সড়ক মহাসড়কগুলি কি শুধুই ধনিকদের জন্য?
সড়ক মহাসড়কগুলি কি শুধুই ধনিকদের জন্য?
সিডনীর কথকতা-৪৫
রণেশ মৈত্র (সিডনী থেকে)
সভপতিমন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ
বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের গর্বিত সন্তানদের ইতিহাস হয়ে যাওয়া ‘নিরাপদ সড়ক’ এর দাবীতে ঘটে যাওয়া আন্দোলনকে কার্য্যত: ব্যর্থ প্রমানের অবিরাম চেষ্টা চলছে। ঘটনাবলী যেভাবে ঘটে চলেছে তাতে তাই মনে হওয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক। বিদায়ী (নির্বাচনকারীন ক্ষুদ্র মন্ত্রসভা গঠনের প্রাক্কালে) সরকারের মন্ত্রী মহোদয়দের নানা উক্তি ও সিন্ধান্তে তেমনটাই মনে হয়।
অবাক বিস্ময়ে দেখলাম টেলিভিশনের পর্দায়, গত ২৭ আগষ্ট হঠাৎ করে এক বিশাল বৈঠকে বসে সড়ক ও সেতু মন্ত্রী সিদ্ধান্ত নিয়ে ঘোষণা করলেন, সড়ক-মহাসড়কে ধীর গতি সম্পন্ন কোন যান-বাহনে চলতে দেওয়া হবে না। অর্থাৎ রিকসা, টেম্পো, স্কুটার, ইঞ্জিল চালিত রিকসা, নসিমন, করিমন এবং এই জাতীয় অপরাপর যানবাহন চলতে দেওয়া হবে না।
তা হলে, বাংলাদেশের সড়ক-মহাসড়ক দিয়ে কোন কোন যানবাহন চলবে। সরকারী ভাষায় ‘দ্রুতদগতিসম্পন্ন যে যানটিতে সকলে চিনি সেটি হলো উড়োজাহাজ। কিন্তু সেটি যেহেতু সড়ক-মহাসড়ক দিয়ে চলে না-তাই সে প্রসঙ্গ উঠে না। এখন তা হলে কোন কোন যানবাহনকে চলতে দিতে চায় সরকার সকল নাগরিকের (গরীব বড়লোক নির্বিশেষে) অর্থে নির্মিত ঐ সড়ক-মহাসড়কগুলিতে? সেগুলি কার, মাইক্রোবাস, মিনি বাস, বাস, ট্রাক প্রভৃতি। এগুলির মালিক কারা? ধনীরা। আর ধীর গতি সম্পন্ন রিকসা, ভ্যান, টেম্পো, স্কুটার, নসিমন, করিমন প্রভৃতির মালিক কারা? দেশের গরীবেরা। এই উভয় ধরণের যানবাহনের যাত্রীও কিন্তু ভিন্ন শ্রেণীর। দ্রুতগতি সম্পন্ন যানবাহনের যাত্রী ধনীরা এবং ধীরগতিসম্পন্ন যানবাহনের যাত্রী অতিদ দরিদ্ররা।
তা হলে কি দাঁড়ালো?
নিঃসন্দেহে বলা যায়, সরকার লইছেন ধনীদের যান-বাহন ধনী যাত্রীদের নিয়েই চলুক প্রধানত: গরীবের টাকায় নির্মিত ঐ সড়কমহাসড়গুলি দিয়ে।
এমন সিন্ধান্ত যাঁরা নিলেন তাঁরা কারা? টিভিতে যতটুকু দেখা গেলো সড়ক ও সেতু মন্ত্রী সভাপতিত্ব করছেন পাশে রয়েছেন ‘শ্রমিক নেতা’ মন্ত্রী মহোদয় (যিনি সর্বাধিক সমালোচিত এবং সড়কের তাবৎ দুর্ঘটনার জন্যে নানাভাবে যাঁরা সিদ্ধান্তকে দায়ী করা হয়ে থাকে), পরিবহন মালিক ও তাদের আর্শীবাদটুকু পরিবহন শ্রমিক নেতারা যাদের দৌরাত্ম অহরহ সড়কে মানুষের প্রাণ যাচ্ছে।
এই মালিক শ্রমিক নেতারাই কোন অভিযোগে কোন মালিক বা শ্রমিক কারারুদ্ধ হলে বা আদালত কাউকে বিচার করে সাজা দিলে সড়ক পথে সকল প্রকার যান-বাহান চলাচল নানা মেয়াদের হরতাল/ধর্মঘট বিনা নোটিশে ডেকে হামেশাই অচল করে দিয়ে থাকে এবং সরকার দ্রুতই মামলা প্রত্যাহার করে নিয়ে তাদেরকে রাজার হালে কারাগার থেকে মুক্ত করে আনেন। ঐ মালিক শ্রমিক নেতারাই পুলিশকে আইন মোতাবেক কাজ করতে নানাভাবে বাধ্য করে থাকে।
এই পরিবহন মালিকেরা ঈদ যাত্রীদের কাছ থেকে বে-আইনীভাবে কী বিপুল অংকের টাকা ভাড়া হিসেবে আদায় করে থাকে, যারা বছরই বিভিন্ন জেলার বিভিন্ন সড়কে অতি মাত্রায় ভাড়া দিতে যাত্রীদেরকে বাধ্য করে থাকে-সরকার, মন্ত্রণালয় সবাই তখন নিশ্চুপ। আইনও যেন তখন অন্ধত্বে ভুগতে থাকে।
বাকী আলোচনায় যাবার আগে মাননীয় সড়ক-সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে বিনীতভাবে সামান্য কয়েকটি প্রশ্ন করি (এবং অবশ্যই তা জনস্বার্থে)ঃ-
এক. বি.আর.টি বাস (একতলা-দোতলা নির্বিশেষে) কি ধীর গতিসম্পন্ন? আমরা তো জানি তা দ্রুত গতি সম্পন্ন বাসের পর্য্যায়েই পড়ে। তেমনি একই পর্য্যায়ে অবশ্যই পড়ে বি আর টির ট্রাকগুলিও।
তা হলে ওগুলি কি সড়ক পথে মানুষ হত্যার দায়ে অপরাধী বলে চিহ্নিত হয়েছে এবং সে কারণেই কি দেশজোড়া বি.আর.টি.সির টার্মিনালগুলি বন্ধ করে দিয়ে সেখানে ঘাস অপসারণ প্রভৃতির জন্য রাখা হয়েছে এবং সকল বি.আর.টি.সি যান বাহনকে সারা দেশ থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে? বাস্তব চিত্র তো তাই বলে। সারাদেশে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত বি.আর.টি.সি. টার্মিনালগুলিতে গরু চরছে ঘাস-আগাছায়-জঙ্গলে পূর্ণ হচ্ছে মন্ত্রীদের নানা ক্ষেত্রে পরিণত হচ্ছে বাস ট্রাকগুলি কোথায় সংগোপনে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। শুমাত্র ঢাকা শহরে নিতান্ত অসহায়ভাবেই যে কোন কোন রুটে দু’চারটি বি.আর.টি.সি. বাস চালানো হচ্ছে।
জনগণের চাহিদা বি.আর.টি.সি. টার্মিনালগুলি চালু করা হোক-প্রতি জেলায় কম পক্ষে ৫০ টি করে বি.আর.টি.সি বাস ও ৩০ টি করে ট্রাক চালু করা হোক এবং যাতে সরকারী ও বেসরকারী পরিবহনগুলির মধ্যে ভারসাম্য বজায় থাকে, পরস্পর সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক বজায় থাকে তা নিশ্চিত করা হোক।
জনগণের এই চাহিদার কারণ, বি.আর.টি.সি. বাসগুলি সময়মত ছাড়ে ও চলাচল করে, তাদের চলক-হেলপার সহ কর্মীদের ব্যবহার যথেষ্ট ভদ্র এবং তাদের সেবার মান তুলনামূলকভাবে ভাল।
কিন্তু বেসরকারী বাস চলাক-হেলপারকে শতকরা ৯০ ভাগ বেপরোয়া, তাদের যাত্রীদের সাথে দুর্ব্যবহার, বহুক্ষেত্রে মহিলা যাত্রীদের উপর যৌন ও অপরাপর নির্য্যাতন, কথায় কথায় যাত্রীভাড়া বৃদ্ধি সহ নানাভাবে যাত্রী পীড়নে যাত্রী সাধারণ বিক্ষুব্ধ।
তাই সড়ক-মহাসড়কে তাদের একচেটিয়া ব্যবসা বন্ধ করে সেখানে সরকারী যান বাহন (বি.আর.টি.সি) বিপুল সংখ্যায় নামিয়ে অবিলম্বে ভারসাম্য সৃষ্টি করা জরুরী প্রয়োজন।
দেশবাসী চান বি.আর.টি.সি. সকল যান চলাচল করুক। একতলা-দোতলা নির্বিশেষে। ঐ যান বাহনের সংখ্যা আরও অনেক বেশী বাড়ানো হোক। কিন্তু বেসরকারী বাস মালিক-শ্রমিকরা ঐ আকাংখার বিরুদ্ধে। সরকার কি তবে ঐ ধনী পরিবহন মালিকদের অবৈধ এবং একতিয়ার বিহীন দাবীর পক্ষে বলে বি.আর.টি.সির যান বাহনগুলি প্রত্যাহার করে নিয়েছেন?
লক্কর ঝক্কর মার্কার ভাঙ্গচোরা গড়ীগুলি শুধুমাত্র রং বদল করেই মালিকেরা যে সেগুলি সড়ক-মহাসড়কে চালিয়ে যাত্রী সাধারণের জীব বিপন্ন করছে-হতাহত করছে প্রতিদিন অসংখ্য যাত্রীর-তার কার্য্যকর কোন সুরাহা হয়েছে কি? সেগুলি কেন জব্দ করা হয় না-জব্দ করে ভেঙ্গে চুরে ফেলে যাত্রীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই বা বাধা কোথায়?
চালকদের প্রশ্নে আসা যাক। একজন চালকের ওপর নির্ভর করেই ৫০/৬০ জন যাত্রী-নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে গড়ীতে ওঠেন। মালিকও কোটি টাকার গাড়ীটা ঐ চালকের হাতেই সঁপে দেন। সেই চালক যদি উপযুক্ত প্রশিক্ষণ বিহীন হন তবে কাকে দায়ী করা যাবে? ধ্বনিচালককে টাকার বিনিময়ে গাড়ী চালানোর লাইসেন্স দিলেন সেই সরকারী কর্মকর্তা অবশ্যই দায়ী। কিন্তু সেই কর্মকর্তা যখন দেখেন শ্রমিক নেতা নামে একজন মন্ত্রী ঐ চালককে লাইসেন্স দিতে বা একজন চালককে নাম-কা-ওয়াস্তে প্রশিক্ষণের ভিত্তিতে এবং শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে লাইসেন্স ইস্যু করতে চাপ প্রয়োগ বা আকারে ইঙ্গিতে নির্দেশ দিয়ে থাকেন। তো শুধুমাত্র যিনি লাইসেন্সটি ইস্যু করলেন এককভাবে তিনি তো দায়ী হতে পারেন না। যিনি ইঙ্গিতে হুকুম দিলেন মসনদে বসে তিনি বাদ যাবেনর কোন যুক্তিতে?
ধীর গতিতে চলা গরীব মানুষের যানবাহনগুলির কি হবে? অন্তত: কয়েক লক্ষ চালক বেকার, মালিক উপার্জনহীন এবং যাত্রীদের ব্যয় বৃদ্ধি কি কোনভাবেই কাম্য হতে পারে? তবে এ কথাও সত্যি যে ধীর গতি সম্পন্ন গাড়িগুলির সংখ্যা হু হু করে বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে একটা মারাত্মক সংকটের সৃষ্টি হচ্ছে সড়ক-মহাসড়কগুলিতে।
এমতাবস্থায় গরীব যানবাহনের মালিক ও চালকদেরকে বেকারত্ব থেকে রক্ষা এবং গরীব যাত্রীদের স্বার্থ সংরক্ষণের পথও বের করতে হবে। রাস্তা সড়ক-মহাসড়কগুলিতে খানিক অংশ তাদের জন্য ছেড়ে দিতে হবে এবং রাস্তা-সড়ক-মহাসড়ক প্রয়োজন এবং সম্ভবমত সম্প্রসারণও করতে হবে। মালয়েশিয়াসহ নানা উন্নয়নশীল দেশে এগুলি বিবেচনায় নিয়ে নতুন নতুন কমদামী কিন্তু আরামদায়ক তিন চাকা বিশিষ্ট যান-বাহন তৈরী করছে।
মনে পড়ে বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই পরিবহন মালিক-শ্রমিকেরা নসিমন, করিমন নামক যানগুলিকে নিষিদ্ধ ঘোষণার দাবীতে আন্দোলন গড়ে তুলেছিল কিন্তু জনগণ তাতে সায় দেয় নি। তারা বলেছে, ঐগুলির ভাড়া অনেক কম। তাছাড়া ঐ যানগুলি প্রয়োজনমত থামানও
যায়। ফলে যাত্রীদের বিস্তর সুবিধা হয়। কিন্তু যদি নসিমন করিমনগুলি নিষিদ্ধ করা পরিবহণ মালিকেরা তৎক্ষণাতৎ নানা রুটে যাত্রীভাড়া বাড়িয়ে দেবে কিন্তু যাত্রীদের প্রয়োজনমত ওঠা নামার ব্যবস্থা হবে না। ফলে সমস্যা জটিলতর হবে। নছিমন করিমন কৃষকদের উৎপাদিত পন্য স্বল্প ভাড়ায় নানা হাট বাজারে বহন করে থাকে। তাদেরকে বে-আইনী করলে ট্রাক-ভাড়াও বাড়বে বেড় যাবে ক্রেতা পর্যায়ে পণ্য মূল্যও। তাই বিষয়টা পুনর্বিবেচনার দাবী রাখে। কারণ পরিবহণ জটিলতা তার স্বল্পতা, তার ভাড়া বৃদ্ধি জনজীবনে ব্যাপক নেতিবাচক প্রবাব ফেলে থাকে। এবং তা কদাপি গ্রামাঞ্চলে সীমাবদ্ধ থাকে না ছড়িয়ে পড়ে গ্রাম-শহর নির্বিশেষে সর্বত্র।
ঢাকা শহর নিয়ে যেন ভাবতে হবে বারংবার তেমনি সমগ্র বাংলাদেশ নিয়েও বহুবার ভাবতে হবে। পরিবহন মালিক শ্রমিকদের কাছে দেশবাসী অসহায়ত্বের শিকারে পরিণত হয়েছে। দিন দিনই তাদের দৌরাত্ম বৃদ্ধি পাচ্ছে।
যে কারণে আমাদের তরুণ ছাত্র সমাজ ‘সড়রক নিরাপত্তার’ দাবীতে এক ঐতিহাসিক আন্দোলন গড়ে তুলেছিল তা যেমন স্বত:ষ্ফূর্তভাবে দিগ বিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল তা দেখে যারা আঁতককে উঠেছিলেন তাঁদেররই একজন প্রধান ব্যক্তি হলেন প্রভাবশালী শ্রমিক নেতা ও নৌ পরিবহন মন্ত্রী। উভয় পদে অবস্থিত থাকায় সকল ধরণের পরিবহনে কলকাঠি নাড়ার সুযোগ সীমাহীন। ধারণা সংশোধিত সড়ক পরিবহন আইন যাতে কোন মতেই পরিবহন মালিক শ্রমিকদের বিপক্ষে না যায় তা যতই কেন না যাত্রী সাধারণের জীবন নাশ সহ নানাভাবে যাত্রীদের ক্ষতিসাধান করুক-সে চেষ্টা তিনি সর্বশক্তি দিয়ে করেছেন ফলে ঐ সংশোধনী একটি দুর্বল সংশোধনীতে পরিণত হয়েছে এবং অপরাধী পরিবহন মালিক শ্রমিকদের স্বার্থের অনুকূলে আসতে পারে নি।
আবার ‘ধীরগাতির পরিবহন’ সড়ক মহাসড়কে বন্ধ করার সিন্ধান্তের পেছনেও সম্ভবত: দস্তÍর মত যেলে যাবেন। সরকারের উচ্চ মহলের কাছে আবেদন জানাই যেন দুটি পদে তিনি কিছুতেই না থাকতে পারেন তাতে দেশের ক্ষতি হচ্ছে পরিবহন খাতে উচ্ছৃংখলতা স্থায়ীরূপ নিচ্ছে পরিবহন মালিক শ্রমিকেরা দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে।
প্রয়োজন বহুবিধ বিকল্প ব্যবস্থারও। যেমন, রেলপথের ব্যাপক সম্প্রসারণ। নতুন নতুন সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণ, বিদ্যমান সড়কমহাসড়কগুলি প্রশস্তকরণ; ধীরগতির কোন বাহন বে-আইনী না করে রাস্তাগুলি চওড়া করে তাদের জন্য স্পেস নির্দিষ্ট করে দেওয়া, কম দামী যান-বাহনগুলির আধুনিকীকরণ; যাত্রী স্বার্থে পরিবহন আইনের পুন: সংশোধন, চালক প্রশিক্ষণের উপযুক্ত ব্যবহার গ্রহণ, লাইসেন্স প্রদান দুর্নীতি মুক্ত করণ, লক্কর-ঝক্কড় মার্কা সকল যান উচ্ছেদকরণ প্রভৃতি। পদক্ষেপগুলি জরুরী ভিত্তিতে নেওয়া প্রয়োজন।
লেখক- রণেশ মৈত্র
সাংবাদিকতায় একুশে পদক প্রাপ্ত