকেই যেতে হয় গোপন আস্তানায়। তাই কাল সকাল সকাল এসো-উনি তোমাদেরকে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে নিয়ে যাবেন। এখন ওর পক্ষে এখানে আসা নিরাপদ না।
এখানে উল্লেখ করতেই হয়, পশ্চিম বাংলার রাজ্য মুখ্যমন্ত্রী ঐ সময়ে ছিলেন অজয় মুখার্জী। তিনি তৎকালীন বাংলা কংগ্রেসের (কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে আসা একটি অংশ) নেতা। উপ-প্রধান মন্ত্রী ছিলেন জাতীয় কংগ্রেসের নেতা বিজয় সিং নাহার। অর্থাৎ উভয় কংগ্রেসের কোয়ালিশন এবং সি.পি.আই.এর সমর্থিত ছিল ঐ সরকার। সেই সি.পি.আই. এর প্রধান নেতা থাকেন রাতের বেলায় গোপন আস্তানায়। বিষয়টি আশ্চার্য্য জনক মনে হলেও সে সময়ের বাস্তবতা ঐ রাজ্যে তেমনই ছিল। বিশেষ করে কলকাতায় এবং পশ্চিম বাংলার কয়েকটি জেলায়।
নকশাল পন্থীরা সশস্ত্র। তারা গেরিলা কায়দায়, আবার কখন বা প্রকাশ্যে, সি.পি.আই. নেতাদেরকে সুযোগ পেলেই গুলি করে হত্যা করে। তাই দলীয় সিদ্ধান্ত মোতাবেক দলীয় নেতাদের রাতেদর বেলায় অন্তত: গোটন ডেরাতেই থাকতে হতো। চলাফেরা করতে হতো সতকর্তার সাথে।
অগত্যা আবার কালীঘাট পৌঁছে দিলেন আশুতোষ বাবু। পরদিন ট্যাক্সী ভাড়া করে সকাল সকাল দু’জন গিয়ে পৌঁছালাম কমরেড ইলা মিত্রের ফ্ল্যাটে। ঠিক সময়মত বিশ্বনাথ মুখাজী এসে পৌঁছালেন। কয়েক মিনিট বসেই তাঁর গাড়ীতে করে আমজাদ ভাই ও আমাকে সহ নিয়ে গেলেন দ্বারাভাঙ্গা বিল্ডিংসের মুখ্যমন্ত্রীর সরকারী কার্য্যালয়ে। বিশ্বনাথ বাবু দ্রুত মুখ্যমন্ত্রী ও উপ-মুখ্য মন্ত্রীকে আমাদের রাজনৈতিক পরিচয় জানিয়ে বললেন, এঁদের রাজনৈতিক পরিচিতি ও বিশ্বস্ততা নিয়ে সন্দেহের কারণ নেই সে দায়িত্ব আমার । তাই এখন এঁদের বক্তব্য শুনে যা বলার বলে দিন। তবে আমাদের পার্টি চায় এই মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে সরকার কাজ করুক। বলেই তিনি পাশের রুমে দিয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষায় থাকলেন।
এবারে পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখার্জী, তাঁর উপ-মুখ্যমন্ত্রী বিজয় সিংহ নাহার, আমজাদ সাহেব ও আমি মুখ্য মন্ত্রীর সরকারী কার্য্যালয়ে বসে পাবনার ও সারা বাংলার (যতটুকু তথ্য তখন পর্য্যন্ত নানা সূত্রে জানতে পেরেছিলাম) সবিস্তারে তুলে ধরলাম। পূরোপূরি সময় দিয়ে এবং গভীর মনোযোগ ও আগ্রহ সহকারে মুখ্য মন্ত্রী আমাদের সমস্ত কথাশুনে জানতে চাইলে এখন আমাদের কি কি সহযোগিতা প্রয়োজন। আরও বললেন, “পশ্চিমবাংলার সরকার অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে আপনাদের পাশে আছে।” ধন্যবাদ জানিয়ে আমরা বললাম, পাবনাতে এখন স্বাধীন বাংলাদেশ প্রশাসন চলছে ৩০ মার্চ থেকে। কিন্তু আশংকা আমাদের, পাকিস্তানী সেনাবাহিনী সত্বরেই দ্বিতীয় দফা হামলা করে বসবে অনেক বেশী সৈন্য বল এভং আরও বেশী আধুনিক অস্ত্রদিতে সাজ্জিতদ হয়ে। সেই দ্বিতীয় দফায় হামলা প্রতিরোধ-আমাদের করতেই হবে। না হলে পাবনার প্রশাসন, পাবনার মুক্তিযোদ্ধারা এবং পাবনার মানুষকে বাঁচানো যাবে না। আর তা করতে হলে আপনাদের কাছে আমাদের একান্ত আকাংখা, সেনাবাহিনী থেকে বেশ কিছু প্রশিক্ষক এবং প্রয়োজন মত ভারী অস্ত্র দিন এবং তাতে যেন আদৌ বিলম্ব না ঘটে।” সঙ্গে এও বললাম, পাবনায় দ্বিতীয় দফা হামলা যদি তারা সফলভাে করতে পারে, পারে, গোটা উত্তরবঙ্গও বিপদাপন্ন হয়ে পড়বে।
অজয় মুখার্জী বললেন, “আপনাদের বক্তব্য পরিস্কার। যে দু’টি সহযোগিতা চেয়েছেন তা নেহায়েতই যৌক্তিক কিন্তু পূরা বিষয়টি কেন্দ্রীয় সরকারের এখতিয়ারাধীন। প্রধানমন্ত্রী স্ত্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীও আপনাদের প্রতি সহানুভূতিশীল। তবে আমাদের অসুবিধা হলো মাত্র ৩/৪ দিন আগে আমরা (বর্তমান মন্ত্রীসভা) শপথ নিয়ে ক্ষমতায় বসেছি। প্রধানমন্ত্রীর সাথে আমার হটলাইন এখনও স্থাপিত হয় নি। হলে এখুনি তাঁর সাথে কথা বলতাম। তবে হটলাইন দু’তিন দিনের মধ্যেই বসবে। বসার সাথে সাথেই স্ত্রীমতি গান্ধীকে আপনাদের সমস্যা জানায় এবং আশা করি তিনি ব্যবস্থা করবেন। আপনারা আপনাদের ঠিকানা রেখে যান। দিল্লীর সাথে কথা হলেই আপনাদেরকে এসে তাঁদের মতামত জানাব।”
আমরা আমাদের বাসার ঠিকানা এবং সংলগ্ন সুপরিচিত একটি দোকানের ল্যান্ড ফোনের নম্বর মুখ্যমন্ত্রীর হাতে দিয়ে নমস্কার ও শুভেচ্ছা জানিয়ে বিশ্বনাথ মুখার্জীর সাথে ফিরে এলাম ইলা মিত্রের বাসভবনে। ইলাদি ও রমেন দা সব শুনে বললেন, “আপনারা আপনাদের কাজ ঠিকমতই এবং যত সত্বর সম্ভব করেছেন। তবে মুখ্যমন্ত্রীও ঠিকই বলেছেন, তাঁদের এখতিয়ার নেই দিল্লীর এখতিয়ার। নতুন মুখ্যমন্ত্রী সরাসরি দিল্লীর প্রধানমন্ত্রীর সাথে হটলাইনে যোগাযোগের সীমাবদ্ধতা দূর হলেই আপনােেদর কাজও দ্রুততর হতে তাই আপাতত: অপেক্ষায় থাকা ছাড়া তো উপায় নেই।” বিশ্বনাথ মুখার্জীও একই কথা বলেলন।
অত:পর পুনরায় আমরা কালী ঘাটের বাসায় ফিরে এলাম। নীচতলায় দোকানদারকে আড়ালে ডেকে ফোন আসবে এখানে মুখ্যমন্ত্রীর এবং এলে তৎক্ষণাৎ আমাদেরকে জানাবেন এই কথা বলে তাঁর সম্মতি জেনে উপরে চলে গেলাম। সেদিন ছিল এপ্রিল। যাহোক, এই বিলম্বজনিত ভোগান্তির কারণই যাকতো না যদি তখন মোবাইল ফোন অবিস্কৃত হতো। বিজ্ঞানের তৎকালীন পশ্চাৎপদতার কারণে আমাদেরকে বিলম্বের যন্ত্রণা সইতেই হলো।
পরদিন এপ্রিল কেটে গেল কালিঘাটের বাসাতেই। হঠাৎ ছাদের উপর থেকে অতি পরিচিত এক বন্ধুর (স্কুল-জীবনের সহপাঠি) মত একজনকে দেখে তাড়াহুড়া করে দৌড়ে ট্রামলাইন পার হয়ে ডাকলাম চিত্ত না? হ্যাঁ চিত্তই তো। পেছন ফিরে তাকিয়ে বলে উঠলো কে? বললাম, আমি রণেশ, পাবনার। তুমি চিত্তপ্রিয় মৌলিক না? ছুটে চিত্ত জড়িয়ে ধরলো। রাস্তার এক পাশে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ কথা হতেই জানলাম বাল্য জীবনে পূরোদস্তর অরাজনৈতিক চিত্ত প্রিয় দেশ ছেড়ে এসে এখানে নকশালবাদী সংগঠন ও রাজনীতিতে জড়িয়েছে। জিজ্ঞেস করলাম, বিয়ে শাদী করেছ কিনা? চাকুরী-বাকুরী কর কিনা…..ইত্যাদি। সেগুলির উত্তর না দিয়ে বলল, চল তোমাকে এক জায়গায় নিয়ে যাব-তবে দূরে নয়। মনে মনে ভয়ও পাচ্ছিলাম নকশালবাদী শুনে। ইতোমধ্যেই জেনে ফেলেছে আমার রাজনৈতিক পরিচিতি – মস্কোপন্থী ন্যাপের একজন নেতা হিসেবে।
সংকিত চিত্তেই ওর পিছু পিছু গেলাম। সন্ধ্যা নেমেছে তবে কলকাতার আলোকোজ্জ্বল রাস্তায় কোন অন্ধকার নামে নি। খানিকপরে একটি ভাঙা চোরা – জরাজীর্ণ বাড়ীতে নিয়ে তুলে চিত্ত বললো বস রণেশ। এইটা আমাদের আঞ্চলিক অফিস-তবে কাগজপত্র যেহেতু গোপনীয়-তাই সেগুলি এখানে রাখা হয় না। যা হোক, সে দাবী করলো পূর্ববাংরার চলমান বিদ্রোহের নেতা হলেন কমরেড তোয়াহা। তাঁকে কি চেনো?
বুঝলাম এদের মস্তিস্ক এতই বিকৃত হয়ে পড়েছে এবং বাস্তবতা থেকে এরা এতটাই দূরে ছিটকে পড়েছে যে তোয়াহা সাহেব যে এই সংগ্রামের ধারে কাছের কোন ব্যক্তিও নন-তা কথায় এদেরকে বুঝানো যাবে না। শুধু ব্ললাম চিত্ত, সার্কসীয় লেনিনীয় রাজনীতি কর-ঠিক আছে। আর সার্কসবাদ বাস্তবকে শতভাগ স্বীকার করেই নতুন বাস্তবতা তৈরীর জন্য সংগ্রাম করতে শেখায়। তোমরা এক কাজ করো। বাংলাদেশ থেকে ইতোমধ্যেই কয়েক লাখ সরণার্থী এসে পৌঁছেছেন। তাঁরা বেশ কয়েকটি আশ্রয় শিবিরে স্থান পেয়েছে। তাঁদের কাছে যাও তাঁরা সাধারণ মানুষ রাজনীতির দলীয় নেতা কর্মী নন। জিজ্ঞেস করো যে কাউকে কার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ চলছে। তোয়াহা সাহেবের নেতৃত্বে কি?
চত্ত বলে উঠলো, তোমরা তো সম্প্রসারণ বাদের খপ্পড়ে পড়েছ-বুঝবে কি করে? আমাদের পার্টির ডাক গতরাতে এসে পৌঁছেছে এখানে থাকলে পড়তে পেতে। তাতে স্পষ্ট বলা আছে কমরেড তোয়াহার নেতৃত্বে রুশ-ভারত কক্ষের বিরুদ্ধে লড়াই ক্রমশ তীব্র হয়ে উঠছে-জনগণও অস্ত্র হাতে নিয়ে লড়াইএ লিপ্ত হচ্ছে। এ জাতীয় আরও কথা বললো। তবে পাক-বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ক্রমশ শব্দও উচ্চরিত হলো না চিত্তর দেওয়া বিবরণীতে।
বুঝলাম কথা বলে লাভ নেই। ওখান থেকে দ্রুত সটকে পড়ার জন্য কালীঘাটের বৌদির দোহাই দিয়ে বললাম বাসায় তো বলে আসি নি চিত্ত। বৌদি ও অন্যান্যরা উদ্বিগ্ন হয়ে খোঁজাখুঁজি শুরু করবেন। আমার এক বন্ধু সঙ্গে এসেছেন-তিনিও চিন্তান্বিত হয়ে পড়বেন আমাকে না দেখে। কারণ তাঁকেও বলে আসি নি। তাই আজ একটু এগিয়ে দাও পরে একটা পুরো দিন একত্রে কাটাব। সব শুনবো ও বলবো। সঠিক ধারণা উভয়েই পাব।