১২ ডিসেম্বর মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর জন্ম গ্রহণ করেন।
সম্পাদকীয় ডেস্ক । কাগজটোয়েন্টিফোরবিডিডটকম
মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ১৮৮০ সালের ১২ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জের সয়া ধানগড়া গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। হাজী শারাফত আলী ও বেগম শারাফত আলীর পরিবারে ৪ টি সন্তানের জন্ম হয়। একটি মেয়ে ও তিনটি ছেলে। মোঃ আব্দুল হামিদ খান সবার ছোট। তাঁর ডাক নাম ছিল চেগা মিয়া। ছেলে-মেয়ে বেশ ছোট থাকা অবস্থায় হাজী শারাফত আলী মারা যান। কিছুদিন পর এক মহামারীতে বেগম শারাফত ও দুই ছেলে আমীর আলী খান ও ইসমাইল খান মারা যায়। বেঁচে রইলেন বোন এবং ছোট ভাই আবদুল হামিদ খান ওরফে চেগা মিয়া।
পিতৃহীন হামিদ প্রথমে কিছুদিন চাচা ইব্রাহিমের আশ্রয়ে থাকেন। ওই সময় ইরাকের এক আলেম ও ধর্ম প্রচারক প্রখ্যাত সূফী সৈয়দ নাসির উদ্দীন আহমদ বোগদাদী (রহঃ) সিরাজগঞ্জে আসেন। হামিদ তাঁর আশ্রয়ে কিছুদিন কাটান। এরপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কিছুদিন পূর্বে ১৮৯৩ সালে তিনি জয়পুরহাট জেলার পাঁচবিবি উপজেলার জমিদার শামসুদ্দিন আহম্মদ চৌধুরীর বাড়িতে যান। সেখানে তিনি মাদ্রাসার মোদাচ্ছের এর কাজ করেন এবং জমিদারের ছেলে-মেয়েকে পড়ানোর দায়িত্ব নেন। ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে পীর সৈয়দ নাসীরুদ্দীনের সাথে আসাম গমন করেন। ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। ইসালামিক শিক্ষার উদ্দেশ্যে ১৯০৭-এ দেওবন্দ যান। দুই বছর সেখানে অধ্যয়ন করে আসামে ফিরে আসেন। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস ময়মনসিংহ সফরে গেলে তাঁর ভাষণ শুনে ভাসানী অনুপ্রাণিত হন। ১৯১৯ সালে কংগ্রেসে যোগদান করে অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে দশ মাস কারাদণ্ড ভোগ করেন। ১৯২৩ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন স্বরাজ্য পার্টি গঠন করলে ভাসানী সেই দল সংগঠিত করার ব্যাপারে ভূমিকা পালন করেন। ১৯২৫ সালে তিনি জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলার জমিদার শামসুদ্দিন আহম্মদ চৌধুরীর মেয়ে আলেমা খাতুনকে বিবাহ করেন। ১৯২৬ সালে তিনি তার সহধর্মিণী আলেমা খাতুনকে নিয়ে আসাম গমন করেন এবং আসামে প্রথম কৃষক-প্রজা আন্দোলনের সুত্রপাত ঘটান। ১৯২৯-এ আসামের ধুবড়ী জেলার ব্রহ্মপুত্র নদের ভাসান চরে প্রথম কৃষক সম্মেলন আয়োজন করেন। এখান থেকে তার নাম রাখা হয় “ভাসানীর মাওলানা”। এরপর থেকে তার নামের শেষে ভাসানী শব্দ যুক্ত হয়।
মানুষকে ধর্মীয় শিক্ষা দানের জন্য পীরসাহেব আসামের জঙ্গলে স্থাপন করেন ইসলাম প্রচার মিশন। ভাসানী তখন মিশনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। মিশনের কাজ নিয়ে তিনি চলে এলেন বগুড়া পাঁচবিবিতে। এখানে পরিচয় হল জমিদার শামসুদ্দিন আহম্মদ চৌধুরীর সাথে। ভাসানী জমিদার সাহেবের ছেলে মেয়েদের গৃহশিক্ষক নিযুক্ত হলেন। পরে শুধু গৃহশিক্ষকতা নয়, জমিদারী দেখাশোনা করারও দায়িত্ব পেলেন ভাসানী। জমিদারি সংক্রান্ত ব্যাপারে ভাসানীকে প্রায়ই কলকাতায় যাতায়াত করতে হত। কলকাতা তখন ছিল বিপ্লবী দলের কিছু কর্মী সাথে তাঁর পরিচয় হয়। ১৯১৯ সালে ময়মনসিংহে কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলন উপলক্ষেই ভাসানী দেশবন্দু চিত্তরঞ্জন দাসের সান্নিধ্যলাভের সুযোগ পান। ভাসানী তখন থেকেই দেশবন্ধুর অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। ১৯১৯ সালেই ভাসানী অানুষ্ঠানিকভাবে কংগ্রেসে যোগদান করেন এবং অসহযোগী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। আন্দোলনে নেমে গ্রেফতার হন। তাঁর নয় মাসের জেল হয়। এটাই ভাসানীর প্রথম কারাবরণ। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ১৯২১ সালে তিনি আলিভ্রাতৃদ্বয় অর্থাৎ মওলানা মোহাম্মদ আলি এবং শওকত আলির ডাকে খেলাফত আন্দোলন এবং একই সাথে দেশবন্ধুর ডাকে অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান করলেন। আবারও গ্রেফতার হলেন তিনি। এবার হল সাতদিনের জেল।
১৯২২ সালে উত্তর বঙ্গ ও আসামে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। বিপন্ন মানুষের সেবায় এগিয়ে আসেন ভাসানী। কলকাতা থেকে এলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, নেতাজি সুভাষ বসুসহ আরও অনেকে। ভাসানী এইসব জাতীয় নেতার সাথে দুঃস্থ মানুষের সেবায় দিনরাত কাজ করতে লাগলেন।
মওলানা ভাসানী লাইনপ্রথা ও বাঙাল খেদা আন্দোলনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তুলেছিলেন ১৯২৫ সালে। সেই সময়ে আসামে ‘লাইন প্রথা’ চালু হলে এই নিপীড়নমূলক প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দান করেন। এসময় তিনি ” আসাম চাষী মজুর সমিতি” গঠন করেন এবং ধুবরী, গোয়ালপাড়া সহ বিভিন্ন জায়গায় প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আসামের লাইন প্রথাবিরোধী আন্দোলন থেকে সরে থাকার জন্য স্বয়ং মুহম্মদ আলি জিন্নাহ পর্যন্ত তাঁকে অনুরোধ করেন। কিন্তু জিন্নাহর প্রস্তাবও ভাসানী প্রত্যাখ্যান করেন।
তিনি ১৯২৯ সালে সিরাজগঞ্জের কাওয়াখোলা ময়দানে ‘বঙ্গ আসাম প্রজা সম্মেলন’ আহ্বান করেন। এই সম্মেলনে প্রায় তিন লাখ লোকের সমাগম হয়েছিল। সম্মেলনের উদ্বোধন করেছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।
১৯৩১-এ সন্তোষের কাগমারীতে, ১৯৩২-এ সিরাজগঞ্জের কাওরাখোলায় ও ১৯৩৩-এ গাইবান্ধায় বিশাল কৃষক সম্মেলন করেন। ১৯৩৭-এ মাওলানা ভাসানী কংগ্রেস ত্যাগ করে মুসলীম লীগে যোগদান করেন। ১৯৩৭ সালে ভাসানী আসামের প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। তাঁর নেতৃত্বে আসামের বারোটি জেলায় মুসলিম লীগের সংগঠন আরও জোরদার হয়। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনেই আসামের ৩৪ আসনের মধ্যে ৩১ টি আসন লাভ করে। ভাসানী নিজেও আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন। মুসলিম লীগের মন্ত্রীপরিষদ গঠিত হওয়ার পরও ভাসানী তাঁর লাইনপ্রথা ও বাঙাল খেদা আন্দোলনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে লাগলেন। ফলে সরকারের সাথে তাঁর সম্পর্কের অবনতি ঘটে। কেন্দ্রীয় লীগ নেতৃবৃন্দ তাঁকে নিজদলীয় সরকারের বিরোধিতা করা থেকে বিরত থাকার জন্য অনুরোধ করলেন। কিন্তু ভাসানী তার আর্দশের প্রতি অটল রইলেন।
১৯৩৮ সালে তিনি রংপুরে গাইবান্দায় কৃষক প্রজা সম্মেলনের আয়োজন করলেন।
১৯৪০ সালে শের-এ-বাংলা এ.কে. ফজলুল হকের সঙ্গে মুসলীম লীগের লাহোর সম্মেলনে যোগদান করেন। ১৯৪৪ সালে মাওলানা ভাসানী আসাম প্রাদেশিক মুসলীম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন।
ভাসানীর আন্দোলনের মুখে ১৯৪৬ সালে দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই আসামের মুসলিম লীগ সরকারের পতন ঘটে। তবে পুলিশ বাঙালীদের ওপর গুলি চালায় এবং একজন নিহত হয়। ভাসানী গ্রেফতার হন। ১৯৪৭ সালের ২৯ জুন ভাসানী গৌহাটি কারাগার থেকে ছাড়া পেলেন। ছাড়া পেয়েই তিনি ছুটে এলেন সিলেটে। পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্ব মুহুর্তে সিলেট পাকিস্তানের অংশ হবে কি না এই নিয়ে গণভোট হয়। ভাসানী সিলেটকে পাকিস্তানের অন্তর্ভূক্তকরণের পক্ষে সমর্থন করেন। এই আন্দোলন সফল হয়েছিল।
১৯৪৭ সালে ১৪ আগষ্ট ভারত বর্ষ দ্বিখন্ডিত হয়ে জন্ম নিল দু’টি পৃথক রাষ্ট্র পাকিস্তান ও ভারত। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর আসাম সরকার মওলানা ভাসানীকে অবিলম্বে আসাম ত্যাগের নির্দেশ দেয়। এরপর তিনি টাঙ্গাইলের সন্তোষে ফিরে আসেন।
১৯৪৮ সালের প্রথম দিকে তিনি বঙ্গীয় মুসলিম লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১৭ মার্চ ব্যবস্থাপক সভার কার্যাবলি বাংলায় পরিচালনা করার জন্য স্পিকারের কাছে দাবি জানান এবং এই দাবি নিয়ে পীড়াপীড়ি করেন। ১৯ মার্চ বাজেট বক্তৃতায় অংশ নিয়ে বলেন, যেসব কর কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ববঙ্গ প্রদেশ থেকে সংগ্রহ করে তার শতকরা ৭৫% প্রদেশকে দিতে হবে। এখানে উল্লেখ্য যে, ব্রিটিশ আমলে বঙ্গপ্রদেশ জুটেক্স ও সেলসট্যাক্স রাজস্ব হিসেবে আদায় করত এবং এই করের ভাগ কেন্দ্রীয় সরকারকে দিতে হতো না। পাকিস্তান সৃষ্টির পর কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ববঙ্গ সরকারের হাত থেকে এই কর ছিনিয়ে নিয়ে নিজেরাই আদায় করতে থাকে যার ফলে পূর্ববঙ্গ সরকার আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো এই সময় পূর্ববঙ্গ সরকারের বার্ষিক বাজেট ছিল মাত্র ৩৬ কোটি টাকা। যাই হোক, মুসলিম লীগ দলের সদস্য হয়েও সরকারের সমালোচনা করায় মুসলিম লীগের ক্ষমতাসীন সদস্যরা মওলানা ভাসানীর ওপর অখুশী হয় এবং তার নির্বাচনে ত্রুটি ছিল এই অজুহাত দেখিয়ে আদালতে মামলা দায়ের করে এবং মওলানা ভাসানীকে নানাভাবে হয়রানি করতে থাকে। পরিশেষে মওলানা ভাসানী ব্যবস্থাপক সভার সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এতদসত্ত্বেও পূর্ববঙ্গের তৎকালীন গভর্নর এক নির্বাহী আদেশ বলে মওলানা ভাসানীর নির্বাচন বাতিল করেন। শুধু তাই নয় ১৯৫০ সাল পর্যন্ত যাতে ভাসানী কোন নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে এই মর্মেও নিষেধাজ্ঞা জারি করেন।
বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের জনবিরোধী কার্যকলাপের ফলে মওলানা ভাসানী ১৯৪৯ সালের ২৩-২৪ জুন ঢাকার টিকাটুলিতে রোজ গার্ডেনে মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলন আহ্বান করেন। ২৩ জুন ওই কর্মিসম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সারাদেশ থেকে প্রায় ৩০০ কর্মি সম্মেলনে যোগদান করেন। সভায় সভাপতিত্ব করেন আতাউর রহমান খান। মওলানা ভাসানী ছিলেন প্রধান অতিথি। ২৩ জুন পূর্ববঙ্গের প্রথম বিরোধী রাজনৈতিক দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ গঠিত হয়। মওলানা ভাসানী সর্বসম্মতিক্রমে এই দলের সভাপতি নির্বাচিত হলেন। সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন শামসুল হক। ২৪ জুন আরমানীটোলা ময়দানে আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম জনসভা অনুষ্ঠিত হয়।
১৯৪৯ সালের মধ্যভাগে পূর্ববঙ্গে খাদ্যাভাব দেখা দেয়। ১১ অক্টোবর আরমানীটোলা ময়দানে আওয়ামী লীগের একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় খাদ্য সমস্যা সমাধানে ব্যর্থতার জন্য পূর্ববঙ্গ মন্ত্রিসভার পদত্যাগ দাবি করা হয় এবং ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মওলানা ভাসানী ভুখা মিছিলে নেতৃত্ব দেন। ভূখা মিছিলে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য ১৯৪৯-এর ১৪ অক্টোবর গ্রেফতার হয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কারাবরণ করেন।
১৯৫০ সালে সরকার কর্তৃক রাজশাহী কারাগারের খাপরা ওয়ার্ড এর বন্দীদের উপর গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অনশন ধর্মঘট পালন করেন এবং ১৯৫০ সালের ১০ ডিসেম্বর তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৫২-র ৩০ জানুয়ারি ঢাকা জেলার বার লাইব্রেরী হলে তার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ গঠিত হয়। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সহযোগিতার কারণে গ্রেফতার হয়ে ১৬ মাস কারানির্যাতনের শিকার হন। অবশ্য জনমতের চাপে ১৯৫৩ সালের ২১ এপ্রিল মওলানা ভাসানীকে জেল থেকে মুক্তি দেয়া হয়।
পূর্ববঙ্গের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ১৯৫৩ সালের ৩ ডিসেম্বর কৃষক-শ্রমিক পার্টির সভাপতি শের-এ-বাংলা এ.কে. ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীকে সঙ্গে নিয়ে যুক্তফ্রন্ট নামক নির্বাচনী মোর্চা গঠন করেন। নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিপুল বিজয় অর্জন করে এবং পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পরিষদে ২৩৭ টির মধ্য ২২৮ টি আসন অর্জনের মাধ্যমে নিরঙকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। ফজলুল হকের নেতৃত্বে সরকার গঠন করার পর ২৫শে মে ১৯৫৪ মাওলানা ভাসানী বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে যোগদানের উদ্দেশ্যে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোল্ম যান এবং সেখানে বক্তব্য প্রদান করেন। ৩০ মে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে গভর্ণরের শাসন জারি করে এবং মাওলানা ভাসানীর দেশে প্রত্যাবর্তনের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করেন। ১১ মাস লন্ডন, বার্লিন, দিল্লী ও কলকাতায় অবস্থান করার পর তার উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হলে ১৯৫৫-র ২৫ এপ্রিল দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। পূর্ব বাংলায় খাদ্যজনিত দুর্ভিক্ষ রোধের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে ৫০ কোটি টাকা আদায়ের দাবিতে ১৯৫৬-র ৭ মে ঢাকায় অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। সরকার দাবি মেনে নিলে ২৪ মে অনশন ভঙ্গ করেন।
একই বছর ১২ সেপ্টেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ-রিপাবলিকান পার্টির কোয়ালিশন সরকার গঠিত হলে মাওলানা ভাসানী সরকারের পররাষ্ট্রনীতির বিরোধিতা করে নিরপেক্ষ নীতি অবলম্বন করার জন্য সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করেন।
১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দের কাগমারী সম্মেলনে তিনি পাকিস্তানের পশ্চিমা শাসকদের ‘ওয়ালাকুমুসসালাম’ বলে সর্বপ্রথম পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতার ঐতিহাসিক ঘণ্টা বাজিয়েছিলেন। ভাসানীর রাজনৈতিক জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল কাগমারি সম্মেলন। সেই বছরই ১৯৫৭ সালে তিনি আওয়ামী লীগের সাথে সর্ম্পক ছিন্ন করে নতুন রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল আ্ওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করেন।
কাগমারী সম্মেলনে ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়। ৮ ফেব্রুয়ারি ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানটি আরম্ভ হয়। এই সভায় মওলানা ভাসানীও বক্তৃতা করেন। বক্তৃতায় অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে তিনি বলেন, পূর্ববাংলা পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকদের দ্বারা শোষিত হতে থাকলে পূর্ববঙ্গবাসী তাদের আলায়কুম আসসালাম জানাতে বাধ্য হবে।এছাড়া কাগমারী সম্মেলনে ভাসানী পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিলের দাবি জানান। প্রধানমন্ত্রী সোহ্রাওয়ার্দী সেই দাবি প্রত্যাখান করলে ১৮ মার্চ আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেন। একই বছর ২৫ জুলাই তার নেতৃত্বে ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে ‘ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি’ (ন্যাপ) গঠিত হয়। ন্যাপ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভাসানী প্রকাশ্যে বামপন্থী রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন এবং এর পর থেকে সবসময় বাম ধারার রাজনীতি এর সাথেই সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ১৯৫৭-র ৭ অক্টোবর দেশে সামরিক শাসন জারি হলে আইয়ুব খান ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে সকল রাজনৈতিক দলের কর্মকান্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ১২ অক্টোবর মাওলানা ভাসানীকে কুমুদিনী হাসপাতাল থেকে গ্রেফতার করা হয়। ঢাকায় ৪ বছর ১০ মাস কারারুদ্ধ থাকেন।
বন্দী অবস্থায় ১৯৬২-র ২৬ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত বন্যাদুর্গতদের সাহায্য ও পাটের ন্যায্যমূল্যসহ বিভিন্ন দাবিতে অনশন ধর্মঘট পালন করেন। ৩ নভেম্বর মুক্তিলাভ করেন এবং ন্যাশনাল ডেমোক্রাটিক ফ্রন্ট-এর রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত হন। ১৯৬৩-র মার্চ মাসে আইয়ুব খানের সাথে সাক্ষাত করেন। একই বছর ২৪ সেপ্টেম্বর চীনের বিপ্লব দিবস-এর উৎসবে যোগদানের জন্য ঢাকা ত্যাগ করেন এবং চীনে সাত সপ্তাহ অবস্থান করেন। ১৯৬৪-র ২৯ ফেব্রুয়ারি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি পুনরুজ্জীবিত করে দলের সভাপতির দ্বায়িত্বভার গ্রহন করেন এবং একই বছর ২১ জুলাই ‘সম্মিলিত বিরোধী দল’ (কপ) গঠনে ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬৫-র ১৭ জুলাই আইয়ুব খানের পররাষ্ট্র নীতির প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেন। ১৯৬৬-তে শেখ মুজিবুর রহমানের উপস্থাপিত ছয় দফা কর্মসূচীর বিরোধিতা করেন। ১৯৬৭-র ২২ জুন কেন্দ্রীয় সরকার রেডিও ও টেলিভিশন থেকে থেকে রবীন্দ্র সঙ্গীত প্রচার বন্ধ করার নির্দেশ জারি করলে এর প্রতিবাদ করেন।
১৯৬৮ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে আগরতলা যড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হলে সারা দেশে গড়ে ওঠে আন্দোলন। ভাসানীও এই ষড়যন্ত্রমূলক মামলার বিরুদ্ধে আন্দোলনে শরীক হন। আন্দোলনের মুখে ১৯৬৯ সালে ২২ ফেব্রুয়ারি সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়।
১৯৬৯ সালে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে মাওলানা ভাসানী বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। ৮ মার্চ (১৯৬৯) পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে সেখানে পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর সাথে সাক্ষাত করে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র কায়েমের লক্ষ্যে একমত হন। ২৬ শে ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খান কর্তৃক আহুত গোলটেবিল বৈঠক প্রত্যাখান করে শ্রমজীবীদের ঘেরাও কর্মসূচী পালনে উৎসাহ প্রদান করেন।
৬৯ এর আন্দোলনেও তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। কৃষক আন্দোলনের নেতা হিসেবে তার রাজনৈতিক জীবনের শুরু। তিনি সবসময় রাজনীতি করেছেন অধিকার বঞ্চিত মানুষের জন্য। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্টি হওয়া পাকিস্তানে তিনি উড়িয়েছিলেন অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির পতাকা। দরিদ্র মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে আজীবন সংগ্রাম করে গিয়েছেন মওলানা ভাসানী।
দেওবন্দ মাদ্রাসায় ধর্মশিক্ষা বিষয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে তিনি সংগ্রামী ও দেশপ্রেমিক একদল আলেমের সংস্পর্শে আসেন। ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে তাদের কাছ থেকে দীক্ষা গ্রহণ করে রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হন। এক সময় আসাম চলে গিয়ে কলকাতার সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানকার বিপ্লবীদের সঙ্গে দেওবন্দের মাওলানাদের চেতনার মিল দেখে তিনি এ রকম রাজনীতির সঙ্গে একাত্ম হন। বিপ্লবী রাজনীতি শুধু ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে পরিচালিত নয়, তাদের সৃষ্ট জমিদার, জোতদার ও মহাজনদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের কর্মপন্থা এটি তাকে বিপ্লবীদের কাছাকাছি নিয়ে আসে। পূর্ব বাংলায় তিনি কৃষকদের নিয়ে ইংরেজ শাসনের তাঁবেদার শোষকদের গোলা জ্বালিযে দেয়ার মতো অনেক ঘটনার জন্ম দেন। তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন বিদ্রোহী মওলানা নামে।
রাজনৈতিক জীবনের বেশীরভাগ সময় বামপন্থী রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন, যদিও তিনি একান্ত ধর্মপ্রাণ মুসলমান ছিলেন, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। তিনি ছিলেন একজন দূরদর্শী নেতা এবং পঞ্চাশের দশকেই নিশ্চিত হয়েছিলেন যে পাকিস্তানের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ একটি অচল রাষ্ট্রকাঠামো। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রথম স্বপ্নদ্রষ্টা ও পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি । শোষিত-বঞ্চিত ও নিপীড়িত অধিকারহারা মানুষের অধিকার আদায়ে সংগ্রামী মহাপুরুষ ছিলেন মাওলানা ভাসানী। ভাসানী এমন একজন নেতা ছিলেন যাকে নিয়ে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আজ পিএইচডি ডিগ্রী অর্জনে গবেষণা চলছে।
সম্পাদনায়-মাহবুব এইচ শাহীন/প্রকাশক ও সম্পাদক/কাগজ২৪